হাজার বছরের কুসংস্কারে নিমজ্জিত ভারতবর্ষের বাংলায় মহান সংস্কারক রামমোহন রায় যখন পরিবর্তনের ডাক দিলেন, ঠিক তখন কলকাতায় আবির্ভাব ঘটে একদল ক্ষ্যাপাটে বুদ্ধিবাদী ছাত্রের। যারা অশান্ত, অপ্রতিরোধ্য, অথচ চূড়ান্ত মাত্রায় স্পষ্ট। এদেরকে বলা হয় আধুনিক ভারতের প্রথম প্রথাবিরোধী ও মুক্তচিন্তার সংঘবদ্ধ সংগঠন। সমাজ তাদের নাম দেয় ইয়ং বেঙ্গল অথবা নব্য বঙ্গ আন্দোলন।
ব্রাহ্ম সমাজের উৎপত্তি স্বদেশী রামমোহনের হাত ধরে হলেও ইয়ং বেঙ্গলের জন্ম হয় একজন ফিরিঙ্গির হাত ধরে। নাম তার হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ডিরোজিওর পূর্ব পুরুষরা ভারতবর্ষে আসে সুদূর পর্তুগাল থেকে। এরপর আর ফিরে যাননি। ভারতে বসবাসরত ইউরোপীয় অথবা এশিয়া-ইউরোপ মিশ্রিত জনগোষ্ঠীকে ফিরিঙ্গি বলা হতো।
ডিরোজিওর জন্ম ১৮০৯ সালে। চৌদ্দ বছর বয়সে লেখাপড়ায় ইতি টেনে কিছুদিন তার পিতার কর্মস্থলে চাকরি করেন। তারপর শুরু করেন কাব্যচর্চা। ইমানুয়েল কান্টের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনা ও বেশ কিছু সাড়া জাগানো কবিতা লিখে তরুণ বয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। এই খ্যাতির ফলে কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু কলেজ তাকে ডেকে এনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে সাড়া দেন ডিরোজিও।
১৮২৮ সালের মার্চ মাসে তিনি হিন্দু কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তারপর বাকিটা ইতিহাস। শিক্ষকতার শুরুতেই সহ-শিক্ষকদের সাথে নিজের পার্থক্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এটা সম্ভব হয়েছিলো ডিরোজিওর স্বকীয় পাঠদান পদ্ধতি ও ছাত্রদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে। ফলে কেবল নিজ শ্রেণীর ছাত্ররা নয়, সব শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। শিক্ষকদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বা কোথাও বসে লেখাপড়ার বাইরেও কথা বলা যায়, এটা তাদের কাছে অভিনব একটা বিষয় ছিলো।
এই অভিনব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ছাত্ররা তার কাছে এলে তিনি আড্ডার ছলে নিজ চিন্তা ভাবনা ভাগাভাগি করে নিতেন। ছাত্ররা মুগ্ধ হতো। অভয় পেয়ে শিক্ষককে প্রশ্ন করতেন, এমনকি দ্বিমতও! কারণ ডিরোজিও তার ছাত্রদেরকে দ্বিমত ও প্রশ্নে উদ্বুদ্ধ করতেন। এরপর দেখতে পান ছাত্রদের মাঝে কেউ কেউ দারুণ মেধাবী ও প্রতিভাবান। তিনি তাদের মেধা ও প্রতিভার যত্ন নেয়ার জন্য সেবছরই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠন ছিলো বাংলায় মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রথম মঞ্চ। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনকে বঙ্গে প্রগতিশীল সভা সংগঠনের শিকড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মাধবচন্দ্র মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, মহেশচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, গোবিন্দচন্দ্র বসাক, অমৃতলাল মিত্র সহ আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায় অংশ নিতেন। সভাপতিত্ব করতেন ডিরোজিও।
সভার কার্যক্রম শুরুর দিকে বিদেশি সাহিত্য পাঠ ও আলোচনার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো। এর কিছুদিন পর নিজেদের লিখিত প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা শুরু হয়। এসব প্রবন্ধের বেশিরভাগ ছিলো হিন্দু ধর্মের সমালোচনা ও সমাজ সংস্কার বিষয়ক। এরকম কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা দেখে প্রতিদিন শ্রোতার আসনে সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। তরুণদের পাশাপাশি প্রবীণরাও অংশ নিতে শুরু করেন। শ্রোতার আসনে স্থানীয় ভারতীয়দের সাথে ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশি মুখ শোভা পেতে থাকে। বিদেশি মুখের মাঝে শিক্ষা প্রসারক ডেভিড হেয়ার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডওয়ার্ড রায়ান, ডেপুটি গভর্নর মিস্টার বার্ড, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের ব্যক্তিগত সচিব কর্নেল বেনসন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর মিলস অন্যতম।
অর্থাৎ পুরো বিষয়টা জমে উঠেছে। দু’দিক হতে। প্রগতিশীল চিন্তার মানুষরা বাঙালি ছেলেদের মাঝে গভীর চিন্তাবোধের দেখা পেয়ে অত্যন্ত খুশি। আবার পূর্ব পুরুষদের ধর্ম ও সমাজের সমালোচনা দেখে পুরাতনবাদীরা বিশেষভাবে শংকিত। শহরজুড়ে মৃদুমন্দ আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। যে যার মত করে ইয়ং বেঙ্গলের পক্ষে ও বিপক্ষে যেতে থাকেন।
শুরুর দিকে শহরের মানিকতলার একটি বাড়িতে সভা হলেও পরে কখনো ডিরোজিওর বাড়িতে আবার কখনো ছাত্রদের বাড়িতেও সভা অনুষ্ঠিত হতো। সভার পাশাপাশি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইয়ং বেঙ্গলের প্রথম পত্রিকার নাম Ethenium. এই মাসিক পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ডক্টর উইলসন। ইথেনিয়াম পত্রিকার মূল কাজ ছিলো হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করে লেখালেখি প্রকাশ করা। প্রথম সংখ্যায় মাধবচন্দ্র মল্লিক নামে এক ছাত্র হিন্দু ধর্ম নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে এক জায়গায় লিখেন ‘If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism.’ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য ‘হিন্দুইজম’ শব্দটির স্রষ্টা রাজা রামমোহন রায়।
এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর শিক্ষিত হিন্দু সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। একজন বিদেশীর প্ররোচনায় স্বদেশী ধর্মকে আক্রমণ করছে কিছু বাঙালি ছোকরা, এটা মেনে নিতে পারেননি তারা। শুরুর দিকে ইয়ং বেঙ্গলের সাথে যুক্ত ছাত্রদের বাসায় নালিশ পাঠানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও শেষেরদিকে হিন্দু সমাজের প্রতিক্রিয়া আরো কঠিন রূপ নেয়।
কিন্তু বিপদের বিষয় হলো, নালিশে কোন কাজ হয় না। এমনকি এই ছেলেদেরকে মা বাবা জোর করে পূজার ঘরে নিয়ে গেলে সেখানে বসে মন্ত্র না পড়ে হোমাদের সাহিত্য পড়তো তারা। নালিশ ও বিচার ঘরেই মারা পড়ে। ঘরের বাইরে এসে আগের চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চারণে সংস্কারের আওয়াজ তোলে তারা। সংস্কারের ক্ষেত্রে ইয়ং বেঙ্গল যেসব খাতে গুরুত্ব দিয়েছে, সময় বিচারে তা দারুণভাবে অসাধারণ।
হিন্দু সমাজের বিশ্বাস ও ভক্তির উপর আক্রমণ করে ইয়ং বেঙ্গল যা যা বলতোঃ
- শনিবার যাত্রা অনুচিত, কথাটি সত্য নয়।
- ওলাউঠা রোগে শীতলা পূজা দিয়ে কোন লাভ হয় না।
- নিচু জাতির সংসর্গ বর্জন করা উচিত, এমন ধ্যান ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়।
- শাস্ত্রবচন মাত্রই মান্য করা উচিত, এটি খুবই বাজে কথা।
- মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া উচিত নয়, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে।
ডিরোজিও তাঁর অনুসারীদের শিখিয়েছিলেন কী করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তুলতে হয়, বিকশিত করতে হয়। শিখিয়েছেন কী করে মানুষকে সমাজ-সংগঠনের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হয়। ছাত্রদেরকে জ্ঞানানুরাগী হতে এবং যে কোনো অন্ধবিশ্বাস পরিত্যাগ করতে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার পুঁজি ছিল ইতিহাস আর দর্শন। ডিরোজিও একটা উপদেশই সবসময় দিতেন, ‘সত্যের জন্য বাঁচো, সত্যের জন্য মরো’। শিক্ষকের যুক্তির আলোয় আলোকিত হয়ে উপরে উল্লেখিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মিথ্যা ভক্তির উচ্ছেদে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করে তার শিষ্যরা।
সে সময় কলকাতা সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষীদের তামা, তুলসি ও গঙ্গাজল স্পর্শ করে শপথ গ্রহণ করতে হতো। একবার এক মামলায় সাক্ষী হিসেবে আদালতে আসে রসিককৃষ্ণ মল্লিক নামে গোঁফ না গজানো এক বালক। উড়িষ্যা থেকে আগত ব্রাহ্মণ যখন তাম্রকুন্ড নিয়ে সাক্ষীকে শপথ পড়াতে গেলেন, সাক্ষী শপথ নিতে রাজি হন না। বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? বালকের জবাব, ‘আমি গঙ্গার পবিত্রতা বিশ্বাস করি না, মানি না।’ সবাই প্রথমে ভাবলেন ভুল শুনেছেন, কিন্তু ব্রাহ্মণ যখন পুনরায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনালেন, আদালত ভর্তি লোকজনের তখন কানে হাত। কী বলে এই বালক!
ইয়ং বেঙ্গল এমনই ছিলো। ভয় ডরহীন স্বচ্ছ চঞ্চল তারুণ্য। যুক্তি ও সত্য উপস্থাপনে আগে পিছে কিছু চিন্তা করতো না। সত্য প্রকাশে কার ক্ষতি হবে, কার অনুভূতি আক্রান্ত হবে, কার রাজনৈতিক অসুবিধা হবে -এমন কোন ভাবনা তাদের মাঝে ছিলো না। বরং তারা নিজেরাই প্রচন্ডভাবে রাজনৈতিক ছিলেন। বঙ্গে যখন উচ্চশিক্ষার সূচনা হয়, তখন তা ছিলো ভয়াবহ মাত্রায় সাম্প্রদায়িক। মুসলমানরা এমনিতেই উচ্চশিক্ষার সূচনাকে স্বাগত জানায়নি, কিন্তু কোন মুসলমান চাইলেও ‘হিন্দু কলেজ’ এ ভর্তি হতে পারতো না। মুসলমান দূরের কথা, উঁচু জাতের হিন্দু ছাড়া অন্যরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতো না। ইয়ং বেঙ্গল শিক্ষার অধিকারে এই উঁচুজাত-নিচুজাত বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছে এবং এই অচলায়তন ভেঙেছে।
কুসংস্কার ও ভ্রান্ত প্রথার পাশাপাশি ইয়ং বেঙ্গলের নজর ছিলো বাংলার মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রতিও। তারা দেখেছে সরকারিভাবে যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়, তা নিতান্তই অপ্রতুল। এজন্য সাধারণ মানুষ বিভিন্ন তান্ত্রিক ও ভুলভাল কবিরাজি চিকিৎসায় প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতা বশতঃ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ইয়ং বেঙ্গল। কলকাতায় একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও উন্নত অটোস্পি প্রযুক্তির ব্যবস্থা করার দাবি তোলে। এমনকি তাদের শত্রুপক্ষ হিন্দু নেতাদের কেউ কেউ এই দাবির পক্ষ নেন। অনেকে পাপের ভয়ে পক্ষ নেননি, কারণ শবদেহ সোজা চিতায় তুলতে হবে, পোস্টমর্টেমের টেবিলে কেন!
কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণদের জ্বালাতন করা, দেখিয়ে দেখিয়ে মদ ও গরুর মাংস খাওয়া ইত্যাদি বিষয় বেশি প্রচার পেতে থাকে। ছাত্রাবস্থায় মদ খাওয়ার রীতি শুরু হয় ডিরোজিওর হাত ধরে। ডিরোজিওর বাসায় যখন ছাত্ররা যেত, তখন রাতের খাবারের সময় টেবিলে ওয়াইন থাকতো। যা তাদের পারিবারিক রীতি ছিলো। কিন্তু ডিরোজিওর এই পারিবারিক রীতি ছিলো তার ছাত্রদের কাছে হিন্দু উত্যক্তের হাতিয়ার। গরুর মাংস ও মুসলমানদের তৈরি রুটি ছিলো আরেকটি হাতিয়ার। হিন্দুদের দেখিয়ে দেখিয়ে গরুর মাংস খেয়ে হাড় চুষতে চুষতে এই মাংসের প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হতো না তারা। পথে ঘাটে ব্রাহ্মণ পেলেই কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতো ‘আমরা গরু খাইগো, গরু খাই!’
ইয়ং বেঙ্গলের মদ খাওয়ার খবর আরো বেশি ছড়াতে থাকে। কারণ ব্রাহ্ম সমাজের অনেকে ইয়ং বেঙ্গল আর মদ খাওয়াকে পাশাপাশি রেখে কথা বলতেন। এর অবশ্য কারণ আছে। ব্রাহ্ম সমাজ ও ইয়ং বেঙ্গলের মাঝে চিন্তার সংঘাত ছিলো। হিন্দুদের কাছ থেকে বহু ইশ্বর কেড়ে নিয়ে রামমোহনের কল্পিত এক ঈশ্বর চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টাকে ইয়ং বেঙ্গল ভন্ডামি ও কপটতা হিসেবে দেখতো। ইয়ং বেঙ্গল হিন্দু ধর্মকে তীব্রভাবে আক্রমণ করতো, ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা তা পছন্দ করতেন না। কিন্তু তারাই আবার খ্রিস্টান ধর্মকে আক্রমণ করতেন। তাই রামমোহনের ব্রাহ্ম সমাজকে ডিরোজিওর শিষ্যরা ‘আধা উদারবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করতেন। তাদের বিরোধ সেই অর্থে দৃশ্যমান ছিলো না। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের কাছে ইয়ং বেঙ্গল মানেই ছিলো মদ ও গোমাংস খাওয়া একটি দল।
ইয়ং বেঙ্গলের বিরুদ্ধে আরো যেসব অভিযোগ ছিলো, তার মধ্যে পশ্চিমাপ্রীতি অন্যতম। দেশীয় সংস্কৃতি দূরে সরিয়ে ভিনদেশী সংস্কৃতি প্রতিস্থাপনের দায় চাপিয়ে দেয়া হয়। আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজি চালু করার প্রশ্নে স্থানীয় হিন্দু নেতারা এর বিপক্ষ থাকলেও ইয়ং বেঙ্গল ছিলো ইংরেজি ভাষার পক্ষে। এমনকি স্থানীয় বাংলা পত্রিকা দেখেও তারা নাক সিঁটকাতেন। এসব পত্রিকাকে হিন্দু ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতো ইয়ং বেঙ্গল। এ কারণে তারা অসাম্প্রদায়িক পত্রিকা প্রকাশে গুরুত্ব দেয় এবং বঙ্গে সংবাদপত্রের বিকাশে ঐতিহাসিক অবদান রাখে। ডিরোজিও মনে করতেন সংগঠন ও পত্রিকা, এই দুটি হলো পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার। এজন্য তিনি সবসময় সংগঠন বৃদ্ধি ও পত্রিকা প্রকাশে গুরুত্ব দিতেন।
সমাজের মানুষের কাছে জ্ঞানের দুয়ার খুলে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা ১৮২৮ থেকে ১৮৪৩ সালের মধ্যে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশ করেন। Ethenium, Parthenon, Hesperus, জ্ঞানান্বেষণ, Enquirer, Hindu Pioneer, Quill এবং The Bengal Spectator অন্যতম। এর মধ্যে জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা দীর্ঘদিন টিকে ছিলো। ১৮৩১ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়। দ্বিবার্ষিক এ পত্রিকার সংগঠক ছিলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক। এর উদ্দেশ্যে ছিল শাসনপ্রক্রিয়া ও ব্যবহারশাস্ত্রে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা।
কিন্তু ইয়ং বেঙ্গলকে প্রতি পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। ঘরের বাধা, বাইরের বাধা, কর্মস্থলে বাধা -ত্রিমুখী বাধার মুখে রেখেও তাদেরকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ঘরে বেঁধে রাখা, পরিবার হতে বের করে দেয়া, চাকরিচ্যুত করার মত অনেক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে ইয়ংম্যানদের। অন্যতম সদস্য রসিককৃষ্ণ মল্লিককে পাগলা গুঁড়ো (অচেতন করার ভেষজ অষুধ) খাইয়ে হাত পা বেঁধে নৌকায় তুলে রাজ্য ছাড়া করতে চেয়েছিলো তার পরিবার। অপরাধ একটাই, হিন্দু ধর্মের গা থেকে মূর্খতার আবরণ উচ্ছেদের চেষ্টা করা। সমাজের চাপের মুখে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার পিতামতহ বাড়ি থেকে বের করে দেন। ডিরোজিওকে তার কর্মক্ষেত্রে শারিরীক আক্রমণের চেষ্টা করা হয়।
এতসব বাধাবিঘ্ন তৈরি করেও তাদের পথ চলা রোধ করা যায়নি। রোধ করতে পারেনি, কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি হিন্দু সমাজনেতারা। সেসময় কলকাতা শহরে বৃন্দাবন ঘোষাল নামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। সকালে গঙ্গাস্নান করে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। শহরের ধনী ব্রাহ্মণদের বাসায় বাসায় গিয়ে ভিক্ষা করতেন। নিচু জাতের বাসায় যেতেন না, যদি জাত চলে যায় -এই ভয়ে হয়তো। তো, ভিক্ষার পাশাপাশি তিনি আরো একটি কাজ করতেন। ধর্মসেবা। আর এখন যেমন ধর্মসেবার সবচে সহজ উপায় ‘নাস্তিকের ফাসি চাই’ বলা, তখন ছিলো ইয়ং বেঙ্গলকে গালি দেয়া। এই ব্রাহ্মণ ভিক্ষুক ভিক্ষা করতে গিয়ে ঘরে ঘরে ইয়ং বেঙ্গলের নামে নিন্দা পৌঁছে দিতেন।
ব্রাহ্মণ ভিক্ষুকের কল্যাণে ও অন্যান্য কারণে হিন্দু সমাজ ডিরোজিওর বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। প্রথমে কলেজের প্রধান শিক্ষককের উপর চাপ দেয়া হয় তার অন্য শিক্ষকরা যেন শ্রেণীকক্ষে অথবা শ্রেণীকক্ষের বাইরে ছাত্রদের সাথে ধর্ম নিয়ে কথা না বলে। নেতাদের কথামত হেডমাস্টার তাই করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ধর্ম নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছেই। তাই হিন্দু নেতারা এবার শক্তভাবে পরিকল্পনা করে কলেজের গোঁড়া হিন্দু ছাত্রদের ব্যবহার করে ডিরোজিওর নামে বিচার সভার আয়োজন করে। বিচারক ছিলেন প্রাচীনপন্থী হিন্দু নেতা রাধাকান্ত দেব। তিনি কলেজ পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ছিলেন। ডেভিড হেয়ার ও ডক্টর উইলসনসহ কয়েকজন শুভাকাঙ্খী ডিরোজিওর পক্ষে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কারণ বিচারের রায় আগেই ঠিক করা ছিলো। রায়ে ডিরোজিওকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। খবর পেয়ে পদচ্যুত হবার আগে নিজেই পদত্যাগ করেন।
কলেজে শিক্ষকতা ছাড়ার পর বসে থাকেননি লিডার অব ইয়ং বেঙ্গল। ‘দ্যা ইস্ট ইন্ডিয়া’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করে সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এবার আর তাকে পদচ্যুত করার সুযোগ নেই। নিজের পত্রিকা থেকে কে তাকে বরখাস্ত করবে! ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়া’য় আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ও জোরালো লেখালেখি করতে থাকেন। সাথে ছিলো তার ছাত্ররাও। সবাই মিলে হিন্দু ধর্মের পোস্টমর্টেমের কাজে খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। কিন্তু খুব বেশিদিন ব্যস্ত থাকতে পারেননি। দূরারোগ্য ওলাউঠা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ডিরোজিও মারা যান।
তার মৃত্যু ছিলো প্রগতিশীলদের কাছে বিষাদের, আর গোঁড়াদের কাছে স্বস্তির। হিন্দু নেতারা ভেবেছে এবার বুঝি ইয়ং বেঙ্গল নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যাবে। অথবা তারে শোকে মূর্ছা গিয়ে শক্তি হারাবে। কিংবা অন্ততপক্ষে একটা ঘোর ঝিমুনিতো আসতেই পারে। কিন্তু এসবের কিছুই ঘটেনি। অন্যকিছু ঘটেছে।
ডিরোজির মৃত্যুর পর ইয়ং বেঙ্গল প্রথম ধাক্কা খায় ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনায়। ১৯৩২ সালের ২৮ আগস্ট Inquirer পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ডিরোজিওর ছাত্র মহেশচন্দ্র ঘোষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। একই বছর ১৭ অক্টোবর আরেক শিষ্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। শহরের সবাই জানতো ডিরোজিও এবং তার ছাত্ররা সবাই নাস্তিক। এমনকি রামমোহনের একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মকেও তারা কটাক্ষ করতো। সেক্ষেত্রে হঠাৎ করে ত্রিশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় সবাই অবাক হয়েছে বৈকি।
মহেশচন্দ্রের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের কারণ খুঁজে না পেলেও কৃষ্ণমোহনেরটা মোটামুটিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তাকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ‘খ্রিস্টান’ অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। পৈত্রিক ভিটে ছাড়তে হয়েছে। এক পর্যায়ে চরম অর্থকষ্টেও পড়তে হয়েছে। তাই তার আত্মীয় স্বজন ও সমাজের মনে আঘাত দেয়ার জন্য তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে এর ফলে কিছুটা ক্ষমতাবানও হয়েছিলেন। তবুও, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কৃষ্ণমোহন হঠাৎ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রগতিশীলরা ভালোচোখে দেখেনি। কারণ তিনি নিজে ধর্মান্তরিত হয়ে ক্ষান্ত হননি, সাথে আরো অনেককে নিয়ে গেছেন। অবশ্য মহেশচন্ত্র ও কৃষ্ণমোহন ব্যতীত ডিরোজিওর আর কোন ছাত্র সম্ভবত নতুন কোন ধর্ম গ্রহণ করেনি।
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিলো ইয়ং বেঙ্গলের ধারাবাহিক দাবির ফসল। মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর শবব্যবচ্ছেদ বিষয়ে প্রচলিত সংস্কার ভেঙে ফেলার জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করে ইয়ং বেঙ্গল। ১৮৩৮ সালে তাদের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে আরো একটি সংগঠন। ‘সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’। তারাচাঁদ চক্রবর্তী ছিলেন এ সোসাইটি-র সভাপতি এবং প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী ছিলেন এর সম্পাদক। মূলত পত্র মাধ্যমে একের সাথে অপরের চিন্তা ভাবনা ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য এই সংগঠনের জন্ম।
ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের দমিয়ে রাখতে তাদেরকে সমাজচ্যুত করার চেষ্টাসহ পারিবারিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। এসব বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইয়ং বেঙ্গল এগিয়ে গিয়েছে। ১৯৩৮ সালে তারা প্রকাশ করে ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকায় প্রকাশিত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর রচনাবলি থেকে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিদ্যমান ছিলো। তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রকাশিত কুইল পত্রিকাটিও সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলো। এই পত্রিকার লেখাসমূহে ইউরোপীয় ও ভারতবাসীর মধ্যকার রাজনৈতিক বৈষম্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ পায়।
ইয়ং বেঙ্গল কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের মধ্যে সম্ভবত ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ ছিল সর্বশেষ। ১৮৪২ সাল থেকে প্রকাশিত এ মাসিক পত্রিকাটি সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে লেখা প্রকাশ করে। এই পত্রিকাটি তিন কারণে বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।
প্রথম কারণ বিধবা বিবাহ। বাংলায় বিধবা বিবাহ নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা বা তর্কের ধারাবাহিক আয়োজন করে বেঙ্গল স্পেক্টেটর। ফলে এ বিষয়ে সমাজে আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বিধবা বিবাহ নিয়ে ভ্রান্ত ধ্যান ধারণা বিলোপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমরা সবাই জানি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু শুরুটা হয় ইয়ং বেঙ্গলের হাত ধরে।
দ্বিতীয় কারণ নারী শিক্ষা। আগেই উল্লেখ করেছি উচ্চ শিক্ষায় জাত বৈষম্য নিয়ে ইয়ং বেঙ্গল কাজ করেছে। একসময় তারা নারী শিক্ষার পক্ষেও কথা বলতে শুরু করে। বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক-আলোচনার আয়োজন করা হয়। ১৮৩৪ সালের হিসাব অনুযায়ী কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদসহ কয়েক জায়গায় মোট ১৯টি বালিকা বিদ্যালয়ে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতেন। কিন্তু তাদের সবাই ছিলেন খ্রিস্টান। এবং স্কুলগুলো খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয়। মূল জনগোষ্ঠীর সাথে এর কোন সম্পর্ক ছিলো না।
বালিকাদের জন্য প্রথম অসাম্প্রদায়িক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন জন এলিয়ট বিটন নামের বাঙালি হিতৈষী ব্রিটিশ রাজকর্মচারী। যিনি বঙ্গদেশে বেথুন সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। বেথুন সাহেব স্কুল প্রতিষ্ঠার পর সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কট্টর হিন্দু নেতা হিসেবে পরিচিত রাধাকান্ত দেব, ব্রাহ্ম সমাজের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইয়ং বেঙ্গলের রামগোপাল ঘোষ —সবাই নারীশিক্ষার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হন। শুরু করেন নিজের পরিবারের স্ত্রী ও কন্যাদের স্কুলে পাঠানোর মাধ্যমে।
তৃতীয় যে কারণে বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকাটি ঐতিহাসিক, তা হলো সাহিত্য। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর খসড়া এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র, যিনি বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকার একজন সম্পাদক ছিলেন। অপর সম্পাদক ছিলেন রাধানাথ শিকদার।
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ইয়ং বেঙ্গল অবদান রেখেছে। এবং পরিবর্তন যেন টেকসই হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতেন তারা। কলকাতাবাসীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় সম্পৃক্ত করতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় গণপাঠাগার নির্মাণে অবদান রাখেন তারা। এই কাজ করতে গিয়েও অপবাদ গায়ে মাখতে হয়। পাঠাগারে বিদেশী বই রাখার কারণে প্রগতিশীল শ্রেণীর অনেকে তাদের সমালোচনা করে।
প্রগতিশীল শ্রেণীর সমালোচনায় ক্ষতি ছিলো না। যুক্তি ধরে জবাব দেয়া যেত। তাদের সমালোচনা যৌক্তিক হলে নিজেদের শোধরানো যেত। কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের দুষ্ট বুদ্ধির বিরোধিতা মোকাবেলা করা বেশ কঠিন ছিলো। কোন যুক্তির ধারে কাছে না গিয়ে সারাদিন শুধু ‘ধর্ম গেলো’ ‘ধর্ম গেলো’ বলে চিৎকার করত তারা।
ইয়ং বেঙ্গলের দর্শন বুঝার চেষ্টা করলে দেখা যাবে, তারা হিন্দুধর্মকে আঘাত করেননি, জিজ্ঞাসা করেছেন; কিছু অযৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। তারা ধর্মের নৈতিকতার মধ্যে লোক-বিশ্বাস আছে বলে সন্দেহ পোষণ করতেন। এবং এসব লোকবিশ্বাস বর্জনের আহবান জানিয়েছেন। যুক্তিহীন শাস্ত্রবচন, ক্ষতিকর লোক-বিশ্বাস আর ধর্মীয় গোঁড়ামি কি বঙ্গসংস্কৃতির অংশ? সংস্কৃতির অংশ হলেও তা বর্জন করা উচিত।
ইয়ং বেঙ্গলদের শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়া মিশনস বইয়ের লেখক আলেকজান্ডার ডাফ লিখেছেন-
দেয়ার থিওরি ওয়াজ, দ্যাট, আ প্রফেসিং ইনকোয়ারিজ আফটার ট্রুথ। অর্থাৎ, ইয়ং বেঙ্গলদের চিন্তা ছিল সত্য অনুসন্ধান করা, নিজেকে হীন ভাবা নয়।
ইয়ং বেঙ্গলের চরিত্র সম্পর্কে ‘লাইফ অব ডিরোজিও’ বইয়ের লেখক এডোয়ার্ড টমাস বলেন,
ইনডীড, দ্য কলেজবয় ওয়াজ আ সিনোনিম ফর ট্রুথ। অর্থাৎ, বাস্তবিকপক্ষে ইয়ং বেঙ্গল সত্যের প্রতিশব্দ।
ইয়ং বেঙ্গল ছিলো বাংলার ইতিহাসে সবচে বেশি অপবাদ হজম করা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। প্রগতিশীল অংশ তাদেরকে অপবাদ দিয়েছে ইংরেজ তোষণের। কারণ তারা ইংরেজি শিক্ষা ও ইউরোপীয় পূনর্জাগরণের চিন্তা আমদানিতে গুরুত্ব দিতেন। অথচ ইংরেজ ঔপনিবেশিক শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইয়ং বেঙ্গলরা সবসময় সোচ্চার ছিল। কোন এক ইংরেজ ভারতবর্ষকে অসভ্য ও বর্বর বলেছে। প্রতিবাদে ইয়ং বেঙ্গল বলছে-
কোন অধিকারবলে ইংরেজরা এ দেশকে বর্বর ও অসভ্য বলে? শুধু ইংরেজদের এ দেশ জয় করার আগে থেকে নয়, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষ ছিল শিল্পসমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী একটি দেশ। আমেরিকা যেমন দাসত্বের শিকল ছিঁড়ে আজ উন্নত একটি দেশ, ভারতবাসীও তার পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করতে পারলেই এ দেশের চিত্তমুক্তি ও শ্বাসমুক্তি ঘটবে এবং সমস্ত গ্লানি ও দুর্গতির অপনোদন হবে।
– ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল, ফেব্রুয়ারি, ১৮৩১
ইয়ং বেঙ্গলের সবচেয়ে শক্তিশালী বক্তা জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার সম্পাদক রসিককৃষ্ণ মল্লিক ইংরেজ শাসনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ১৯৩৫ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতার টাউন হলের এক প্রতিবাদ সভায় বলেন-
গরিব ভারতবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ কেন কেড়ে নেওয়া হবে? তারা নিরন্ন ও অর্ধ উলঙ্গ থাকবে, আর বিদেশি শাসনের ও বিজাতীয় ধর্মের সাহায্য কীর্তনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করা হবে কেন?
– বেঙ্গল হরকরা, ক্রোড়পত্র, কলকাতা, ৬ জানুয়ারি, ১৮৩৫।
১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ বছরের ছাত্র কৈলাশচন্দ্র লেখেন, ‘শতবর্ষ পরে তোমার কল্পনার ভারতবর্ষ।’ এতে তিনি বলেন, মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য একদিন তরুণ বাঙালি নেতা জল্লাদের হাতে প্রাণ দেবে। (ক্যালকাটা লিটারেরি গেজেট, ৬ জুন, ১৮৩৫)। সারদাপ্রসাদ ঘোষের নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গল ১৮৪১ সালে গড়ে তোলে আধা রাজনৈতিক সংগঠন ‘দেশ হিতৈষণী সভা’। এর মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করা। (ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল, নভেম্বর ১৮৪১)
কৃষ্টদাস পাল ‘Young Bengal Vindicated’ শীর্ষক লিখিত ডিসকোর্সে ইয়ং বেঙ্গল সম্পর্কে বলেছেন-
The blood that boiled within them when in the May flush of youth, having become cool, they have sobered themselves down in their literary habits. They are now the zealous advocates of Bengali.
ইয়ং বেঙ্গলের এই সামাজিক আন্দোলন নিরঙ্কুশ সফল আন্দোলন। তৎকালীন ‘গড়ি দেশ, ধরে ধর্মের বেশ’ সমাজে ইয়ং বেঙ্গলের কর্মকাণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি করলেও কুসংস্কারাচ্ছিত ভঙ্গুর সমাজে তার প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। বিশেষত বাংলা ভাষায় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা, বিতর্কসভা, গ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন ইয়ং বেঙ্গলরা।
এমনকি ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণেও তারা ছিলো সবার আগে। ভারতে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা গভর্নর জেনারেল হেনরি হার্ডিঞ্জ ও ডেভিড হেয়ারের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ইয়ং বেঙ্গল। সমাজ উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর অবদান রেখেছে এমন আন্দোলন ইয়ং বেঙ্গল ব্যতীত আর দ্বিতীয়টি নেই। ইয়ং বেঙ্গলই বাংলায় মুক্তচিন্তার অবারিত দুয়ার খুলে দিয়েছিলো। বর্তমানে এ অঞ্চলে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির যে ঢেউ জেগেছে, তার সূচনা হয়েছিল ইয়ং বেঙ্গলের হাত ধরে।
তথ্যসূত্র
১. বাংলাপিডিয়া
২. আনন্দবাজার পত্রিকা।
৩. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ —শিবনাথ শাস্ত্রী
৪. Henry Derozio: The Eurasian Poet, Teacher and Journalist —THOMAS EDWARDS
৫. ঝড়ের পাখিঃ কবি ডিরোজিও —পল্লব সেনগুপ্ত
৬. বাংলার রেনেসাঁ —অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
৭. বিদ্রোহী ডিরোজিও —বিনয় ঘোষ