আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো
দ্বিগুণ আমরা হয়েছি। প্রতি ফাল্গুণেই দ্বিগুণ হয়ে আমরা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করছি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৭১ সালে দেশ করেছি পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত। এমন দ্বিগুণ হতে হতে একসময় এই উদ্ধৃতির সৃষ্টিকর্তাকেই হারিয়ে ফেললাম। বলছিলাম বাংলা ক্ষণজন্মা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের কথা। যার অন্তর্ধানের কষ্ট আজও বুকে চেপে আছে বাংলাদেশ।
মাত্র ৩৬ বছরের জীবদ্দশায় চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতায় নিজের প্রবল উপস্থিতির সাক্ষর তিনি রেখে গেছেন। জহির রায়হান ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিল্পী। সৃষ্টির প্রেরণায় প্রবলভাবে দায়বদ্ধ একজন মানুষ হিসেবে আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামী অভিযাত্রার প্রতিটি পর্যায়ে আলো হাতে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিলেন তার সৃষ্টি এবং কর্মের মধ্য দিয়ে।
চলচ্চিত্রের প্রতি জহির রায়হানের বিশেষ ঝোঁক পাওয়া যায় তার সব সাহিত্যকর্মেই। এ কারণে তার সব সাহিত্যই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো কাট-ছাঁট বুননে লেখা। হয়তো তার ইচ্ছে ছিলো, এ সব লেখাকে পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার।
জহির রায়হান বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন।
১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়, উদ্দেশ্য ২১শে ফেব্রুয়ারীর হরতালকে পন্ড করা। রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ অমান্য করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাস্তায় মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই তৈরি হলো ঐতিহাসিক “দশজনী মিছিল”। সর্বপ্রথম যেই দশ জন ছাত্র মিছিল বের করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন জহির রায়হান।
অদম্য সাহসী এই কীর্তিমানের সাহিত্যিক ও কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে ‘যুগের আলো’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। পরবর্তীতে প্রবাহ, এক্সপ্রেস, খাপছাড়া, যাত্রিক, সিনেমা, সমকাল, চিত্রালী, সচিত্র সন্ধানীসহ বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন।
ফটোগ্রাফি শিখতে জহির রায়হান ১৯৫২তে পাড়ি জমান কলকাতায় প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল স্কুলে। যদিও অর্থাভাবে দশ মাসের কোর্স তাকে ছয় মাসের মাথায় জলাঞ্জলি দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু এই কোর্স করতে গিয়েই তিনি তার নতুন এক শিল্পীসত্ত্বা খুঁজে পান; আর তা হলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা।
১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়, ১৯৬০ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের আগেই ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জাগো হুয়া সাবেরা’র চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে যুক্ত হন তিনি। ছবিটির পরিচালক ছিলেন এ জে কারদার। এরপর পরিচালক সালাউদ্দীনের ‘যে নদী মরুপথে’ চলচ্চিত্রেও সহকারি হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাঁকে ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। এ চলচ্চিত্রের নামসঙ্গীত রচনাও করেছিলেন জহির রায়হান।
জহির রায়হান মজুপুর গ্রামে আমিরপুর হাই স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও পরের বছর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। যদিও পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে চলচ্চিত্রের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিলো জহির রায়হানের।
জহির রায়হানের চলচ্চিত্র নির্মাণ স্বপ্নের পূর্ণতা পায় ১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ ছবির মাধ্যমে। এ ছবিতে পূর্ণাঙ্গ পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মিত হয় জহির রায়হানের পরিচালনার মধ্য দিয়ে। পরের বছরই তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি পায়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কাঁচের দেয়াল’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এবং তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার হিসেবে পুরস্কার পান। সে উৎসবে সর্বোচ্চ সংখ্যক পুরস্কারও তিনি পেয়েছিলেন। বিভিন্ন কারণেই একসময় তিনি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা তৈরি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সত্তরের জানুয়ারিতে তিনি নিজেই বলেন:
“এ বছরের মধ্যে নতুন ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করতে না পারলে আপন বিবেকের কাছে প্রতারক সাব্যস্ত হব। এই সময় আমার আর্থিক সংকট ছিল বলে সৃজনশীল ছবির বদলে বাণিজ্যিক ছবির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এখন সে সামর্থ্য এসেছে। তাই আমার স্বপ্ন–সাধ নিয়ে ছবি তুলবার সময় উপস্থিত।”
‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রকে জহির রায়হান উল্লেখ করেছেন তার এই স্বপ্ন-সাধের একটি চলচ্চিত্র। ভাষা আন্দোলন যে তার জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই চলচ্চিত্রে। আরেক চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ‘জীবন থেকে নেয়া’র স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন-
“জহির রায়হান একদিন তাকে ডেকে একটা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে বললেন। গল্পটা হবে এমন যেখানে এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াবে। আমিও শুরু করে দিলাম। তবে প্রথম দৃশ্যটা ছিল এ রকম– এক বোন আরেক বোনকে দুধভাত খাওয়াচ্ছে। জহির রায়হান জিজ্ঞেস বললেন, “খাওয়াতে বললাম বিষ, আর খাওয়াচ্ছেন দুধ।” আমি বললাম, “আরে, দুধ না খাওয়ালে বিষ খাওয়াব কীভাবে?”
সিনেমার কাহিনি একটা পরিবার নিয়ে। ভাইবোন, ভাইয়ের বউ, বোন-জামাই আর একটা চাবির গোছা– এই নিয়েই সে পরিবার। কিছুক্ষণ পর সেই পরিবারই হয়ে ওঠে ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র।’ সিনেমার নাম প্রথমে ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’ রাখার কথা ছিল। মাঝপথেই জহির রায়হান নাম পাল্টে দিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’।
ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। সেন্সর জটিলতার দরুণ ওই দিন মুক্তি না পেয়ে পায় পরদিন– ১১ এপ্রিল। নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তি না দেওয়াতে জনগণ আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। ‘জীবন থেকে নেয়া’ খুব সম্ভবত একমাত্র চলচ্চিত্র যার মুক্তির জন্য হাজার হাজার মানুষ মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছে।
নিজে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই তার সাহিত্যকর্মে ভাষা আন্দোলন এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন:
“জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যাঁর উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন…। যদি বায়ান্নর একুশ না ঘটত তবে জহির রায়হান হয়ত কথাশিল্পী হতেন না।”
‘আরেক ফাল্গুন’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘মহামৃত্যু’ এবং ‘একুশের গল্প’ সেই সত্যতার প্রমাণ দেয়। এ জন্যেই বোধহয় ছবির শুরুতেই প্রভাত ফেরীর বাস্তব দৃশ্যেটা এতটা অতুলনীয়। খান আতাউর রহমানের সঙ্গিতায়োজনে করা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…” এখনও আমাদের প্রভাত ফেরীর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে, থাকবেও।
ছবিটি শেষ হয়েছিল এক নবজাতককে দিয়ে, নাম ‘মুক্তি’; এ যেন আমাদের মুক্তির আগাম বার্তা!
১৯৬৫ সালে জহির রায়হান তার উপন্যাস “আর কতদিন” অবলম্বনে “Let Their Be Light” নামে একটি ছবি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। জহির রায়হানের ইচ্ছে ছিল, ছবিটি নির্মিত হবে ইংরেজি ভাষায় এবং ডাব করা হবে বাংলা, উর্দু, রুশ এবং ফরাসি ভাষায়। উর্দু এবং ইংরেজি সংলাপ লিখেন কবি ফয়েজ আহমেদ, রুশ সংলাপ লিখবেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রুশ ঔপন্যাসিক মিখাইল শলোকভ। জহির রায়হান এই ছবির কাজ শুরু করেন ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে। ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ (বর্তমান রূপসী বাংলায়)। শুটিং শুরু হবার অল্প কিছুদিন পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। দেশ মাতৃকার টানে ছবি অসমাপ্ত রেখে তিনি চলে যান ভারতে।
৫২, ৬৯ এর মত এবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন জহির রায়হান। তবে এবার প্রতিবাদ শুরু করেন ক্যামেরার মাধ্যমে। বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার চিত্র ধারণ করে। নির্মাণ করেন “Stop Genocide”। এই ছবিটির ধারা বর্ণনা করেন আরেক পরিচালক আলমগীর কবির। ১৯৭১ সালে কলকাতায় জীবন থেকে নেয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। নিজে সে সময় চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও, প্রদর্শনী থেকে পাওয়া সমস্ত অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন। তার সহায়তায় নির্মিত হয় আরও দুটো তথ্যচিত্র। Innocent Million (বাবুল চৌধুরী) ও Liberation Fighters (আলমগীর কবীর)। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে এসে সম্পন্ন করেন তার আরেকটি তথ্যচিত্র A State Is Born-এর কাজ।
জহির রায়হান ১৯৬১ সালে নায়িকা সুমিতাদেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দু’সন্তান বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে তিনি নায়িকা সুচন্দাকে বিয়ে করেন। এ পরিবারেও তার দু সন্তান – অপু রায়হান ও তপু রায়হান।
যুদ্ধ শেষে জহির রায়হান দেশে ফেরেন ১৮ ডিসেম্বর। আসার পথে বাঙালির বিজয়োল্লাস রুপালি ফিতার মধ্যে বন্দি করছিলেন। ঢাকাতে নেমেই চলে যান ক্যান্টনমেন্টে; পাকিস্তানিদের আত্নসমর্পনের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ তখন কে একজন তাঁকে জানাল– “বাড়ির খবর কিছু জানেন, আপনার বড়দা ১৪ তারিখ থেকে নিখোঁজ। রাজাকার আলবদররা ওঁকে ধরে নিয়ে গেছে।” ক্যামেরাটা সহকারীর হাতে দিয়ে তখনই রওয়ানা দেন বাড়ির দিকে।
১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর ১১১০ জন বুদ্ধিজীবীর সাথে নিখোঁজ হওয়া সহোদর শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে পাগলপ্রায় হয়ে যান জহির রায়হান। এজন্যে বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এশতেহাম হায়দার চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ, ড. সিরাজুল ইসলামসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবী এর সদস্য ছিলেন। এই কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে জহির রায়হান আলবদর ও রাজাকারদের অনেক গোপন তথ্যও উদ্ধার করেছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে কারা জড়িত ছিলেন এবং হত্যাকারীদের অনেকেরই গোপন আড্ডাখানা সম্পর্কেও তথ্য উদ্ঘাটন করেছিলেন জহির রায়হান। শহীদুল্লাহ কায়সারকে যে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই খালেক মজুমদারকে ধরিয়েও দিয়েছিলেন।
বড়দাকে খুঁজতে একজন জাপানি রেডক্রস কর্মীর সাহায্যে মিরপুরের কয়জন বিহারি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। রেডক্রস কর্মীর ভাষ্য অনুযায়ী, এই ডাক্তাররা ছিলেন নিরপেক্ষ এবং ভালো। তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ব্যাপারটা দেখবেন এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে এ রকম আরও অনেক অনুরোধ তাদের কাছে আসছে।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে টেলিফোনে তিনি খবর পান যে মিরপুরের ১২ নম্বরে শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। যে বড়দা তার ‘প্রেরণার মূল শক্তি’ সেই বড়দার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন জহির রায়হান। টেলিফোনে খবর পাওয়ার পরই জহির রায়হান পরিচিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে মিরপুরের দিকে রওয়ানা দেন। পরনে ছিল ছাই রঙয়ের প্যান্ট আর গাঢ় ঘিয়ে রঙের কার্ডিগান। সাদা রঙের শার্টের সঙ্গে পায়ে ছিল স্যান্ডেল। শাহরিয়ার কবিরও সেদিন সঙ্গে ছিলেন। তার ভাষায়:
“সেদিন আমরা যখন টেকনিক্যালের মোড় ঘুরে বাংলা কলেজের কাছে গিয়েছি তখনই উত্তর দিক থেকে আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষিত হয়েছিল। জহির রায়হান প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চালিয়ে ছয় নম্বর সেকশনে এসেছিলেন। মিরপুরে তখন কারফিউ। টেকনিক্যালের মোড়ে গাড়ি আটকানো হয়েছিল। গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধা দেখেই হোক কিংবা জহির রায়হানের কথা শুনেই হোক পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকায়নি। আটকেছিলেন ছয় নম্বর সেকশনের পুলিশ ক্যাম্পে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা।”
উল্লেখ্য, সেনাবাহিনি তখন ১২ নম্বর সেকশনের রেইড করার জন্যে যাচ্ছিল, তারা কোনো সিভিলিয়ান সঙ্গে রাখতে চায়নি। অনেক অনুরোধের পর জহির রায়হানকে নিতে রাজি হয়েছিল।
আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে বিহারিরা আশেপাশের বাড়িঘর থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রসহ হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কেউ এই হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাই পাল্টা আক্রমণের কোনো সুযোগ পাননি তারা। ওই দিন বিকালে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনী মিরপুরে ১২ নং সেকশনের ওপর আবারও আক্রমণ চালায়। পরদিন সকালে পুরো একটা ব্যাটালিয়ন ১২ নং সেকশনে প্রবেশ করে, কিন্তু কোনো পুরুষ মানুষকে খুঁজে পায়নি। রাতেই সবাই পালিয়ে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, সেদিন সকালের বিহারিদের অতর্কিত হামলায় ৪২ জন সেনাসদস্য নিহত হন। ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ও নায়েক আমিরসহ কয়েকজন আহত হন। নিহতদের মাত্র ৩-৪ জন ব্যতীত আর কারও লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি মিরপুর পুরো জনশূন্য করার পরও। খুব সম্ভব ৩০ জানুয়ারি রাতেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। রাতের অন্ধকারে বিহারিদের সরিয়ে ফেলা সেই লাশগুলোর সঙ্গে বড়দাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান আমাদের জহির রায়হান।
তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার বাসায় পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবু সাইদ চৌধুরী বলেছিলেন, “স্বাধীন দেশে এমন একজন ব্যক্তিকে হারালাম, যাঁকে এখন আমাদের বেশি করে প্রয়োজন। যা ঘটল– এ আমাদের সকলের ব্যর্থতা।”
পত্রপত্রিকায় জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়ার খবর বেরোতে লাগল। অনেকগুলো নতুন সিনেমা বানানোর কথা ছিল তার। ভাষা আন্দোলন নিয়েও একটা সিনেমা বানানোর কথা ছিল। নামও দিয়েছিলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ।
কিছুই করা হল না। হারিয়ে গেলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে সেপ্টেম্বর জুলফিকার আলী মানিকের প্রতিবেদন “নিখোঁজ নন, গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান” প্রকাশিত হয়। সেবছর সাপ্তাহিক ২০০০-এ পুত্র অনল রায়হান “বাবার অস্থি’র সন্ধানে” নামে একটি প্রতিবেদন লিখেন। সমাধান হয় জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যের। জানা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের এই প্রবাদ পুরুষ।
তথ্যসূত্রঃ
বিডিনিউজ২৪
বাংলাপিডিয়া
ঢাকাট্রিবিউন
কপিরাইট সংক্রান্ত অনুরোধঃ
এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।