মুক্তচিন্তা আন্দোলনস্বতন্ত্র ব‍্যক্তিত্বহুমায়ুন আজাদ । জ্যোতির্ময় সমালোচক

হুমায়ুন আজাদ । জ্যোতির্ময় সমালোচক

অতঃপর একজন মানুষ এলেন যিনি ভয়ের অন্ধকার কাটিয়ে, বাধার প্রাচীর ভেঙে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে আমাদেরকে টেনে বের করে আনলেন। তিনি হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্পষ্টবাদী, সমালোচক, যুক্তিবাদী লেখক ও চিন্তাবিদ।

হুমায়ুন আজাদ । জ্যোতির্ময় সমালোচক

অতঃপর একজন মানুষ এলেন যিনি ভয়ের অন্ধকার কাটিয়ে, বাধার প্রাচীর ভেঙে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে আমাদেরকে টেনে বের করে আনলেন। তিনি হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্পষ্টবাদী, সমালোচক, যুক্তিবাদী লেখক ও চিন্তাবিদ।

বঙ্গে যখন মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হয়, এর সবটুকু আলো ছিলো পশ্চিমবঙ্গ তখা কলকাতাকে ঘিরে। পূর্ব বাংলা বা ঢাকায় এই আলো পৌঁছাতে লেগে যায় একশ বছরেরও বেশি সময়। তাও খুব সতর্ক পায়ে, ভীরুমনে, আড়ালে আবডালে একটু একটু করে। আমূল বদলে যাওয়ার জন্য যতটা আলো দরকার, তা ছিলো না। একটা দরজা বন্ধ ঘরে সামান্য খুলে রাখা জানালা দিয়ে যতটুকু আলো আসে, ততটুকু। দরজা খুলতে গেলেই তেড়ে আসতো ঢিলের ঝাঁক। সেই ঢিলের ভয়ে কলম দিয়ে লেখা কথামালা আবার কলমে ফিরিয়ে নেয়া কিংবা মুখ দিয়ে বেরোনো বুলি আবার মুখে টেনে নেয়ার অসংখ্য ঘটনার সাথে আমরা পরিচিত।

কোন কিছুতে ভয় পাওয়া মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, এমনকি অধিকারও বটে। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে সেসব ভয় ছিলো আমাদের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা মেনে সাহিত্য-চর্চা, শিল্প-চর্চা এবং অন্যান্য চর্চাসহ বুদ্ধি-চর্চাও চলছিলো। আসলে সবকিছু মিলিয়ে যা হচ্ছিলো, তা ভয়ের চর্চা। একদিকে পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্খা, অন্যদিকে চারপাশে আতংক। তাই প্রতিটি উদ্যোগ, প্রতিটি উজ্জ্বল লড়াই শুরুর কিছুদিনের মধ্যে নিভে যাচ্ছে। কিছু একটা হয়েও হচ্ছে না, জেগেও জাগছে না। বিচ্ছিন্ন ফুলগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ফুটছে, সৌরভ বিলানো শেষে আবার ঝরে যাচ্ছে। এক সুতোয় গাঁথা যাচ্ছে না।

অবস্থা যখন এই, তখন হঠাৎ একটি ঝড় আসে। প্রচন্ড ঝড়। ভয়গ্রাসী একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া, ঠোঁটকাটা ভয়ংকর সুন্দর ঝড়। বৃষ্টি এসে সব ধুয়ে পরিষ্কার করবে, ঝড় এসে শুধু মিথ্যাগুলো উড়িয়ে নিবে, এক প্রখর সূর্য উঠে অশুভ সবকিছু জ্বালিয়ে দিবে —উপমার এমন চিত্রকল্পগুলো যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিলো। একজন মানুষ এলেন যিনি ভয়ের অন্ধকার কাটিয়ে, বাঁধার প্রাচীর ভেঙে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে আমাদেরকে টেনে বের করে আনলেন। তিনি হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্পষ্টবাদী, সমালোচক, যুক্তিবাদী লেখক ও চিন্তাবিদ।

আমাদের হুমায়ুন এলেন মুঠোভর্তি আলো আর প্রতুল সম্ভাবনা নিয়ে। অতঃপর মিথ্যার কাঁধে ভর করে সত্যের উঠে দাঁড়ানোর দিন শেষ হলো। বরং অর্ধসত্যগুলোও মিথ্যা ঝেড়ে পূর্ণ সত্য হয়ে ধরা দিতে শুরু করলো। মরতে বসা মশালগুলো আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। পূর্বাভাস ছাড়া যেমন ঝড় আসে না, এই জ্যোতির্ময়ও তেমনি পূর্বাবাস ছাড়া আসেননি। নিকটবর্তী পূর্বাভাস ছিলেন বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার বাতিঘর আহমদ শরীফ। আহমদ শরীফের সময়ে যদি হুমায়ুন আজাদ না আসতেন, তাহলে খুব অবিচার হয়ে যেতো। আহমদ শরীফ বয়সে আজাদের দুইযুগ বড় হলেও তাদের কর্মযজ্ঞ একটা সময় পাশাপাশি পথ ধরে এগিয়ে গেছে। দু’জন মানুষ বাঙালির মগজ মেরামত করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

এরপর আর মুক্তচিন্তার অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি কিংবা যুগব্যবধান সৃষ্টি হয়নি। আহমদ শরীফের জীবদ্দশায় হুমায়ুন আজাদ এলেন, একই সময় ছিলেন তসলিমা নাসরিন। আর এই তিনজন থাকতে থাকতে মুক্তচিন্তা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। আমরা এখন অনলাইনের নতুন যুগে বিচরণ করছি।

হুমায়ুন আজাদের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল বিক্রমপুর জেলার মুন্সিগঞ্জের কামারগাঁয়ে। তার পিতা আবদুর রাশেদ ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও পরবর্তীতে পোস্টমাস্টার। মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। আবদুর রহমান ও জোবেদা খাতুনের তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলের নাম দিয়েছিলেন হুমায়ূন কবির। কিন্তু ১৯৮৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি হুমায়ুন কবির নাম পরিবর্তন করে বর্তমান হুমায়ুন আজাদ নাম গ্রহণ করেন। তার মনে হয়েছে হুমায়ুনের সাথে কবির যায় না, আজাদ যায়। তাই লেখালেখির সাথে ‘ভালো যায়’ এমন একটি নাম নেন।

তা, কী লিখতেন হুমায়ুন আজাদ? —আসলে প্রশ্নটা হবে কী লিখতেন না তিনি? কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র, সমালোচনা, কিশোর সাহিত্য -সবই লিখতেন। তবে যাই লিখেন না কেন, তা সাহসের সাথে লিখতেন। সত্যকে সামনে রেখে লিখতেন। তার লেখায় নিজ দর্শন এত অসাধারণভাবে ফুটে উঠতো যে, বাংলা ভাষার আর কোন লেখকের রচনায় এত বেশি ‘প্রবচন’ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা, তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।

হিন্দুরা মুর্তিপূজারী; মুসলমানেরা ভাবমুর্তিপূজারী। মুর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা; আর ভাবমুর্তিপূজা ভয়াবহ।

পা, বাঙলাদেশে, মাথার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদোন্নতির জন্যে এখানে সবাই ব্যগ্র। কিন্তু মাথার যে অবনতি ঘটছে, তাতে কারো কোনো উদ্বেগ নেই।

সাহসিকতার সঙ্গে তিনি সমাজের এরকম বিভিন্ন অসঙ্গতি তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন। অকুতোভয় ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, নারীবাদী বক্তব্য এবং একই সঙ্গে নিঃসংকোচ যৌনবাদিতার জন্যে তিনি ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভীষ্ট তার সাহিত্যকে প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনীতিক।

প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক এই লেখকের শিক্ষাজীবনও ছিল বিচিত্র। ছেলেবেলায় প্রখর মেধাবী হুমায়ুন আজাদ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে অধ্যয়নের পর তৃতীয় শ্রেণী বাদ দিয়েই সরাসরি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। রাঢ়িখালের স্যার জে.সি. বোস ইনস্টিটিউশনে। ১৯৬২ সালে এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় মেধা তালিকায় তিনি ছিলেন একুশতম। বিজ্ঞানমনস্ক হলেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার জন্য বিজ্ঞান খুব প্রিয় ছিলো না। তবুও বাধ্য হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। কিন্তু ফলাফল আশানুরূপ ভালো হয়নি। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার আর অনিচ্ছার বিষয় নিয়ে পড়তে হয়নি। ১৯৬৭ সালে তার প্রিয় বাংলা সাহিত্যে অনার্স সহ স্নাতক ও ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।

পরের বছরই চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে প্রভাষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ১৯৭২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ের উপর গবেষণা করে ১৯৭৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে এই গবেষণাপত্র ১৯৮৩ সালে ‘প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলি (বাংলা সর্বনামীয়করণ)’ নামে বাংলা একাডেমি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এর মাঝে এক বিদেশী বন্ধুর সাথে মিলে জীবনানন্দের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন।

হুমায়ুন আজাদ ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠিনী লতিফা কোহিনুরকে বিয়ে করেন। তারা তিন সন্তানের জনক-জননী। দুই মেয়ে মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক ছেলে অনন্য আজাদ।

১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসার পর ১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরে ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।

হুমায়ুন আজাদের লেখালেখির শুরু সেই নবম শ্রেণী হতে। তিনি কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কবিতা লিখতে ভালোবাসলেও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম লেখাটি ছিলো গদ্য। দৈনিক ইত্তেফাকের শিশু-কিশোরদের পাতা ‘কচিকাঁচার আসরে’ হুমায়ুন আজাদের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘অলৌকিক স্টিমার’ যা ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে।

১৯৮৪ সালে এসে হুমায়ুন আজাদ সবাইকে চমকে দেন। ভাষা নিয়ে তার গবেষণার কথা আমরা আগেই পড়েছি। কিন্তু এবার তিনি সম্পাদনা করলেন বাংলা ভাষা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। বইটি বাংলা ভাষা – প্রথম খন্ড (১৯৮৪) ও বাংলা ভাষা – দ্বিতীয় খন্ড (১৯৮৫) নামে প্রকাশিত হয়। এই বইটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ভাষা গবেষকরা বইটিকে কিভাবে গ্রহণ করেছেন, তা বুঝার জন্য ছোট একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়।

ঘটনাটি ‘গুণীজনে’ চন্দন সাহা রায় এর লেখা থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি—

১৯৮৪ সাল। তখন হুমায়ুন আজাদের বয়স মাত্র ৩৭ বছর। এই বয়সেই তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ‘বাংলা ভাষা’-এর প্রথম খণ্ড বেরিয়ে গেছে। একদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তাঁর নিজ রুমে বসে আছেন। এমন সময় রুমে প্রবেশ করেন বিশ্বভারতীর এক প্রবীণ অধ্যাপক, প্রাক্তন ডিন। অধ্যাপক সাহেব, হুমায়ুন আজাদের চেয়ে বয়সে কম করে হলেও চল্লিশ বছরের বড় হবেন। তিনি রুমে প্রবেশ করেই জিজ্ঞেস করলেন, “ডক্টর হুমায়ুন আজাদকে কোথায় পাবো বলতে পারেন?” হুমায়ুন আজাদ বললেন, “আমিই হুমায়ুন আজাদ।” বিশ্বভারতীর অধ্যাপক বলেন, “আমার বিশ্বাস হয় না। যিনি বাংলা ভাষা সম্পাদনা করেছেন তাঁর বয়স এতো কম হতে পারে না।” হুমায়ুন আজাদ বলেন, “কতো হওয়া উচিত?” অধ্যাপক বলেন, “অন্তত পঁচাত্তর, এর আগে এমন জ্ঞান হতে পারে না।”

এই বই যখন প্রকাশিত হলো তখন বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল অধ্যাপক সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় বইটি তাঁর মাথায় তুলে নিয়ে হুমায়ুন আজাদকে বলেছিলেন, “আপনাকে কেউ স্বীকৃতি দেবে না, তবে এ কাজের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে অনারারি ডিলিট ডিগ্রি দিলাম।” হুমায়ুন আজাদ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মানুষের এমন প্রশংসা খুব বেশি পাননি। তাই এগুলো তাঁর বুকে ফুলের মত বিঁধেছিল।

১৯৮০’র দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ুন আজাদ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। ১৯৯১ সালে তার লেখা প্রবচনগুচ্ছ এদেশের শিক্ষিত পাঠক সমাজকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরের বছরই নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে তিনি সাড়া ফেলেন। বইটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলো। এই গ্রন্থ তার বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবেও স্বীকৃত।

বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শত বছর আগে বলেছেন—

আপনারা হয়তো শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে,  আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন? সে জীব ভারতীয় নারী। এই জীবগুলোর জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে না।

– রোকেয়া

রোকেয়ার এই কথাগুলোকে পুনর্জাগরণ ঘটান প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ। তিনি তার ‘নারী’ বইতে লিখেছেন আমাদের দেশের শৃঙ্খলিত নারী সমাজের কথা। বলেছেন নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক আচরণের কথাও। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের নারীদের কথা বলেছেন, তুলে এনেছেন বিভিন্ন প্রান্তের নারীবাদীদের কথাও। এই বইয়ে নারী অধিকার নিয়ে হুমায়ুন আজাদের পরিপাটি দৃষ্টিভঙ্গির দেখা পাওয়া যায়। যদিও তিনি বলেছেন তিনি নারীবাদ নিয়ে লিখেননি এমনকি নারীর উন্নয়নের উদ্দেশ্যেও লিখেননি। তিনি যা লিখেছে, তা পূর্ণাঙ্গভাবে একটি বই। তবে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বইটি পড়ে হয়তো বাঙালি নারী-পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে।

‘নারী’ বইয়ের অনুষঙ্গ হিসেবে হুমায়ুন আজাদ অনুবাদ করেন সিমন দ্যা বেভোয়ারের ‘দ্যা সেকেন্ড সেক্স’ বইটি। যা ২০০১ সালে ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ নামে প্রকাশিত হয়। যথারীতি এই বইটিও সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। পরপর দু’টি বই ‘নিষিদ্ধ’ তকমা পাওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হন। রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা নিয়ে ২০০৩ সালে প্রকাশ করেন ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ বইটি। বাংলাদেশে তখন মৌলবাদ বিস্তার লাভ করছিল। বইটিতে দেশের প্রতি তার ভালোবাসা এবং নিবিড়ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি খেয়াল রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে যারা প্রচলিত প্রথা ও অশালীন জড়তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন, তাদের মধ্যে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের নাম আলাদা ভাবে উচ্চারিত হয়। কারণ তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। তার অনেকগুলো পরিচয় আছে। প্রতিটি পরিচয়ে তিনি স্বতন্ত্র ঔজ্জ্বল্য ধারণ করেন। শুধু কবি হিসেবে, কিংবা শুধু ভাষাবিদ হিসেবে, অথবা শুধু ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এসব পরিচয় বাদ দিলেও তিনি চিন্তাবিদ হিসেবে স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। ‘সংস্কারক’ একটু পুরোনো শব্দ, কিন্তু এই শব্দের সাথেও তিনি দারুণ মানিয়ে যাচ্ছেন। আর হুমায়ুন আজাদের এই শুদ্ধি অভিযানের তীর সবচে বেশি বিঁধেছে প্রগতিশীলদের বুকে।

তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, আমাদের প্রগতিশীলতায় প্রগতি নেই, আমাদের নারীবাদে নারীর অধিকার নেই। আমরা কেবল আধুনিক শরীরে পুরোনো মগজ বয়ে বেড়াচ্ছি। ভন্ডামি ও কপটতা ধরে ধরে তিনি সবাইকে আক্রমণ করেছেন। তাই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বেশিরভাগ লোকই হুমায়ুন আজাদকে পছন্দ করতেন না। কেউ কেউ তার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আগেই আক্রমণ করে বসতেন।

বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে। ভন্ড, ভন্ডতর, ভন্ডতম।

যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।

এখানকার একাডেমিগুলো সব ক্লান্ত গর্দভ; মুলো খাওয়া ছাড়া ওগুলোর পক্ষে আর কিছু অসম্ভব।

জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।

বাঙলাদেশে কয়েকটি নতুন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে; এগুলো হচ্ছে স্তুতিবিজ্ঞান, স্তব সাহিত্য, সুবিধা দর্শন ও নমস্কারতত্ত্ব।

এদেশে সবাই শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক : দারোগার শোকসংবাদেও লেখা হয়, ‘তিনি শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন’।

উপরের কথাগুলো তিনি তার সময়ের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বলেছেন। হুমায়ুন আজাদের সমালোচনার তীর থেকে কেউ রেহাই পায়নি। অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুজ হুমায়ুন আহমেদ -তিনি সবাইকে নিয়ে তার ভালোলাগা মন্দলাগা প্রকাশ করেছেন। আশির দশকের পর বাংলাদেশে ‘জনপ্রিয়’ ধারার উপন্যাসের বেশ কাটতি ছিলো। গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন উপন্যাসের পাঠকরা এ নিয়ে বিরক্তিতে ভুগেছেন। অনেক প্রকাশকও অসন্তুষ্ট ছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এই বিষয়ে কথা বললেন। কথা বললেন মানে, আসলে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লেন। কারণ তখন জনপ্রিয় ধারার উপন্যাসের লেখকরা ব্যাপক জনপ্রিয়। তাদের হাজার হাজার ভক্ত। এই ভক্তকূলের রোষানলে পড়বেন জেনেও এ ধারার উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ নামে অভিহিত করলেন। আর এসব বইয়ের পাঠককেও ছাড়লেন না। বললেন, “মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে রয়েছে এক দূরারোগ্য দাদ, যা চুলকোলে পাওয়া যায় বিশেষ আনন্দ। ওই দাদটির নাম ‘সুখদুঃখ’।”

নানান জনকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদের বিভিন্ন আঁকাবাঁকা কথা শুনতে শুনতে একবার আহমদ ছফা খুব বিরক্ত হন। বিরক্ত হয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে “হুমায়ূন আজাদ একটা সজারু” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। যা ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আজাদও বিভিন্ন সময় ছফাকে নিয়ে লিখেছেন, ঘরোয়া আড্ডায় বলেছেন। অনেকে ভয়ে হুমায়ুন আজাদের সাথে আড্ডায় বসতেন না। কারণ তিনি কোন রাখঢাক না রেখে নানান জনকে নিয়ে খোলামেলা সমালোচনা করতেন। যার ফলে শ্রোতাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো।

সব পক্ষকে ছাপিয়ে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন মৌলবাদীদের কাছে মূর্তিমান আতংক। কারো চোখে মরিচ মেখে দিলে যেমন অনুভূতি হয়, আজাদের লেখা পড়ে মৌলবাদীদেরও তেমন অনুভূতি হয়। কিন্তু তাদের সর্বাঙ্গ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, যখন ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি লিখেন। উপন্যাসটি প্রথমে ২০০৩ সালের ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, পরে বই আকারে। এই উপন্যাসে তিনি ধর্ম ব্যবসায়ী আলেম ওলামাদের চরিত্রগুলো নিষ্ঠার সাথে ফুটিয়ে তোলেন। এর আগে বাংলা ভাষার কোন লেখক এতটা সত্যদৃশ্য তুলে ধরতে পারেননি। সেই ১৪’শ বছর আগের ইসলামের প্রবর্তক হোক, আর বর্তমানে দাড়িটুপি ধারী বদমাশ হোক, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এই ক্ষেত্রে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করতেন। কিন্তু ডক্টর আজাদ তা করেননি।

হুমায়ুন আজাদের বিচার চেয়ে মৌলবাদীদের মিছিল। ছবি কৃতজ্ঞতা – মুক্তমনা

ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর মৌলবাদীরা তাকে হত্যার হুমকী দেয়। আর ২০০৪ সালে বই মেলায় প্রকাশিত হওয়ার পর তা কেবল হুমকীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বাংলা একাডেমির উল্টো পাশের ফুটপাতে হামলার শিকার হন তিনি। রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদকে দেখতে পেয়ে কয়েকজন পথচারী এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ যাত্রায় তিনি প্রাণে বাঁচেন।

হামলার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। কয়েক সপ্তাহ আন্দোলনের এক পর্যায়ে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ, যাতে আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে হুমায়ুন আজাদের ওপর চরমপন্থী ইসলামী জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।

বাংলা একাডেমির সামনে আহত হুমায়ূন আজাদ

হুমায়ুন আজাদ গণহারে সবার সমালোচনা করতেন, বিরুদ্ধমত করতেন —বিষয়টা এমন নয়। তার সাথে তরুণদের সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। নতুন কোন প্রগতিশীল উদ্যোগ, আন্দোলন বা চিন্তার সন্ধান পেলে নিজ ইচ্ছায় সেসবের সাথে যুক্ত হতেন। যেমন হয়েছিলেন অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত মুক্তমনা’র সাথে। মুক্তমনা ওয়েবসাইটের খোঁজ পেয়ে একদিন নিজের একটি লেখা মেইল করে প্রকাশের অনুরোধ জানান। এ নিয়ে এক স্মৃতিকথায় অভিজিৎ রায় লিখেন –

হুমায়ুন আজাদের সাথে আমার যোগাযোগ হয় আমি দেশের বাইরে এসে মুক্তমনা তৈরী করা পরে।  হঠাৎ তিনি একদিন আমাদের ইমেইল করেন তার বিখ্যাত ‘ধর্মানুভূতির উপকথা’ প্রবন্ধটি সংযুক্ত করে। অনুরোধ করেন মুক্তমনায় প্রকাশের জন্য। আমরা হই আনন্দিত এবং সেই সাথে আপ্লুত। আমরা লেখাটিকে পিডিএফ আকারে আমাদের সাইটে রেখে দেই। পরে তিনি এটিকে ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন (আমরাও পরে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করি আমাদের সংকলন গ্রন্থ ‘স্বতন্ত্র ভাবনা -তে)। আমরা গর্বিত যে, লেখাটি ছাপার অক্ষরে কোথাও যাওয়ার আগে আমরাই সেটিকে ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। এর পর থেকে মুক্তমনার সাথে হুমায়ুন আজাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি আমাদের সাথে অনিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতেন।

২০০৩ সালে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর যখন মৌলবাদীরা তাকে হুমকী দিচ্ছে, তখন ২০০৪ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি মুক্তমনায় আরেকটি মেইল করেন। এই লেখায় উপরে ব্যবহৃত পত্রিকার খন্ডটি সেই মেইলের সাথে সংযুক্ত ছিলো। মেইলে হুমায়ুন আজাদ লিখেন-

The Ittefaq published a novel by me named “Pak Sar Jamin Sad Bad” in the Eid Issue in December 03. It deals with the condition of Bangladesh for the last two years. Now the fundamentalists are bringing out regular processions against me demanding exemplary punishment. Attached two files with this letter will help you understand.

আক্রমণের পর সুস্থ হয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসী হামলার জন্য মৌলবাদী গোষ্ঠীকে দায়ী করেন তিনি। তার পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা চেষ্টার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগে মামলা করা হয়। সেই মামলার বিচার এখনো, অর্থাৎ ২০১৮ সালেও শেষ হয়নি। সাক্ষির অভাবে বিচার দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

২০০৪ সালে আক্রান্ত হওয়ার পর কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে ‘পেন ইন্টারন্যাশনাল’ এর বৃত্তিতে বিখ্যাত জার্মান প্রতিবাদী কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা করতে মিউনিখে আসেন। দিনটি ছিলো ৮ আগস্ট রবিবার সন্ধ্যা। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে ‘জার্মান পেন’ এর প্রেসিডেন্ট ইয়োহানেস স্ট্রাসার ও আরো কয়েকজন ডক্টর আজাদের এপার্টমেন্টে আসেন। তাকে নিয়ে দাপ্তরিক কোন কাজে যাওয়ার কথা ছিলো। বাসার সামনে এসে কলিং বেল বাজিয়ে, ডাকাডাকি করে কোন সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে তাকে অচেতন অবস্থায় পায়। আসলে তখন তিনি মৃত।

যারা হুমায়ুন আজাদকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান, তাদের কাছে এই মৃত্যু স্বাভাবিক মনে হয়নি। ‘জার্মান পেন’ এর প্রেসিডেন্ট স্ট্রাসার সেসময় জানিয়েছেন, ‘বুধবার (১১ আগস্ট ২০০৪) সন্ধ্যায় ডক্টর আজাদ একটি পার্টিতে যোগ দেন। সেখানে তাকে খুব হাসিখুশী দেখাচ্ছিলো৷’ যদিও জার্মান পুলিশ বলছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছে।

হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর তার হত্যাচেষ্টা মামলাটি ‘হত্যা মামলা’য় রূপ নেয়। হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার কারণ হিসেবে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, চিকিৎসা প্রতিবেদন, জার্মানি থেকে পাঠানো মৃত্যুর সনদ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা গেছে, আক্রমণের কারণেই লেখক হুমায়ুন আজাদ মারা যান। সে কারণে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার চার্জশিটে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের নাম আসলেও পরে বাদ দেয়া হয়। এ মামলায় অভিযুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- মো. মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন ওরফে হামিম ওরফে হাসিম, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ এবং হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেল। —এরা সবাই এরা সবাই নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা সমালোচক ও স্পষ্টবাদী হুমায়ুন আজাদও বিতর্ক কিংবা সমালোচনার উর্ধ্বে নন। হয়তো খুব বেশি পাবেন না, কিন্তু স্ববিরোধী কাজ থেকে অন্যদের মত তিনিও বিরত ছিলেন না। সেনাবাহিনীর ‘সেবাদাস’ হওয়াকে খুব ঘৃণিত কাজ হিসেবে মানতেন তিনি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজল পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক সরকারের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ পরবর্তীতে তার কোন এক লেখায় আবুল ফজলের সমালোচনা করে বলেন— “বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিনত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।”

আবার সেই হুমায়ুন আজাদই সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে চড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে এসে লিখলেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরণাধারা’ বইটি। এই বইয়ে পার্বত্য অঞ্চলে সহিংস রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আলোকপাত করেন তিনি। এসব আলোচনার অনেক ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদ সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়।

তিনি তার ‘নারী’ বইতে কয়েকজন বিদেশি লেখকের রচনা থেকে প্রাসংঙ্গিক অংশবিশেষ হুবহু ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বই প্রকাশের সময় ভূমিকায় তা উল্লেখ করেননি। পরবর্তী সংস্করণগুলোতে এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন। এই উদাহরণটি তার জন্য খুব বেকায়দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কারণ ব্যক্তিটি হুমায়ুন আজাদ। যার তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম তীর থেকে কেউই রেহাই পায়নি। এই একটি উদাহরণের জন্য আহমদ ছফার মত লেখকও হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ বই না পড়েই ‘নকল’ এর অভিযোগ এনেছেন। ‘বই না পড়েই’ লিখেছি এজন্য যে, তিনি যে অভিযোগ এনেছেন, তার যাচাই করে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। অসত্য অভিযোগ এনে আহমদ ছফাও নিজ ব্যক্তিত্বে কালিমা লাগিয়েছেন। (এ বিষয়ে মুক্তমনায় প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন।)

হুমায়ুন আজাদ তার সমসমায়িক নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সাথেও ঝগড়ায় জড়িয়েছেন। তসলিমা নাসরিন দাবি করেছিলেন তার লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে হুমায়ুন আজাদ ‘নারী’ বইটি লিখেন। এবং ‘নারী’ একটি ‘টুকে লেখা’ বই। এর জবাবে হুমায়ুন আজাদ বেশ কিছু কথা বলেন, যার মধ্যে একটি বাক্য ছিলো “তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি, তাই…!”

এর জবাবে তসলিমা বলেন “আমার সম্পর্কে মিথ্যে উচ্চারণে হুমায়ুন আজাদের কোন অসুবিধে হয় না। নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক তিনি, বলে ফেললেন ‘তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি’! যেন আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কোনওদিন! (আমি) একজন ডাক্তার, তার ওপর জনপ্রিয় লেখক, বিভিন্ন দেশ থেকে সাহিত্য পুরস্কারসহ প্রচুর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর আত্মজীবনীকে তিনি বলে দিলেন, ‘পতিতার নগ্ন আত্মকথন এবং নিকৃষ্টতম জীবনের কূরুচিপূর্ন বর্ণনা।’ প্রচণ্ড নারী-ঘৃণাকারী বদমাশও কোন নারী সম্পর্কে না জেনে না বুঝে এই মন্তব্য করতো না।”

অনেকে আজাদ-ছফা, নাসরিন-আজাদ, হক-আজাদ —এসব ব্যক্তি আক্রমণকে ‘বিজ্ঞজনের মধুর ঝগড়া’ বলে আখ্যায়িত করতেন। আবার অনেকে এটাকে ব্যক্তিত্বহীন কাদা ছোঁড়াছোড়ি হিসেবেও দেখতেন। যদিও একটা বিষয় হচ্ছে, অহংকার-অহমিকা, লাভ-ক্ষতি, লোভ-মোহ, কামনা-বাসনা মিলিয়েই মানুষ। কোন মানুষই এসবের উর্দ্ধে নন।

হুমায়ুন আজাদ যা বলতেন, বা যে নীতি আদর্শ প্রকাশ করতেন, তার সাথে সঙ্গতি রেখে জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি নীতির সাথে আপোষ করেননি। একবার তিনি কবিতা পরিষদ আয়োজিত কবিতা উৎসবে নোয়াখালী গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে তিনিই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। তো, স্থানীয় কবিদের অনেকে তাদের লেখা কবিতার বই, কবিতা হুমায়ুন আজাদকে দেন। মঞ্চে বসে তিনি বইগুলো কিছুক্ষণ নড়েচড়ে দেখলেন। বক্তৃতা দেয়ার সময় সবাই অপেক্ষা করছেন, এসব কবিতা নিয়ে তিনি কী বলেন। এদিকে বক্তৃতা প্রায় শেষ হয়ে এলো, কিন্তু তিনি কিছুই বলছেন না। পরে ইশারা পেয়ে যা বললেন, তা অনেকটা এরকম —আমার সামনে অনেক কবি বসা। তাদের কিছু বই আমার হাতে আছে। কিন্তু এসব বইয়ে একটাও কবিতা খুঁজে পেলাম না।

সেদিন দুপুরে মাইজদী পৌরসভার চেয়ারম্যান মঞ্জু সাহেবের বাসায় তার দুপুরের খাবার গ্রহণের কথা ছিলো। মাইক্রোবাসে করে তার বাসার দিকেই যাচ্ছেন। পথিমধ্যে শহরের একমাত্র সিনেমাহল ক্রস করার সময় কেউ একজন বললেন যে এই সিনেমা হলটি চেয়ারম্যান মঞ্জুর। হুমায়ুন আজাদ তাকিয়ে দেখেন রৌশনবাণী সিনেমা হলে এক টিকেটে দুই ছবি (বিদেশি পর্নমুভিসহ) চলছে। এটা দেখে তিনি বললেন, “গাড়ি ঘুরাও, আমি ঢাকা গিয়ে খাবো।” অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ওই সিনেমা হলের মালিকের বাসায় যাননি, খাওয়াতো দূরে থাক।

হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। এর মধ‍্যে ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।

হুমায়ুন আজাদ ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ জাপানি ভাষায় অনুদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।

তার প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’, ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’, ‘মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ’, ‘শুভব্রত’, ‘তার সম্পর্কিত সুসমাচার’, ‘রাজনীতিবিদগণ’, ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’, ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’, ‘ফালি ফালি ক’রে কাটা চাঁদ’, ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’, ‘১০,০০০ এবং আরো ১টি ধর্ষণ’, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, ‘একটি খুনের স্বপ্ন’।

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘যাদুকরের মৃত্যু’ অন্যতম। গবেষণা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ কাব্য,উপন্যাস ছাড়াও তার কাব্যেও ছিল অনবদ্য লেখনীর ভাব। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, ‘জ্বলো চিতাবাঘ’, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’, ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, ‘হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’, ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’, ‘পেরোনোর কিছু নেই’।

কিশোরসাহিত্যের মধ্যে রয়েছে ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’, ‘কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’, ‘আব্বুকে মনে পড়ে’, ‘বুকপকেটে জোনাকিপোকা’, ‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’, ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’, ‘আওয়ার বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ছাড়াও তাঁর সমালোচনাগ্রন্থ, ভাষাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে প্রচুর সাহিত্য ও গবেষণাকর্ম রয়েছে।

বাংলায় মুক্তবুদ্ধি চর্চার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। বিংশ শতকে এসে এই চর্চাকে হুমায়ুন আজাদ এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যান। বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদ কেবলই একজন ব্যক্তি নন, বরং একটি প্রতিষ্ঠান।


তথ‍্যসূত্র
১. আজাদ, হুমায়ুন  —বাংলাপিডিয়া
২. হুমায়ুন আজাদ —গুণীজন
৩. প্রথাবিরোধী যোদ্ধা হুমায়ুন আজাদ —এনটিভি
৪. হুমায়ুন আজাদ হত্যা: দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবরোধের খাড়া —বিডিনিউজ২৪
৫. হুমায়ুন আজাদ(১৯৪৭-২০০৪):সব মৃত্যু থেমে থাকা নয় —ডয়েচে ভেলে
৬. হুমায়ুন আজাদ হত্যায় পাঁচজন জেএমবি অভিযুক্ত —বিবিসি
৭. বাঙালি হিপোক্রিট পুরুষ-লেখকদের চরিত্র ১ —বিডিনিউজ২৪


কপিরাইট সংক্রান্ত অনুরোধঃ

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।


 

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন