হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ প্রকাশিত হবার পর বুদ্ধিজীবী মহলে এনিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তার সমালোচনামূলক প্রবচনগুলো নিয়ে পাল্টা সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই ঝড়ের নেতৃত্ব দেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তখন এই বিষয়ে হুমায়ুন আজাদের একটি সাক্ষাৎকার নেন সরকার আমিন। যা ১৯৮৯সালের জুন মাসে বিশ্বদর্পন ম্যাগাজিনের চতুর্থ বর্ষের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আমাদের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।


 

ড. হুমায়ুন আজাদ এ-সময়ে সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তাঁকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। ইতিমধ্যে নজরুল ইসলাম বিষয়ক এক প্রবন্ধে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে দেশব্যাপী তুমুল হইচই হয়েছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এই বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। বস্তুতঃ মেধাবী এ-অধ্যাপকের বিবৃতি-ভাষণ-কবিতা সব সময়ই পাঠককে আলোড়িত করে, সে পক্ষেই হোক বিপক্ষেই হোক। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের তরুণদের উদ্যোগে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। অরুণিমা নামের এ-সংকলনটিতে পঁচিশটি প্রবচনসংকলিত হয়। বাঙলা সাহিত্যে কোনো একক ব্যক্তিত্বের সৃষ্ট প্রবচন সম্ভবত আঙ্গিকগত বিচারে এই প্রথম। এ-প্রবচনগুলো সম্পর্কে ঢাকায় তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ শামসুল হক।— গত ১৬.৬.৮৯ তারিখে। আমরা ড. হুমায়ুন আজাদের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের সাথে একটি সাক্ষাৎকার প্রদানসহ আরো নতুন ২৫টি প্রবচন মুদ্রণের জন্যে দেন। আমরা চাই প্রবচন বিতর্কের মধ্য থেকে সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড সম্পর্কে কিছু সত্য কথা বেরিয়ে আসুক। পরস্পরের নাক কান না কেটেও সত্যিকারের বিতর্ক সৃষ্টি করা যায় এবং এটা খুবই স্বাস্থ্যকর সাহিত্য ও সমাজের জন্যে এই আমরা এ প্রতিবেদনটি পরিকল্পনা করেছি।

দর্পণ: আপনি যে প্রবচনগুলো লিখেছেন সে সম্পর্কে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে বেশ আলোচনা হচ্ছে, এ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

হুমায়ুন আজাদ: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে না বলে বলা ভালো সৃষ্টি করা হয়েছে। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আপনি কি লিখবেন…?

দর্পণ: না, আপনি বলুন, পরে আমি তা ক্যাসেট থেকে লিখে নেবো।

হুমায়ুন আজাদ: (কিছুক্ষণ নীরব থেকে) আমার এ-প্রবচনগুলো-বলা যেতে পারে বাঙলা ভাষায় এই প্রথম সাহিত্যিক প্রবচন রচনার সূত্রপাত। এখানে আমি বেশ কিছু সমকালীন এবং শাশ্বত সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এগুলো শেষ, বিদ্রুপ, হাস্যরসের মধ্য দিয়ে বস্তুজগৎ সম্পর্কে আমার কিছু উপলব্ধির প্রকাশ।

এখানে ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আক্রমণও করা হয় নি, কাউকে প্রশংসাও করা হয় নি। কিন্তু যে-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমার কাছে সাহিত্যিক বা শৈল্পিক বা মননশীল বলে মনে হয় নি; বরং মনে হয় এর পেছনে শুধু আমার বিরোধিতা করার প্রবণতাটিই প্রধান।

দর্পণ: প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথম যে-লেখাটি এসেছে সেটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ‘হৃৎকলমের টানে’ কলামে সৈয়দ শামসুল হক-এর একটি প্রতিবাদ, লেখাটি কি আপনি পড়েছেন?

হুমায়ুন আজাদ: আমি পড়েছি।

দর্পণ: সৈয়দ হক-এর ব্যাখ্যা যথার্থ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

হুমায়ুন আজাদ: সৈয়দ হকের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে অপব্যাখা, তাঁর এ-ধরনের ব্যাখ্যা এক ধরনের আত্মহত্যাও বটে। তিনি তার সাহিত্যে যেভাবে এ-বিষয়গুলো দেখেছেন এখানে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছেন। কিছু দিন আগে একটি মৌলবাদী পত্রিকা তাঁকে যেভাবে আক্রমণ করেছে, তিনি তার কলামে আমাকে অবিকল সে-মৌলবাদী পত্রিকার কলাম লেখকের মতো আক্রমণ করেছেন। অর্থাৎ সৈয়দ হকের সঙ্গে ওই মৌলবাদী পত্রিকার লেখকের কোনো পার্থক্য নেই এখন। ফলে এটি আমার বিরুদ্ধে যতোটা আক্রমণ তার চেয়ে তার নিজের বিরুদ্ধে, তার বিশ্বাস, তাঁর সমস্ত সাহিত্যের বিরুদ্ধে অনেক বেশি আক্রমণ। সৈয়দ হক বেশ অসৎ কাজ করেছেন। আমার একটি প্রবচন তার কাজটি সম্পর্কে প্রয়োগ করা যেতে পারে; সৈয়দ হক হয়তো ভাবছেন যে তিনি সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি যে সত্য কথা বলার চেষ্টা করলেন, এতেই বোঝা যায় এর পেছনে তার একটি অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, যা সাধারণত থাকে বাঙালির। হয়তো তিনি কোনো কারণে আমার প্রতি বিরূপ; এ-কলামের মধ্য দিয়ে আমাকে আক্রমণ করে কিছুটা তৃপ্তি বোধ করছেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না এ-আক্রমণ আসলে তাঁর নিজের বিরুদ্ধে, আধুনিকতার বিরুদ্ধে। এতে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবে, উপকৃত হবে মৌলবাদীরা, প্রগতিবিরোধীরা। সৈয়দ শামসুল হকও হয়তো নিজে উপকৃত হবেন; কিন্তু এ-উপকার প্রগতি ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে যাবে।

দর্পণ: সৈয়দ হক আপনার আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে’ প্রবচনটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন…

হুমায়ুন আজাদ: এ-প্রবচনটির (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) যে-ব্যাখ্যা সৈয়দ হক দিয়েছেন, তাতে একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত অপব্যাখ্যা। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ নেই। আমি যা বলেছি তা একটি সামাজিক সত্য। এখানে বলা হয়েছে আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমি জানি না সৈয়দ হক কাননবালাশব্দের অর্থ বুঝতে পেরেছেন কিনা। আমার সাথে অনেকেই দেখা করতে এসেছেন, যাঁরা কাননবালাশব্দের তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি। কাননবালা বাঙলা চলচ্চিত্রের একজন অত্যন্ত আকর্ষণীয় অভিনেত্রী ছিলেন। আগে বাঙলা নাটক, মঞ্চ, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যে মেয়েরা পতিতালয় থেকেই আসতো। কয়েক দশকে আমাদের সমাজে বদল ঘটে গেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কলেজ থেকে, বহু মেয়ে অভিনয়ে আসছে; একে খুব গৌরবজনক মনে করছে। এ-প্রবচনটির অবশ্য দুধরনের ব্যাখা সম্ভব; একটি ইতিবাচক যে হ্যাঁ, আমাদের সমাজের উন্নতি হয়েছে। সিনেমা বা নাটকের যে-এলাকাটি নিন্দিত ছিলো, এককালে অন্ধকার এলাকা বলে মনে করা হতো, সে-এলাকায় এখন শিক্ষিত মেয়েরা আসছে। শিক্ষিত তরুণীরা আসছে বলে এর উন্নতি হয়েছে। এর নেতিবাচক ব্যাখ্যা সম্ভব; তা হচ্ছে আগে যে-এলাকায় উচ্চশিক্ষিত মার্জিতরা আসতো না সেখানে এখন বিপুল পরিমাণে উচ্চশিক্ষিত মেয়ে আসছে। এটা আমাদের সমাজের এক ধরনের পতনও নির্দেশ করে। যে-মেয়েটি পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করেছে, তার কাছে আমি কখনোই প্রত্যাশা করি না সে অভিনেত্রী হবে। যে-মেয়েটি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেছে আমি মনে করি না সে অভিনেত্রী হবে। এখন দেখা যায় উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে অনেক মেয়ে সিনেমায় নামে এবং যে-নায়িকারা শিক্ষিত নয় তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ব্যর্থ হয়। তারা ভালো কাননবালাও হতে পারে। এখনকার শিক্ষিত মেয়েরা অঞ্জু ঘোষ হতে চায়, তাদের জীবনের লক্ষ্য অঞ্জু ঘোষ হওয়া, শ্রীদেবী হওয়া। কেউ আর বেগম রোকেয়া হতে চায় না। আমাদের সমাজ এদেরই প্রচার বেশি দিয়ে থাকে। যে-তরুণীটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছে, যে গবেষণা করতে চায়, যে অত্যন্ত ভালো কাজ করতে চায়, সমাজ তার দিকে ফিরেও তাকায় না; বরং যে সিনেমায় নেমেছে, নাটকে নেমেছে, তার ছবি ছাপা হয়, তাকে অসাধারণ বলে নির্দেশ করা হয়। এটা সমাজের পতন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকায় অভিনেত্রীর বেশ মূল্য। কিন্তু যে মেয়েটি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে, চমৎকার গবেষণা করেছে, চমৎকার বই লিখেছে, তাকে বিশেষ মূল্য দেয়া হয় না। প্রবচনটিতে এ-দুটো দিকই ধরা পড়েছে। এটি কোনো ব্যক্তি বা নারী সমাজের প্রতি আক্রমণ নয়, বিষোদগার নয়, এটি একটি সত্যের প্রকাশ; এবং (একটু হেসে) ব্যক্তিগতভাবে আমি নারীবাদী আন্দোলনের একজন বড়ো প্রবক্তা, যা সৈয়দ হক সম্ভবত নন।

দর্পণ: আচ্ছা, আর একটি প্রবচন নিয়ে কথা বলেছেন সৈয়দ হক, যেটি হলো শামসুর রাহমানকে একজন অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেল, শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায় যেতে হয়, কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়। এ প্রবচনটি উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, আপনি শামসুর রাহমানের অভিভাবক নন, আপনি এ ধরনের কমেন্ট কিভাবে করলেন?

হুমায়ুন আজাদ: এ-প্রবচনটি সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে সৈয়দ হকের সমস্ত ব্যাখ্যা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। সৈয়দ হক বারবার শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধার কথা বলেছেন। আমি বুঝি না একজন আধুনিক মানুষ সারাক্ষণ শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধার কথা কেনো ভাবেন। হয়তো সৈয়দ হক নিজেকে শ্রদ্ধেয় ভাবতে পারছেন না, বা যথেষ্ট শ্রদ্ধা পাচ্ছেন না বলে তার এ রকম মনে হচ্ছে। শামসুর রাহমান ও একজন অভিনেত্রী সম্পর্কে আমি যে-মন্তব্য করেছি তার বক্তব্যটা আগে লক্ষ করা যাক। শামসুর রাহমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি; তাই তার প্রতীকী তাৎপর্য আছে। তিনি একটি অভিনেত্রীর সঙ্গে কী কথা বলতে পারেন? অভিনেত্রীর সঙ্গে কী কথা বলা যেতে পারে? তার সঙ্গে নিশ্চয়ই বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে, দর্শন সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তার সাথে শুধু চাটনি, লিপিস্টিক ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব, ফাজলামো করা সম্ভব। শামসুর রাহমান সেখানে কেনো যাবেন ফাজলামো করতে? আমি কেনো যাবে?

দর্পণ: শয্যা ব্যাপারটি তাহলে প্রতীকী অর্থে এসেছে…

হুমায়ুন আজাদ: এর মধ্যে একটি হিউমার রয়েছে। সারা পৃথিবীতে অভিনেত্রীদের কীভাবে দেখা হয়? সারা পৃথিবীতে অভিনেত্রীরা মোটামুটিভাবে যৌনাবেদনময়ী নারী। তারা মনহীন দেহসর্বস্ব মানুষ মাত্র। কাজেই তার সঙ্গে অভিনেত্রীর কথা আমি ভাবতে পারি না। মনে করুন রবীন্দ্রনাথ একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় দর্শকদের চিত্তবিনোদনের জন্যে গেছেন। এ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অভিভাবকত্বের কোনো ব্যাপারই নেই এখানে। আমি বিশ্বের যে-কোনো বিষয় সম্পর্কে কথা বলতে পারি, শামসুর রাহমান কেননা, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও পারি, শেক্সপিয়র সম্পর্কেও পারি। রবীন্দ্রনাথের বহু ব্যাপার আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ বহু পণ্যের বিজ্ঞাপনে নিজেকে বেচেছেন, যা আমি সমর্থন করি না। নিজেকে তিনি পণ্যসামগ্রী করে তুলেছিলেন।

দর্পণ: আরেকটি প্রবচন সৈয়দ হক উদ্ধৃত করেছেন, সেটি হচ্ছে অধিকাংশ রূপসীর হাসির সৌন্দর্য মাংসপেশির কৃতিত্ব মাত্র, তা হৃদয়ের প্রকাশ নয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন যে, আপনি এখানেও নারীকে অবজ্ঞা করেছেন, নারীকে ছোট করে দেখেছেন।

হুমায়ুন আজাদ: সৈয়দ হকের মগজ যে এতো নিষ্ক্রিয় এটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। নারীকে যে সারাক্ষণ প্রশংসা করতে হবে তা নয়; কেউই সারাক্ষণ প্রশংসা পেতে পারে না, নারী হওয়া সহজাতভাবে প্রশংসা পাওয়ার ব্যাপার নয়; সব কিছুই সমালোচনার বস্তু। এখানে আমি অধিকাংশ রূপসীর কথা বলেছি। এটা তো ঠিক যে শারীরিক সৌন্দর্য, হাসির যে-সৌন্দর্য, তা প্রধানত হচ্ছে পেশির সৌন্দর্য; অবয়বসংস্থানের সৌন্দর্য। কে না জানে যে রূপসীদের হাসির বড়ো অংশই কৃত্রিম, তার পেছনে রয়েছে কতো ব্যায়াম। এখানে সমস্ত নারীর কথা বলা হয় নি; বলা হয়েছে অধিকাংশ রূপসীর কথা। এ-সমাজে আর সারা পৃথিবীতে রূপসী বলে সাধারণত গণ্য হয় যারা, সে-চিত্রতারকা বা সামাজিক মহিলাদের আন্তরিকতা নেই; তা পণ্যমাত্র। এটা মাংসপেশির কাজ, যার মাংসপেশি সুন্দর তার হাসিও সুন্দর। এ-প্রবচনটি আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

দর্পণ: আর একটি প্রবচন, সেটি হচ্ছে একটি স্থাপত্য কর্ম সম্পর্কে আমার কোনো আপত্তি নেই এবং তার কোনো সংস্কারও আমি অনুমোদন করি না, স্থাপত্য কর্মটি হচ্ছে নারীদেহ। সৈয়দ হক প্রবচনটি তুলে ধরে বলেছেন যে নারীকে আপনি ‘শরীর, শরীর এবং শরীর’ এরকমভাবে মূল্যায়ন করেন।

হুমায়ুন আজাদ: এখানে নারীর একটি দিক সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। আমি কোথাও বলি নি যে নারীর শরীর ছাড়া আর কিছু নেই। ভাস্কর্য শরীরেই হয়ে থাকে, কখনো মনের ভাস্কর্য রচিত হয়নি। এটি নারীসৌন্দর্যের এক অসাধারণ স্বীকৃতি। আমি সমস্ত কিছুকে সংস্কারযোগ্য মনে করি, শুধু নারীর অবয়বসংস্থানকে বা সুষমাকে আমার আর সংস্কারযোগ্য মনে হয় না। সারাক্ষণ শুধু মনের কথাই বলতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, নারীকে নিয়ে একটি অসুবিধা এই যে তাকে যদি বলা হয় তুমি দেখতে সুন্দর, তখন সে ক্ষুন্ন হয় এ কথা ভেবে যে তার মনটাকে মূল্য দেয়া হচ্ছে না; আবার যদি বলা হয় তোমার মনটি সুন্দর, তখন সে ক্ষুন্ন হয় এ ভেবে যে তাকে বোধ হয় রূপসী মনে করা হচ্ছে না। (প্রাণখোলা হাসি) এই যে… এখানে নারীর যেমন মন রয়েছে, নারী কেন সবারই মন রয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো কথাই বলা হয়নি। আমরা অবয়বের প্রশংসা করতে পারবো না? এখানে অবয়বেরই প্রশংসা করা হয়েছে। সৈয়দ হকের এ-আলোচনা অত্যন্ত অসৎ, অত্যন্ত অসৎ। তাঁর সমস্ত ব্যাখ্যাই অসৎ। তিনি নিজে নারীদেহকে নানাভাবে পীড়ন করেছেন তার লেখায়, এখন তিনি কপটভাবে নিয়েছেন নারীর পক্ষ। তিনি যে কয়েকটি প্রবচন আলোচনা বা অপব্যাখ্যা করেছেন সেগুলোই সব নয়। এর বাইরেও অনেক প্রবচন ছিলো, যেগুলো নানাভাবে আকর্ষণীয়, তাৎপর্যপূর্ণ এবং সমকালের বহু কিছু ব্যাখ্যা করে; তিনি সেগুলোর কথা বলেন নি।

দর্পণ: আরেকটি প্রবচন মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, আসলে গাধাকে পছন্দ করে’। এই প্রবচনটি উদ্ধৃত করে সৈয়দ হক বলেছেন আপনি যাদেরকে পছন্দ করেন তাদেরকে কি গাধা মনে করেন?

হুমায়ুন আজাদ: না , আমি যাদের পছন্দ করি তাদের গাধা মনে করি না। সৈয়দ হককেও আমি পছন্দ করি। তিনি কি ভাবেন তাকে আমি গাধা মনে করি? আজকাল সমাজের বিভিন্ন জায়গা যারা অধিকার করে আছে তারা সাধারণত অযোগ্যদের পছন্দ করে, তারা প্রতিভাবানদের দু-একটি প্রশংসা করে অযোগ্যদের বসায় বিভিন্ন স্থানে। এটা আমার একটি ছোটো কবিতার অংশ। আমার একটি কবিতা আছে এ-রকমের : মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে, আমার প্রতিভাকে প্রশংসা করলেও, আসলে ওই পুঁজিপতি গাধাটিকেই পছন্দ করো তুমি।‘ (প্রাণ খোলা হাসি) এটি কবিতার একটি লাইন। দেখা যাবে কোনো তরুণী কোনো প্রতিভাবান তরুণের প্রশংসা করছে, কিন্তু পছন্দ করছে একটি নির্বোধ ধনীর পুত্রকে, শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছে ওই ধনীর পুত্রটিকেই।

দর্পণ: আর একটি প্রবচন সৈয়দ হক উদ্ধৃত করেছেন ‘শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারো সাহায্যে স্বার্থ উদ্ধারের পারিশ্রমিক’ এবং তিনি এ প্রবচনটি উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, আপনিও পারিশ্রমিক পেয়েছেন কিনা শামসুর রাহমান-এর ওপর লিখে?

হুমায়ুন আজাদ: পেয়েছি কিনা এটা সৈয়দ হক শামসুর রাহমানের কাছে গিয়ে জেনে আসতে পারেন। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) সৈয়দ হক যে এতো রসবোধহীন মানুষ এটা আমার জানা ছিলো না। এটা আমার কাছে শ্রদ্ধার একটি বেশ চমৎকার সমকালীন সংজ্ঞা বলে মনে হয়। চারপাশে যদি আমরা চোখ মেলে দেখি তাহলে দেখা যাবে যে যাকে শ্রদ্ধা বলছি সে-শ্রদ্ধার সঙ্গে কিছু না কিছু স্বার্থ জড়িত আছে। কোনো রকম স্বার্থহীন শ্রদ্ধা কি এখন পাওয়া যায়? এখন তো অনেকেই নিয়মিতভাবে গুরু পরিবর্তন করে থাকে। এখন স্বার্থই বড়ো কথা। এটি যদি আমার কথা না হয়ে অন্য কোনো লেখকের মন্তব্য হতো, বা রবীন্দ্রনাথের হতো, তাহলে এটি খুবই প্রশংসিত হতো। এখানে এটি বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রদ্ধার একটি সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে। এ-জিনিস যিনি বুঝবেন না তাঁকে এটি বোঝানো বাতুলতা। সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে আমি খুবই উদ্বিগ্ন, তাঁর মগজে বোধ হয় কিছুটা পচন ধরেছে।

দর্পণ: সৈয়দ হক আপনার মধ্যে মৌলিক মূর্খতা খুঁজে পেয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন-

হুমায়ুন আজাদ: এককালে চমকপ্রদ এক ব্যাপার ছিলো কারো কথা তাকে ফিরিয়ে দেয়া, তখন এটা বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার বলে গণ্য হতো। এখন কারো কথা তাকে ফিরিয়ে দেয়াটা হাস্যকর, অনাধুনিকতা এবং মগজহীনতার লক্ষণ। আমার নয়, বরং সৈয়দ শামসুল হকের মগজহীনতা ও গৌণতা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি এখন এতো গৌণ যে একটি চমৎকার কথা সৃষ্টি করে আমাকে আক্রমণ করার মতো চিন্তাভাবনা এবং বাক্য তার নেই, তাই আমার বাক্যই ব্যবহার করেছেন আমাকে আঘাত করার জন্যে।

দর্পণ: এ প্রসঙ্গে জানতে চাইবো সৈয়দ হক যে কমেন্টগুলো করেছেন তার সাথে তাঁর সাহিত্যকর্মের বা লেখার সাথে কোনো সামঞ্জস্য পাওয়া যায়? সৈয়দ হকের রচনাকর্ম যদি আপনি পড়ে থাকেন তাহলে এর ভিত্তিতে কিছু বলুন।

হুমায়ুন আজাদ: সৈয়দ হকের মন্তব্যগুলো, আমি আগেই বলেছি, সম্পূর্ণ আত্মঘাতী। তিনি অনেকটা নিজেকেই নিজে আক্রমণ করেছেন। কারণ তার উপন্যাস, কবিতা, নাটকের মধ্যে আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি পাই, তার কলামের দৃষ্টিকোণ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে তিনি একটি মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলের ভূমিকা নিয়েছেন। আমি জানি না তিনি ক্রমশ মৌলবাদী থেকে আরো মৌলবাদী হবেন কিনা। যদি তিনি তা হতে থাকেন তাহলে তাঁর কলামটি সংগ্রাম বা ইনকিলাবে ছাপা হওয়াই ভালো। তিনি জামায়াত ধরনের কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন, তাতে তাকে ভালো মানাবে।

দর্পণ: সৈয়দ হকের বেশ কটি উপন্যাস নরনারী সম্পর্কসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষিত এসেছে এ সম্পর্কে আপনার জানা আছে?

হুমায়ুন আজাদ: কিছু পড়া আছে। সৈয়দ হকের অনেক উপন্যাস মূলত পর্নোগ্রাফি। মুক্তিযুদ্ধের যে-উপন্যাসগুলো তিনি লিখেছেন সেগুলোকেও তিনি ধর্ষণের উপাখ্যানে পরিণত করেছেন। তাঁর লেখা ‘খেলারাম খেলে যা’ নামের যৌন অপন্যাসটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি মেয়েকে বারবার ভোগ করা হয়েছে। তিনি একজন ভালো পর্নোঅপন্যাসিক। তাঁর দূরত্ব উপন্যাসে কলাভবনের ছাদে ‘রাজাপাওয়া যায় বলে উল্লেখ আছে।

দর্পণ: প্রসঙ্গত ডি এইচ লরেন্সের কথা বলা যায়, তিনিও তো বর্ণনার ব্যাপারে খোলাখুলি ছিলেন।

হুমায়ুন আজাদ: কোথায় ডি এইচ লরেন্স আর কোথায় সৈয়দ শামসুল হক, দুজনের তুলনা করা হাস্যকর।।

দর্পণ: আমরা এখন আর সৈয়দ হক সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই না। আপনার প্রবচনগুলো প্রকাশ করার পর যে পত্রিকাগুলো এ নিয়ে লেখালেখি করেছে তার একটির প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, ভিসি এবং কয়েকটি হলের ছাত্রী সংসদের নেত্রীর বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছে। আপনি কি সেই পত্রিকাটি পড়েছেন?

হুমায়ুন আজাদ: হ্যা, আমি পড়েছি।

দর্পণ: এ প্রসঙ্গে তাদের মন্তব্য সম্পর্কে কি আপনার বলার কিছু আছে?

হুমায়ুন আজাদ: প্রথমে বিচিত্রার ভূমিকাটি বিবেচনা করা যাক। বিচিত্রার প্রতিবেদনটি পড়ে মনে হয়েছে এটি কোনো সাহিত্যিক বা শৈল্পিক আলোচনা নয়; এটি দুরভিসন্ধিমূলক। বিচিত্রার সঙ্গে আমার সম্পর্ক জানলে বোঝা যাবে তারা এ কাজ কেনো করেছে? তারা আমাকে আক্রমণ করেছে, তার কারণ হচ্ছে শামসুর রাহমানকে নিয়ে যখন দৈনিক বাংলা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছিলো, তাতে আমি প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলাম। আমরা বিচিত্রা, দৈনিক বাংলায় কখনো লিখবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; পরে অনেকে সে-সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেছে, কিন্তু আমি কখনো সে-সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি নি। তাই বিচিত্রা আমার ওপর ক্ষিপ্ত। এ-পত্রিকার একব্যক্তি আমার সাথে বেয়াদবির কারণে কয়েক মাস চাকরিচ্যুত ছিলেন। এটা তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীদের কাজ বলে মনে করি। বিচিত্রা, দৈনিক বাংলা স্বৈরাচারের পক্ষে, আমি স্বৈরাচারের বিপক্ষে; তাই তারা আমার বিরুদ্ধে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। (কিছুক্ষণ থেমে) এখানে যে-কটি সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে, তার মধ্যে বাংলা বিভাগের সভাপতি আবুল কালাম মঞ্জুর মোর্শেদ আমাকে বলেছিলেন যে ওসব তিনি বলেন নি। অন্য সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। উপাচার্যের নামে যে-উক্তিটি আছে আমি আশা করি তিনি তা বলেন নি। কোনো দায়িত্বশীল মানুষ এমন দায়িত্বহীন কথা বলতে পারেন না। শিক্ষক সমিতির সভাপতির উক্তিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও শিক্ষকদের লেখার স্বাধীনতার বিরোধী। এ-উক্তিটি আশা করি তিনি প্রত্যাহার করবেন, নইলে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে কোনো কথা বলার অধিকার তার থাকবে না।

দর্পণ: আমরা এ সম্পর্কে আর কথা বলবো না। প্রবচনগুলোর শিল্পমূল্য সম্পর্কে আপনার ধারণা জানতে চাই। আপনি বলেছেন এই ধরনের প্রবচন বাঙলা সাহিত্যে এই প্রথম। প্রথমে আমি জানতে চাচ্ছি যে বিশ্বসাহিত্যে এ ধরনের প্রবচন লেখার কোনো প্রবণতা আছে কিনা? এবং আপনি এখনও কীভাবে এপ্রবচনগুলো লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন?

হুমায়ুন আজাদ: ফরাশি লেখকেরা প্রবচন রচনায় বিশেষ উৎসাহী ও সফল। ইংরেজ লেখকরাও প্রচুর প্রবচন রচনা করেছেন। বাঙলায় যে প্রবচন নেই তা নয়, আমাদের লৌকিক প্রবচন বেশ সমৃদ্ধ। (প্রাণখোলা হাসি) আমার এ-প্রবচন ক’টিকে বলতে পারি সাহিত্যিক প্রবচন, সচেতনভাবে প্রবচন রচনার এটিই সম্ভবত প্রথম প্রয়াস। তবে আমি নিজেকে প্রথম বলে গণ্য করি না; আমাদের প্রধান লেখকদের রচনাবলিতে প্রচুর প্রবচনের সন্ধান পাই, যদিও তারা সেগুলোকে এক দুই তিন করে বিন্যস্ত করেন নি।

আমরা শুধু প্রবচন রচনা করতে পারি বিশাল প্রবন্ধ রচনা না করে। আমাদের বিভিন্ন উপলব্ধি, ব্যাখ্যা, আবেগ ইত্যাদি আমরা সংহত আকারে প্রকাশ করতে পারি। প্রবচন রচনার পেছনে যা কাজ করেছে তা হচ্ছে আমার শ্লেষ, বিদ্রুপ এবং গভীর সত্য প্রকাশ করার প্রবণতা। আমি দৈনন্দিন জীবনেও তা করে থাকি। এমন কোনো এলাকা নেই যে-এলাকা সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য নেই। সেজন্য আমি মন্তব্যগুলো লেখার কথা ভাবি; আমার এক ছাত্রকে আমি এগুলো প্রকাশের জন্য দেই। আমি জানতাম না যে এগুলো নিয়ে এমন আলোড়ন হবে।

দর্পণ: মনে করা হয় প্রবচন হাজার বছরের মানুষের জীবন উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এগুলো ধরে রাখে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি ড. হুমায়ুন আজাদের ‘প্রবচনলেখার কোনো অধিকার নেই—।

হুমায়ুন আজাদ: এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যে কোনো আঙ্গিকে লেখার অধিকার আমার আছে। যারা এসব কথা বলেন তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়।

দর্পণ: আমাকে একজন বিশিষ্ট লেখক বলেছেন যে কিছু প্রবচন নাকি আপনার নিজের নয়। এগুলো আপনি আত্মসাৎ করেছেন। ‘পুঁজিবাদী ঈশ্বরের নাম টাকা এবং মন্দিরের নাম ব্যাংক’, এ কথাটি নাকি বোদলেয়রের?

হুমায়ুন আজাদ: কে ওই বিশিষ্ট লেখক? আমি সচেতনভাবে কারো উক্তি গ্রহণ করি নি। বোদলেয়রের এমন কোনো উক্তির কথা আমার জানা নেই; যদি বোদলেয়র এমন কথা বলে থাকেন তাহলে আমি আনন্দিত এজন্যে যে তার সাথে আমার চিন্তার মিল রয়েছে।

দর্পণ: আপনার সম্পর্কে কেউ কেউ বলে থাকেনআপনি মূলত চমক সৃষ্টি করে বিতর্কিত হবার জন্য সময়ে সময়ে চটকদার কথাবার্তা বলে থাকেন। অষ্টপ্রহর একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হয়ে থাকতেই নাকি আপনার সমূহ আনন্দ?

হুমায়ুন আজাদ: আমি বিতর্কিত হতে চাই এটা ঠিক নয়। আমাদের সমাজ এতোই সংকীর্ণ যে এখানে যে কোনো সত্য কথাই বিতর্ক সৃষ্টি করে। আমার লেখায় প্রথাবিরোধী কিছু মর্মান্তিক সত্য থাকে, তাই বিতর্ক সৃষ্টি করে। আমি কোনো প্রথাকেই বিনা প্রশ্নে মেনে নিই না। যারা এ-ধরনের কথা বলেন আমি চাই তাঁরা কিছু চমকপ্রদ কথা বলে বিতর্ক সৃষ্টি করুন। দেখবেন তাঁদের কতো স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ে।

দর্পণ: আপনি ইচ্ছে করে বিতর্কিত হতে চান, এ রকম অভিযোগ যাদের তাদের অনেকে কবিতা পরিষদের প্রবন্ধ পাঠের বিষয়টি টেনে আনেন। আপনি নাকি বিতর্কিত অংশ পড়বেন না এমন কথা দিয়ে ছিলেন কবিতা পরিষদকে, কিন্তু মঞ্চে উঠে কথা রাখেন নি; তাই গণ্ডগোল লেগে যায়—-।

হুমায়ুন আজাদ: যারা এ কথা বলে তারা পুরোপুরি মিথ্যেবাদী। ঘটনা হচ্ছে আমার প্রবন্ধের প্রথম খসড়ার এক জায়গায় প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে কয়েকজনের নাম ছিলো। প্রবন্ধটি যখন কবিতা পরিষদের একটি সভায় আলোচিত হয়, তখন কেউ কেউ তালিকা থেকে কয়েকজনের নাম বাদ দিতে বলেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল বলা যাবে না; কারণ তারা তাদের বন্ধু। সেজন্য আমি বলি যে ওই তালিকাটি অপরিহার্য নয়, তাই ওই নামগুলো বাদ যেতে পারে। আমার প্রবন্ধের যে-কোনো অংশ যে-কোনো মুহূর্তে বাদ দেয়ার অধিকার আমার আছে। আর একটি অংশে ষাটের দশকের কয়েকজন গৌণ কবির নাম ছিলো। আমি সে নামগুলোও বাদ দিই। কিন্ত তারা আমার মুখে মঞ্চ থেকে তাদের নাম শুনতে চায়। তাদের দুঃখ এতো হইচই করেও কবি হিশেবে তারা আমার স্বীকৃতি পেলেন না এজন্যই তারা এসব মিথ্যে রটনা করে ফেলেন।

দর্পণ: কবিতা পরিষদে আপনি ছিলেন। শেষে আপনি কবিতা পরিষদ ছেড়ে চলে এসেছেন। কবিতা পরিষদের ভূমিকা, বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

হুমায়ুন আজাদ: কবিতা পরিষদ সম্পর্কে অন্তত দু-তিন জায়গায় আমি মন্তব্য করেছি। এখন মন্তব্য করতেও আমার খারাপ লাগে।

মন্তব্য করুন