মুক্তচিন্তা আন্দোলনইয়ং বেঙ্গলমি. উইলসনের নিকট ডিরোজিওর ঐতিহাসিক চিঠি

মি. উইলসনের নিকট ডিরোজিওর ঐতিহাসিক চিঠি

ধর্মানুভূতিতে আঘাতের নামে নিপীড়নের ইতিহাস নতুন নয়। পৃথিবীতে এরকম অজস্র নিপীড়নের ঘটনা আছে। যার বেশিরভাগই আত্মঘাতী। বাংলা তথা ভারতবর্ষের মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। যাকে বলা যায় অমূল্য সম্পদ। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কথা বলে তাকে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়। বাংলার সর্বকনিষ্ঠ ও প্রথম বরখাস্ত হওয়া কলেজ শিক্ষকের লেখা 'কৈফিয়ত চিঠিটি' পড়ুন।

মি. উইলসনের নিকট ডিরোজিওর ঐতিহাসিক চিঠি

ধর্মানুভূতিতে আঘাতের নামে নিপীড়নের ইতিহাস নতুন নয়। পৃথিবীতে এরকম অজস্র নিপীড়নের ঘটনা আছে। যার বেশিরভাগই আত্মঘাতী। বাংলা তথা ভারতবর্ষের মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। যাকে বলা যায় অমূল্য সম্পদ। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কথা বলে তাকে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়। বাংলার সর্বকনিষ্ঠ ও প্রথম বরখাস্ত হওয়া কলেজ শিক্ষকের লেখা 'কৈফিয়ত চিঠিটি' পড়ুন।

হিন্দু ধর্ম-বিশ্বাস ও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে ১৮৩১ সালের ২৩ এপ্রিলে কলকাতার তৎকালীন ‘হিন্দু কলেজ’ এর শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর বিরুদ্ধে বিচার সভার আয়োজন করা হয়। কলেজ পরিচালনা পর্ষদ বিচারে ডিরোজিওকে দোষী সাব্যস্ত করে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তারা বরখাস্তের নোটিশ দেয়ার সাহস করেনি। কলেজের পরিদর্শক ডক্টর উইলসনকে অনুরোধ করা হয় তিনি যেন ডিরোজিওকে পদত্যাগ করার জন্য বলেন। ডক্টর উইলসন ডিরোজিওকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নসহ পদত্যাগের অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র লিখেন। চিঠি পেয়ে ডিরোজিও প্রথমে পদত্যাগ পত্র পাঠান, পরের দিন উইলসনের প্রশ্নগুলোর জবাব দেন। জবাবটি ছিলো ইংরেজি ভাষায়।

লেখক বিনয় ঘোষ তার ‘বিদ্রোহী ডিরোজিও’ বইতে চিঠির অনুবাদ করেন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। ‘বিদ্রোহী ডিরোজিও’ বই থেকে ‘অবিশ্বাস’ এর জন্য অনুবাদকৃত চিঠিটি কম্পোজ করেছেন মহিউদ্দিন শরীফ


 

এইচ. এইচ. উইলসন মহাশয় সমীপেষু

‘প্রিয় মহাশয়,
গতকাল সন্ধ্যায় আপনার চিঠি পেয়ে তখনই জবাব দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু কয়েকটি জরুরী কাজের জন্য দিতে পারিনি। সেজন্য মার্জনা করবেন। আমার ব্যাপারে আপনি এখনও এতদূর আগ্রহ প্রকাশ করছেন দেখে সত্যিই আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনার প্রশ্নগুলি আমার ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্রের দিক থেকে এত গুরুত্বপূর্ণ যে তার উত্তর স্বভাবতঃই একটু দীর্ঘ হবে। এই দীর্ঘ উত্তর আপনাকে কষ্ট করে পড়তে হবে ভেবে লজ্জাবোধ করছি। তবু আপনার মতো একজন স্বনামধন্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কাছে এরকম একটি দীর্ঘ চিঠিতে অনেক গুরুবিষয় সম্বন্ধে মতামত প্রকাশের সুযোগ যে আপনি দিয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর
কারও কাছে এমন মতামত আমি কোনদিন প্রকাশ করিনি যাতে আমাকে নাস্তিক মনে করা সম্ভব। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব সম্বন্ধে মন খুলে আলোচনা করা যদি অপরাধ হয়, তা হলে অপরাধী বলে আমি নিজেকে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত নই। এ-বিষয়ে নানামুনির নানামত আছে। সেইমত নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মধ্যে-মধ্যে উন্মুক্ত মনে আলোচনা করেছি। যারা আস্তিক তাদের কথা বলেছি, যারা নাস্তিক তাদের কথাও বলেছি। যারা আস্তিক-নাস্তিক প্রশ্নই উত্থাপন করতে চান না তাদের কথাও উল্লেখ করতে ভুলিনি। আমি জানি না, এরকম একটি গুরুবিষয় নিয়ে এইভাবে আলোচনা করার মধ্যে অন্যায় কোথায়! একপক্ষের কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করব, অন্যপক্ষের যুক্তি শুনব না বা বিচার-বিবেচনা করব না, এইটাই কি কোনবিষয়ে জ্ঞানলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা? কি করে তাহলে সেই জ্ঞান পূর্ণতালাভ করবে? আর বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, তার ভিতটাই বা কতটুকু দৃঢ় হবে যদি না প্রতিপক্ষের মতামত বিশ্লেষণ করা হয় এবং তার যুক্তি খণ্ডন করার মতো ক্ষমতা থাকে।

এদেশের একদল তরুণের শিক্ষার খানিকটা দায়িত্ব কিছুদিনের জন্য বহন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একদল গোঁড়া আপ্তবাক্যবাদী অন্ধবিশ্বাসী তৈরি না করে তাদের সত্যিকার সুশিক্ষিত যুক্তিবাদী মানুষ তৈরি করব। তাই সকল বিষয়ে সর্বপ্রকারের মতামত নিয়ে অবাধে আলোচনা করতে আমি তাদের উৎসাহ দিতাম। আমার বিশ্বাস, তা না করলে কোনো মানুষেরই অব্যক্ত প্রতিভা ও সুপ্ত মানসিক শক্তির পূর্ণ প্রকাশ হয় না। লর্ড বেকনের ভাষায় বলা যায়, ‘If a man will begin with certainties, he shall end in doubts.’ কিন্তু তাতেও দেখলাম যে এক সংশয় থেকে মনে আর এক নতুন সংশয়ের উদয় হয় এবং অবশেষে সংশয়াকুল চিত্তের দোদুল্যমান আর শেষ হয় না কোনদিন। সেইজন্য আমি ছাত্রদের দার্শনিক হিউমের রচনাবলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, কারণ হিউম অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও শাণিত যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন। কেবল তাই করেই আমি ক্ষান্ত হইনি। ডক্টর রীড ও স্টুয়ার্টের প্রতিযুক্তি ও উত্তর হিউম প্রসঙ্গে তাদের পড়িয়েছি। হিউমের যুক্তির এত জোরালো প্রতিবাদ আজ পর্যন্ত আর কেউ করতে পারেননি। এবং ‘This is the head and front of iny offending.’ মজ্জাগত ধ্যানধারণার অস্তিত্বের সংকট যদি আমার সেই শিক্ষার ফলে নড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য আমি কি অপরাধী? তরুণদের মনে কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাস সৃষ্টি করা কোনদিন আমার উদ্দেশ্য ছিল না এবং সেটা আমার ক্ষমতার বহির্ভুত ব্যাপার। আমার এই কথা থেকে বুঝতে পারবেন, ছাত্ররা যদি কেউ নাস্তিক হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য নিন্দাবাদ যেমন আমার প্রাপ্য, তেমনি যারা আস্তিক হয়েছে তাদের জন্য সাধুবাদও আমি দাবি করতে পারি।

সত্যি কথা বলতে কি, মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও মতের পরিবর্তনশীলতা সম্বন্ধে আমি নিজে এত বেশি সজাগ যে অত্যন্ত ছোটখাট বিষয়েও আমি কখনও একটি নির্দিষ্ট মত প্রকাশ করি না। অনুসন্ধিৎসার অনন্ত সমুদ্রে দুজ্ঞেয় সত্যের দ্বীপে যাত্রা করাই জ্ঞানান্বেষণের শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে আমার ধারণা। আমার নিজের মনের গড়নও তাই। প্রশ্নহীন সংশয়হীন, মন যত শীঘ্র জড়ত্বের জালে জড়িয়ে পড়ে মানসিক অপমৃত্যু বরণ করে, প্রশ্নকাতর সংশয়াতুর মন তত সহজে মানুষকে সন্দেহবাদী বা নাস্তিক্যবাদী করে তোলে না। এটা সত্য নয়, ওটা সত্য, অথবা আমার যা বিশ্বাস সেইটাই ধ্রুব সত্য, এমন কথা হলফ করে কোনো সত্যসন্ধানী কখনই বলবেন না।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর
পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করা ও তাদের আদেশ পালন করা আমি নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করি কি না? আপনার এই প্রশ্নে সত্যিই আমি হতবাক হয়ে গেছি। জীবনে কোনদিন কেউ আমাকে এই ধরনের একটা অস্বাভাবিক প্রশ্ন যে করবেন তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি পিতামাতাকে শ্রদ্ধেয় মনে করব না, অথবা তাদের আদেশ অমান্য করা অন্যায় ভাবি না, আমার বিরুদ্ধে এতদুর হীন অপপ্রচারে যারা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন তাদের কেবল ঘৃণ্য মনে করেও আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আপনি বয়ঃজ্যেষ্ঠ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, এ-বিষয়ে আপনাকে কি বলব বুঝতে পারছি না। আমি যদি পিতৃহীন না হতাম তাহলে আমার পিতাই এই অপপ্রচারের উচিত জবাব দিতে পারতেন। এই বলে জবাব দিতেন যে যারা আমার বিরুদ্ধে এই কুৎসিত অভিযোগ করেছেন অথবা অন্য যারা এদিক থেকে নিজেদের মহাত্মা বলে মনে করেন, তাদের কারও চেয়ে আমি কম পিতৃমাতৃভক্ত নই। হয়ত খোঁজ করলে দেখা যাবে, তাঁদের অনেকের চেয়ে পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য জীবনে আমি অনেক বেশি পালন করেছি। সুতরাং আমি আমার ছাত্রদের যে এরকম শিক্ষা দিতে পারি না তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বরং তার বিপরীতটাই করেছি। ছাত্রদের মধ্যে যখনই এই ধরনের কোনো মনোভাবের আমি আভাস পেয়েছি, তখনই তাদের রীতিমত ধমক দিয়ে পিতামাতার বাধ্য হতে বলেছি। তবে সমাজে পিতামাতার অনেক তথাকথিত বাধ্য সন্তানকে দেখেছি কুলাঙ্গারে পরিণত হতে, তাই মধ্যে-মধ্যে তাদের সাবধান করে দিয়েছি যে পিতামাতার প্রতি বাধ্যতার মুখোস পরে অমানুষ হওয়ার চেয়ে কিছু অবাধ্য হয়েও মানুষ হওয়া শ্রেয়। কিন্তু পিতামাতার প্রতি ছেলেদের ব্যবহার সম্বন্ধে আমি যে বরাবর কতখানি সজাগ ছিলাম তার দুটি দৃষ্টান্ত আপনার কাছে উল্লেখ করছি। যে দু’জন ছাত্র সম্বন্ধে বলছি তারা কলকাতাতেই থাকে, যে-কোনো সময় তাদের ডেকেও আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। মাস দু’তিন আগে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় নামে আমার একজন ছাত্র (সম্প্রতি তাকে নিয়ে শহরে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল) আমাকে জানায় যে বাড়িতে পিতার নিষ্ঠুর আচরণ তার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছে। বাড়ি না-ছাড়লে তার উপায় নৈই। আমি যদিও ঘটনাটি সব জানতাম, তাহলেও তাকে বাড়ি ছাড়তে নিষেধ করে বুঝিয়ে বললাম, “অত অধৈর্য হলে চলবে না, মা-বাবার আচরণ কিছুটা অপ্রীতিকর মনে হলেও সহ্য করা উচিত। বাড়ি থেকে তারা যদি তোমাকে তাড়িয়ে না দেন তাহলে নিজে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেও না।” আমার কথা শুনে দক্ষিণা বাড়িতেই রইল, কিন্তু দুঃখের বিষয় বেশিদিন থাকতে পারল না। দু’তিন সপ্তাহ আগে আমাকে না জানিয়ে পিতৃগৃহ ছেড়ে আমারই বাড়ির কাছে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হবার পর আমি জানতে পারি। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমাকে না জানিয়ে তুমি বাড়ি ছাড়লে কেন?” তখন সে উত্তর দিল, “আপনি তো তাহলে কিছুতেই আমাকে বাড়ি ছাড়তে দিতেন না।” এই গেল দক্ষিণারঞ্জনের কথা। মহেশচন্দ্র সিংহ নামে আর একটি ছাত্র তার পিতা ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ় ব্যবহার করে, খুড়ো উমাচরণ বসু ও সহোদর নন্দলাল সিংহকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে দেখা করতে আসে। আমি তার অশোভন আচরণের জন্য তিরস্কার করে বলি যে অনুতপ্ত হয়ে পিতার কাছে যদি সে ক্ষমা না চায় তাহলে তার সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্ক রাখব না। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারি, কিন্তু করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

আপনার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর
ভাইবোনের বিবাহকে সামাজিক অপরাধ বলে আমি মনে করি কি-না? হ্যাঁ, নিশ্চয় আমি তা অসঙ্গত বলে মনে করি। এরকম একটা আজগুবি বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আমি আলোচনা করতে পারি, একথা আপনারা ভাবলেন কি করে? অবাক হয়ে ভাবি, আমার বিরুদ্ধে এরকম সব বিচিত্র অভিযোগ কোন শ্রেণীর উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিষ্কৃত হতে পারে? বিবিধ বিষয় নিয়ে যাদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন আলোচনা হয়, তাদের মধ্যে কেউ যে এরকম কুৎসিত মিথ্যা রচনা করবেন তা আমার মনে হয় না। আমার ছাত্রদের আমি বিলক্ষণ চিনি ও জানি। তাদের মধ্যে এমন মুখ কেউ নেই যে ভুল বুঝে এই-সব কথা রটনা করবে, অথবা এমন ধূর্তও কেউ আছে বলে আমি জানি না যে স্বেচ্ছায় আমার মতামত বিকৃত করে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করবে। আমার তাই মনে হয়, একশ্রেণীর কাপুরুষ চরিত্রহীন লোক আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অপপ্রচারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। মিথ্যাই তাদের উপজীব্য। ধর্মবিষয়ে কেউ স্বাধীন চিন্তা করলে তাকে সমাজের লোক নাস্তিক ও নরাধম বলতে পারে, একথা জানি ও বুঝি। কিন্তু অন্য যে-সব প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন সেগুলি যে এইভাবে কোনো সভ্য সমাজে কোনো সভ্য মানুষের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্য উদ্ভাবিত হতে পারে, তা আপনার চিঠিতে না জানলে আমার পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব হত না। আপনি সহৃদয় ব্যক্তি, তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, নির্ভয়ে এইসব গুজব ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে ঘোষণা করবেন। গুজব রটনাকারীদের বলবেন’ I am not a greater monster than most people’. গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি শুনেছি একদল লোক অফু্রন্ত উৎসাহ নিয়ে আমার সম্বন্ধে নানারকমের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করতে আরম্ভ করেছেন। কেবল আমার সম্বন্ধে নয়, আমার পরিবার সম্বন্ধেও তাদের কুৎসিত কল্পনা স্কন্ধকাটা প্রেতেব মতো ডানা মেলতে শুরু করেছে। একটি কাহিনী হল, আমার ভগ্নীর সঙ্গে (কেউ বলেছেন আমার মেয়ের সঙ্গে, যদিও আমার কোনো মেয়ে নেই) একজন হিন্দু যুবকের নাকি শীঘ্রই বিবাহ হবে। খবর নিয়ে জেনেছি, বৃন্দাবন ঘোষাল নামে একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ এই গল্পটি বেশ শ্রুতিরোচক ভাবে সর্বত্র প্রচার করে বেড়ায়। আমি শুনেছি, এই ঘোষালের পেশা হল, প্রতিদিন সকালে উঠে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যতসব আজগুবি খবর সংগ্রহ করা এবং ফুলিয়ে-ফাপিয়ে রসিয়ে-রসিয়ে সর্বত্র তাই পরিবেশন করা। এই ঘোষালের মতো কিছু পেশাদাব গুজব-রসিক চেষ্টা করলে রাতারাতি শিবকেও যে বাঁদর বানিয়ে ফেলতে পারে তাতে আর আশ্চর্য কি? যাই হোক, এ-সম্বন্ধে আর কিছু আমি বলতে চাই না, কারণ অপবাদ বা মিথ্যা গুজব খণ্ডন করার মতো নির্বুদ্ধিতা আর কিছু নেই। এসবের উৎপত্তি যেমন অস্বাভাবিক, অপমৃত্যুও তেমনি স্বাভাবিক।

আপনার প্রশ্নের উত্তর এখানেই শেষ করলাম। এখন আমি আপনাকে সবিনয়ে একটি প্রশ্ন করব। মিথ্যা জনরোষের ভয়ে অথবা কুৎসা-প্রচারকদের তোষণের জন্য, আমাকে কলেজ থেকে কর্মচ্যুত করা কি আপনাদের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিদের পক্ষে সঙ্গত হয়েছে? একথা অবশ্য ঠিক যে আপনাদের সভার কার্যবিবরণের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যখন মিথ্যা জনরোষ রটে তখন তারই ভিত্তিতে যদি তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেটা মিথ্যাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয় না কি? কেবল জনরোষ শান্ত করার জন্য কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে কর্মচ্যুত করতে বাধ্য হয়েছেন, একথা মেনে নিতে আমি রাজি নই। আগে থেকেই তারা বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন আমাকে তাড়াবার জন্য। অন্ধ ধর্ম-গোঁড়ামিই আমার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছে। তা না যদি হত তাহলে এরকম অভিনব কৌশলে, সমস্ত সৌজন্য ও শালীনতাবোধ বিসর্জন দিয়ে, এইভাবে তারা আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতেন না। তাদের এই আচরণের কথা যারাই শুনেছেন তারাই গভীর বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ্যে অবিচারের প্রতিবাদ করতেও আমার প্রবৃত্তি হয় না, কারণ প্রতিবাদ করলে পরোক্ষে তাদের মতামতের মর্যাদা দেওয়া হয়। এটুকু মর্যাদাও তাদের প্রাপ্য বলে আমি মনে করি না।। সুদীর্ঘ চিঠির জন্য আপনার কাছে আবার ক্ষমা প্রার্থনা করছি, এবং আমার জন্য যে এতসব ঝঞ্চাট আপনাকে সহ্য করতে হল সেজন্য সসংকোচে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।

ইতি

আপনার একান্ত অনুগত,
এইচ, এল ভি ডিরোজিও

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন