বিশ শতকের শুরুতে মুক্তির মশাল হাতে আলোকিত পথ নির্মাণের জন্য সৃষ্টি হওয়া ‘শিখাগোষ্ঠী’র অন্যতম শিখা কাজী আবদুল ওদুদ। ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন নদীয়া বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী সৈয়দ হোসেন প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ে কলকাতা রেলওয়েতে সাধারণ চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে হাওড়া স্টেশন মাস্টার হিসেবে শেষ করেন। মা খোদেজা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। আবদুল ওদুদের নানা ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি, জোতদার। তার নাম পাচু মোল্লা। পাচু মোল্লার দুই ছেলে দারোগা ও এক ছেলে শিক্ষা বিভাগের বড় চাকুরে ছিলেন।

পিতৃ পরিবারে সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য না থাকলেও মামাদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত আবদুল ওদুদ ছোটবেলা থেকে শিক্ষা সাহিত্যের প্রতি প্রবলভাবে আগ্রহী ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় লেখালেখিতে সুনাম অর্জন করেছেন। ছাত্রজীবনের শুরু হয় নানার বাড়ির পাশে জগন্নাথপুর মাইনর স্কুলে। এরপর ১৯০৯ সালে নরসিংদীর সাটির পাড়া হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। অষ্টম ও নবম শ্রেণী শেষ করেন ঢাকা জেলার মুড়াপাড়া হাই স্কুলে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে মাসিক দশ টাকা বৃত্তি ও রৌপ্যপদকসহ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আই.এ. পাশ করে ১৯১৬ সালে মামাত বোন জমিলা খাতুনের সাথে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। ১৯১৭ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৯১৮ সালে ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘মীর পরিবার’ নামের গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পর তৎকালীন সাহিত্য সমাজের দৃষ্টি কাড়েন আবদুল ওদুদ। এর পরের বছরই প্রকাশ করেন উপন্যাস ‘নদীবক্ষে’। একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ. পাশ করেন।

এসময় কিছুদিন কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে বসবাস করেন। এখানে কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো। তখন যুদ্ধফেরত কাজী নজরুল ইসলামও আড্ডায় অংশ নিতেন। আড্ডাসূত্রে নজরুলের সাথে পরিচিত হন কাজী আবদুল ওদুদ। কিশোর বয়সে লেখালেখি শুরু করা আবদুল ওদুদ সাহিত্য সমিতিতে কবি সাহিত্যিকদের সাহচর্যে আরো অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এখানে তার সাথে পরিচয় হয় পরবর্তী জীবনের কর্মযোগী প্রতিথযশা চিন্তাবিদ আবুল হুসেনের সাথে।

লেখাপড়া শেষ করে ১৯২০ সালে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষক পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আবুল হুসেন। এসময় মুসলমান সমাজের অগ্রযাত্রার ইচ্ছায় দু’জন মিলে পত্রিকা ও সংগঠন প্রতিষ্ঠার কাজে মনোনিবেশ করেন।

১৯২৬ সালে আবুল হুসেনের নেতৃত্বে যখন মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আবদুল ওদুদ ছিলেন তার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা। মূলত এ সময় তার চিন্তা ভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের স্রোতে তার সাহিত্যচর্চা আরো সমৃদ্ধ হতে থাকে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকা প্রকাশনায় তার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯২৭ সালে শিখার প্রথম সংখ্যায় ‘বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সমস্যা’ শিরোনামে তার লেখা বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালে দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘বাংলার জাগরণ’। এর পরের বছর তৃতীয় সংখ্যায় ‘বাংলা সাহিত্য চর্চা’ নামে আরো একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।

আবদুল ওদুদ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’কে দেখতেন স্বদেশপ্রেমে জাগ্রত একটি জাতীয়তাবাদী কর্মতৎপরতা হিসেবে। যার মূল উদ্দেশ্য বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধির মুক্তি ঘটিয়ে দেশের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত করা। বলা বাহুল্য তখনকার সমাজে হিন্দুরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে যতটা এগিয়ে ছিলো, মুসলমানরা ছিলো ঠিক ততটাই পিছিয়ে। শিক্ষা বলুন আর জাগরণ বলুন, হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের সময়ের পার্থক্য ছিলো প্রায় একশ বছর। আবদুল ওদুদরা সময়ের এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।

কাজী আবদুল ওদুদের প্রেরণার উৎসে ছিলো ঊনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সৃষ্টি হওয়া নবজাগরণ। তিনি মনে করতেন বঙ্গে চিন্তার শৃঙ্খল ভাঙা শুরু হয় রামমোহনের হাত ধরে। পরিবর্তনের এমন দমকা হাওয়া এর আগে কখনো দেখা যায়নি। রামমোহনের সেই নবজাগরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের মন ও মননকে স্বদেশমুখী করতে উদ্যোগী হওয়ার সাহস পান। তবে স্বদেশপ্রেম নিয়ে সতর্কও ছিলেন আবদুল ওদুদ।  স্বদেশপ্রেম ততক্ষণ পর্যন্ত মঙ্গলজনক, যদি তা বিশ্ববিমুখ না হয়; নিজ দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তখনই একনিষ্ঠভাবে কাজ করা সম্ভব, যখন বিশ্ব বিচিত্রতার সাথে স্বদেশপ্রেমের সংযোগ স্থাপিত হবে – এমন ভাবনা পোষণ করতেন আবদুল ওদুদ।

তার সমুদয় রচনায় মানবপ্রেম, জ্ঞানপ্রেম, চিন্তাপ্রেমের জয়গান গেয়েছেন তিনি। বাঙালি মুসলমানকে তিনি বলেছেন ‘সম্মোহিত মুসলমান’। সম্মোহনই বাঙালি মুসলমানের উন্নতির অন্তরায় এবং এজন্য তিনি বলেছেন মুসলমানরা যেন বহু ছোট ছোট ঈশ্বর পূজা বন্ধ করে মহাকায় কোন কল্পিত মূর্তির পূজায় আটকে না থাকে। আবদুল ওদুদ মনে করেন মুসলমানদের নবী মুহম্মদ কেবলই একজন রক্ত মাংসে গড়া ব্যক্তি, যিনি পুরাতনে আটকে থাকেননি। অথচ তার ভক্তরা আজ মুহম্মদে আটকে আছে। তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে মুহম্মদের প্রতি সঠিক প্রেম প্রদর্শিত হচ্ছে না। বরং নতুন নতুন চিন্তা ও যুগোপযোগী কর্মে নিবিষ্ট হওয়ার মাধ্যমেই মুহম্মদ প্রেম সিদ্ধ হবে।

আবদুল ওদুদ মুসলমানদের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন নিজেকে একজন মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে। তিনি তাদের মাঝে থেকে তাদের চিন্তায় ঢোকার চেষ্টা করেছেন। কতটুকু সফল হয়েছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা আলোচনার বিষয়। কিন্তু শিখা গোষ্ঠীর আবদুল ওদুদ তার চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বই। এর মধ্যে ১৯৫১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন ‘শাশ্বত বঙ্গ’ বিশেষভাবে আলোচিত। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলোয় মুসলমানদের চিন্তার দেয়ালে চূড়ান্ত আঘাত হানার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও তার চিন্তাশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় বাংলার জাগরণ (১৯৫৬), কবিগুরু গ্যেটে (১ম ও ২য় খন্ড ১৯৪৬), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম খন্ড ১৯৬২, ২য় খন্ড ১৯৬৯), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৯৬৬) গ্রন্থে।

তিনি নাটকও রচনা করেন। তার রচিত নাটক দুটির নাম পথ ও বিপথ (১৯৩৯) এবং মানব-বন্ধু (১৯৪১)। কাজী আবদুল ওদুদের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, প্রবন্ধ ও সাহিত্যসমালোচনা: নবপর্যায় (১ম খন্ড ১৩৩৩, ২য় খন্ড ১৩৩৬), সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৯৩৫), Fundamentals of Islam (১৯৫০), State and Literature (১৯৫৭), Tagore’s Role in the Reconstruction of Indian Thought (১৯৬১), আজকার কথা (১৯৪১), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৯৫১), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৯২৭), নজরুল-প্রতিভা (১৯৪৯), শরৎচন্দ্র ও তারপর (১৯৬১); জীবনীগ্রন্থ: অনুবাদ গ্রন্থ: Creative Bengal (১৯৫০)।

কর্মজীবনের শেষেরদিকে ১৯৪০ সালে টেক্সট বোর্ডের সেক্রেটারি রূপে কলকাতায় যান। এর কিছুদিন পর রেজিস্ট্রার অব পাবলিকেশন্স এর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হলে তিনি কলকাতায় স্থায়ী হন। দেশ বিভাগ পরবর্তী জটিলতায় সরকারের উপর মহলের অন্যায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদের দুই বার সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন এবং দু’বারই প্রতিবাদে জয়ী হয়ে চাকরিতে ফিরে আসেন। শেষে ১৯৫২ সালে চূড়ান্তভাবে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৫৪ সালে তার স্ত্রী জমিলা খাতুনের মৃত্যু হয়। এরপর একা জীবনে তিনি শুধু লেখালেখি আর বক্তৃতা দিয়ে কাটিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতীতে ‘বাংলার জাগরণ’ সম্পর্কে এবং ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরৎ স্মৃতি বক্তৃতামালা’ দান করেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে ‘শিশির কুমার পুরস্কার’ অর্জন করেন। এর অল্প কিছুদিন পর ১৯৭০ সালের ১৯ মে বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আনার লড়াইয়ের একনিষ্ঠ সংগ্রামী কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র:
১. কাজী আবদুল ওদুদ রচিত ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থের সর্বশেষ অনুচ্ছেদ।
২. সম্মোহিত মুসলমান, কাজী আবদুল ওদুদ
৩. নির্বাচিত শিখা, মুসলিম সাহিত্য সমাজ
৪. কাজী আবদুল ওদুদ, বাংলা পিডিয়া

মন্তব্য করুন