ছেলেকে নিয়ে বাবার অনেক ইচ্ছে, অসিয়ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অসিয়ত তিনটি। প্রথমত, ছেলে যেন আজীবন দাড়ি রাখে। দ্বিতীয়ত, ছেলে যেন লেখালেখি না করে। আর করলেও কুফরি ভাষা বাংলায় নয়; ফার্সি, উর্দু অথবা আরবিতে লিখলে ভালো। তৃতীয়ত, শিক্ষকতা উৎকৃষ্ট পেশা; ছেলে যেন শিক্ষক হয়।

সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক আবুল ফজল তার বাবার দ্বিতীয় কথাটি রাখেননি। প্রথম ও শেষ কথা রেখেছেন। তিনি বাংলা ভাষা ভালোবাসতেন। ফার্সি, আরবি কিংবা উর্দু বুঝতেন, কিন্তু হৃদয়ঙ্গম হয়নি কখনো। তাই পিতার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার কমতি না থাকলেও লেখালেখিতে বাংলা ভাষা ত্যাগ করার কথা প্রথম চিন্তায় বাদ দিয়েছেন। আরো একটি জিনিস বাদ দিয়েছেন, মোহাম্মদ। তার পুরো নাম মোহাম্মদ আবুল ফজল। পিতার রাখা নামের প্রথম শব্দ বাদ দিয়ে তিনি মোহাম্মদহীন, অর্থাৎ শুধু ‘আবুল ফজল’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

তৎকালীন বাঙালি প্রগতিশীল মুসলমানদের যেসব মৌলিক সমস‍্যা সহজে দৃশ্যমান, তার সবগুলো আবুল ফজলের পরিবারে ছিলো। তার বাবা বাংলা ভাষাকে কুফরি ভাষা হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু কথা বলতেন বাংলায়। ধর্মীয় রীতিনীতিতে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল, কট্টর। কিন্তু প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মালম্বীদের সাথে ছিলেন উদার ও পরোপকারী। এটা আসলে আত্মপরিচয়ের টানাটানি। মানুষ হিসেবে চাইতেন মানুষের মত করে মানুষের মাঝে বসবাস করতে। কিন্তু ধর্ম তাতে প্রধান বাধা। বাঙালি নাকি মুসলমান? আত্মপরিচয় নিয়ে এমন জটিল টানাটানির মাঝে আবুল ফজলের বেড়ে ওঠা।

১৯০৩ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ মাইল দক্ষিণে কেঁওচিয়া নামের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার জন্ম ছিল পরিবারের জন‍্য বিশেষ আনন্দের। কারণ পরিবারে তিনিই প্রথম পুত্র সন্তান। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি প্রথম এবং একমাত্র পুত্র সন্তান হিসেবে রইলেন। আদরের পুত্র সন্তান।

বাবা চাইতেন মৃত্যুর পর তিনি যেন তার ছেলের মাঝে বেঁচে থাকতে পারেন। ছেলে যেন তার মতই ধার্মিক, পরহেজগার ও দ্বীনের পথের যাত্রী হয়। তাই নিজের মাঝে যত ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কট্টরপন্থা ছিল, তার সবটুকু ছেলের মনে মাখাতে চেয়েছেন। যেমন তিনি নিজে তার বাবার মত হয়েছেন। তার বাবা ছিলেন আলেম, সেই সূত্রে তিনিও। বংশ পরম্পরা নিশ্চিত করতে ছেলেকে তার বাল‍্যকাল থেকেই ধর্মমন্ত্রে বশ করতে চাইতেন।

আবুল ফজল সম্ভবত আদরটুকু চেয়েছেন, চাপিয়ে দেয়া গোঁড়ামি চাননি। তাই তিনি সর্বদা মুক্তির সুস্বাদ অনুসন্ধানে ব‍্যতিব‍্যস্ত ছিলেন। স্বাধীনচেতা মন নিয়ে নতুন নতুন চিন্তা ও বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হতে চাইতেন। তবুও, বিশ শতকের শুরুতে যখন পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সমাজ ‘মুসলমান’ শব্দের মাঝে আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছে, তখন আবুল ফজলের জন্য মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করা বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু এমন কঠিনকে সহজ করে নিতে তিনি সফল হয়েছেন। এখানে অবশ্য তার বাবার পরোক্ষ সহায়তা আছে।

বাবা থাকতেন শহরে। আবুল ফজল তার মায়ের সাথে গ্রামে থাকতেন। গ্রাম মানে আদর্শ গ্রাম। বড় পুকুর, উঠান, বাড়ির পাশে সুবিশাল মাঠ, মাঠে গরু আর দামাল ছেলের পাল। উঠানে, পুকুরে, মাঠে আবুল ফজলের বাধাহীন ছুটোছুটি। ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরে ডুবাতেন। মায়ের বিরামহীন ডাকাডাকির পর পুকুর থেকে উঠতেন। কিন্তু উঠেই চলে যেতেন মাঠে। নিজেদের গবাদিপশু ছিল না। বাড়ির পাশের কারো না কারোতো ছিল, তাদের গরু নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। এমন নির্মল প্রকৃতি ও সরল স্বাধীন বাল্যকাল আবুল ফজলের যৌবনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। ফলে তিনি তার বাবার মত ইসলামের খাদেম হওয়ার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারকও হতে পেরেছেন।

এমন স্বাধীনতার মাঝে খারাপ সময় ততটুকু, যতটুকু সময় বাবা বাড়িতে থাকতেন। ইসলামের হুকুম আহকাম, মাসলা মাসায়েল – বাবা বাড়ি আসতেন এসব নিয়ে। ধর্মের বাড়াবাড়ি, গোঁড়ামি ছিলো সত্যি; ছেলেকে আলেম বানাতে চেয়েছেন তাও সত্যি। কিন্তু নির্বোধ বানাতে চাননি। ছেলের শিক্ষাগ্রহণের প্রতি তিনি যত্নবান ছিলেন। বাবা চাইতেন ছেলে শিক্ষিত হোক।

আবুল ফজলের লেখাপড়ার পথ কিছুটা অমসৃণ ছিল। স্কুল, মাদ্রাসা, আবার স্কুল, আবার মাদ্রাসা। এরকম করতে গিয়ে প্রায় দুই বছর সময় হারিয়ে ফেলেন। তিনি লেখাপড়া তাড়িয়ে বেড়ান, তার বাবার তাড়িয়ে বেড়ান ছেলের জন্য চাকরি, আর চাকরি তাড়িয়ে বেড়ায় আবুল ফজলের বয়স। বয়সের কারণে স্কুল কলেজে বৃত্তি পাননি, পাননি সরকারি চাকরি। তাই সরকারি চাকরির আশা ত্যাগ করে প্রথমে আইন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন, পরে শিক্ষক।

প্রথমে তিনি ভর্তি হন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গ্রামের বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ার পর বাবার সাথে চট্টগ্রামে চলে আসেন। পিতার ইচ্ছে মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন। কিন্তু মাদ্রাসা সেশন শুরু হতে কিছুদিন দেরি হবে। তাই বাসার নিটকবর্তী নন্দন কাননের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। এরপর ১৯১৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মাদ্রাসাটি ছিল সাবেকী মাদ্রাসা। আরবি ও ফার্সি ভাষার সিলেবাস। আবুল ফজল কিছুটা হতাশ। তাকে খুশি করে কয়েকদিন পর মাদ্রাসাটি নিউ স্কীম মাদ্রাসায় রূপ নেয়। পুরোনো সিলেবাস বাতিল হয়ে সমন্বিত সিলেবাস যুক্ত হয়। সাথে যুক্ত হয় ইতিহাস ও আধুনিক ভুগোল শিক্ষা। ফার্সি ভাষা সম্পূর্ণরূপে বাদ যায়। কিছুটা ইংরেজি, কিছুটা বাংলা এবং অংক। পাঠদানে বাংলা ভাষা নিরঙ্কুশ ছিল না। কিন্তু মাদ্রাসায় নিয়মিত বাংলা মাসিক পত্রিকা ও লাইব্রেরিতে বেশ কিছু বাংলা বই নেয়া হয়। অপ্রিয় মাদ্রাসা এবার খুব প্রিয় হয়ে ওঠে আবুল ফজলের কাছে।

এসময় আবুল ফজলকে নতুন কিছু সমস‍্যায় পড়তে হয়। বাবার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাকে জায়গির থাকতে হয়। সেসময় জায়গির থাকার বেশ প্রচলন ছিল। কারো বাড়িতে থেকে খেয়ে লেখাপড়া করবে, বিনিময়ে তাদের বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাদের পড়াবে। বর্তমান সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকার বিনিময়ে পড়ানোর রীতি থাকলেও জায়গিরের রীতি নেই বললেই চলে। এমনকি গ্রামেও এই রীতি আছে কিনা, সন্দেহ।

আবুল ফজল যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, তখন বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুলের বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মাসিক পত্রিকাগুলোয় নজরুলের লেখা ছাপা হয়। আবুল ফজল দুই একটা লেখা পড়েই দারুণ আকৃষ্ট হন। তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, তখন নজরুলের পরপর দুটি বই বের হয়। ব্যাথার দানঅগ্নিবীণা। জমানো টাকার সবগুলো দিয়ে কলকাতা থেকে বই দুটি পার্শ্বেলের ব্যবস্থা করেন। এই খবর বন্ধুমহলে ছড়িয়ে পড়লে সবাই অবাক হয়। মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের কাছে তখন শুধু শখের বশে এত দূর হতে বই আনানো খুব সহজ বিষয় ছিল না। বইগুলো হাতে পেয়ে আবুল ফজল নেশামগ্ন হয়ে যান। এরপর তিনি আরো বই আনেন এবং মাসিক পত্রিকাগুলোয় নজরুলের লেখা নিয়মিত পড়তে থাকেন। মূলত নজরুলের লেখা পড়ে আবুল ফজলের লেখালেখির ইচ্ছে জাগ্রত হয়।

আবুল ফজলের বাবা তখন চট্টগ্রাম জামে মসজিদের ইমাম। একদিন খুব আশা নিয়ে ইমাম সাহেবের দ্বাদশ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে সওগাত পত্রিকায় লেখা পাঠান। লেখাটি ছাপাও হয়। কিন্তু লেখকের আগে সেই লেখা পড়েন স্থানীয় হাইস্কুলের এক শিক্ষক। পরিচিত তরুণের লেখা বিখ্যাত পত্রিকায় পড়ে তিনি যারপরনাই খুশি। ভাবলেন তরুণের বাবাও নিশ্চয় খুশি হবেন। এই ধারণার বশঃবর্তী হয়ে খবরটি আবুল ফজলের বাবাকে জানান।

আহা! এ কী হলো!! ইমাম সাহেব ভয়াবহভাবে নাখোশ হলেন, সীমাহীন বিরক্ত হলেন, বিব্রত হলেন। একজন ইমামের ছেলে কিনা বাংলা ভাষার পত্রিকায় কীসব লিখেছে। মান সম্মান বোধ হয় আর রইলো না। বসে রইলেন ছেলের অপেক্ষায়। ছেলেও কী এক প্রয়োজনে বাবার সাথে দেখা করতে এলো। ব‍্যস্! রুদ্র রুক্ষ মূর্তিমান বাবার সামনে পড়তেই ধমকের সুরে প্রশ্ন গিলতে হলো। তুমি নাকি বাংলা পত্রিকায় লেখা শুরু করেছ? – এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমে মনে মনে খুব খুশি হয় আবুল ফজল। বুঝতে পারলেন নিশ্চয় তার লেখা সওগাত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু বাবার সামনে খুশি লুকিয়ে রেখে সরাসরি অস্বীকার করলেন। বাবা বললেন “হাই স্কুলের শিক্ষক নিজে এসে আমাকে বলে গেছেন, এমনকি তিনি লেখাটি পড়েছেনও! আবুল ফজল নামে প্রকাশিত হয়েছে।” আবুল ফজলের উপস্থিত বুদ্ধি ছিল বেশ তীক্ষ্ণ। দ্রুত বলে দিলেন, “আমার নামতো মোহাম্মদ আবুল ফজল। আবুল ফজল নামে যিনি লিখেছেন, তিনি নিশ্চয় অন‍্য কেউ হবেন।” যুক্তিটা যেহেতু মোহাম্মদ নিয়ে, বাবা সহজে বিশ্বাস করলেন।

ইতিমধ্যে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করলেন। কিন্তু সরকারি চাকরি মিলেনি। বয়সের কারণে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৮ সালে বি. এ. পাশ করেন। এরপর এলএলবি পড়ে ওকালতি পেশায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে জাগে। বাবাকে নিজ ইচ্ছের কথা বলেন। বাবা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। বাবার ধারণা উকিলরা প্রচুর মিথ্যা বলেন। তিনি চাননি তার ছেলে মিথ্যার পেশায় যুক্ত হোক। আবুল ফজলের বাবা নিজে মিথ্যা বলতেন না, যারা মিথ্যা বলে তাদেরকে পছন্দ করতেন না।

কিন্তু আবুল ফজল ওকালতি পেশায় যুক্ত হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ। গ্রামে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ল’ পড়তে কলকাতায় পাড়ি জমান। ভাবলেন ছেলের জিদের কাছে পিতা হার মানবেন। কিন্তু তার বাবা নিজ বিবেচনাপ্রসূত চিন্তায় চোর, ডাকাত, ভালো, মন্দ সবার স্বার্থ দেখার পেশায় ছেলে যুক্ত হোক, তা কোনভাবেই চাননি। এদিকে তার ছেলে কলকাতায় সীমাহীন অর্থকষ্টে জোড়াতালি দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস পর শুনতে পেলেন বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছেন। সবকিছু বন্ধ রেখে বাবাকে দেখতে আসলেন। বাবার বিছানার কাছে গিয়ে সে একই কথা শুনলেন। “উকিল হইও না, শিক্ষক হও। শিক্ষকতার চেয়ে মহৎ পেশা আর নাই।”

তারপর বাদ দিলেন। বাবার কথা রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছায় নতুন করে লেখাপড়া শুরু করলেন। এর মধ্যে ১৯২৯ সালে তার বাবা মারা যান। ঢাকায় টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে বি.টি. ডিগ্রী শেষ করে ১৯৩১ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। যোগ দিলেন শিক্ষকতায়। প্রথমে স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলে দ্বিতীয় মৌলবী হিসেবে, পরে চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে, এরপর চট্টগ্রাম কাজেম আলী বেসরকারী হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ. পড়ার সময় মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৬ সালে মুসলমান সমাজে বুদ্ধির মুক্তি আনয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের একটি অংশ মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর তারা ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ স্লোগান ধারণ করে প্রকাশ করেন সমাজ সংস্কারমূলক পত্রিকা শিখা। এই উদ্যোগের সাথে জড়িতরা সবাই শিখাগোষ্ঠী নামে পরিচিতি লাভ করেন।

শিখাগোষ্ঠীর সকল শিখার মাঝে আবুল ফজলের শিখার আলো কিছুটা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। সংগঠনে তার অংশগ্রহণ ছিলো প্রশ্নাতীত, কিন্তু ইসলাম ধর্মের সংস্কার কাজে তিনি অন্যদের মত স্বচ্ছ ছিলেন না। ১৯২৯ সালে কাজী মোতাহার হোসেন সম্পাদিত ‘শিখা’র তৃতীয় সংখ্যায় ‘তরুণ আন্দোলনের গতি’ নামে আবুল ফজলের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই প্রবন্ধ পড়লে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্য সদস্যদের সাথে আবুল ফজলের পার্থক্য বুঝা যায়।

অনুসন্ধিৎসাই মানুষকে সত্যের পথে টানিয়া লইয়া যায়। বিশ্বাস করিয়া মানুষের সুখ আছে জানি, কিন্তু সত্যের অনুসন্ধানে বা সত্যকে আবিষ্কার করিয়া মানুষের যে সুখ, আত্মপ্রসাদ —তাহার তুলনা নাই। সন্দেহই জ্ঞানের গোঁড়া —এইতো বড় বড় দার্শনিকের কথা। সন্দেহ হইতে মানুষের মনে অনুসন্ধিৎসা জাগে। এই অনুসন্ধিৎসাই মানুষকে জ্ঞানের পথে চালিত করে। আজ মুসলমান ছেলের মনে জীবনের বড় কিছু সম্বন্ধে সন্দেহ জাগিতে পারে না। সন্দেহ জাগিলে তাহার গলা টিপিয়া ধরা হয়। …পিতা পিতামহ বিশ্বাস করেন, খোদা এক। ধর্মশ্রাস্ত্র বলে খোদা এক। ব্যাস, আমি বিশ্বাস করি —খোদা এক। এইতো আমাদের জ্ঞান। কিন্তু খোদা নাই বা খোদা একাধিক, এই সন্দেহ কোন মুসলমান ছেলে প্রকাশ করিলে তাহার কি আর নিস্তার আছে।

অপর একটি অংশ—

বহুদিন হইতে দেশে অসংখ্য মাদ্রাসা চলিয়া আসিতেছে এবং বছর বছর তাহা হইতে অসংখ্য ছাত্র পাশ করিয়া বাহির হইতেছে। শরিয়তের সব কিছুই তো এখানে পড়ায় না। তথাপি জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইহারা নতুন কিছু দান করিতে পারিতেছেন না কেন? শরিয়তের বিধিনিষেধগুলিরও আধুনিক জীবনের মতবাদ অনুযায়ী ইহারা কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন না কেন? ইহার উত্তর, —ইহাদের মনে জ্ঞান ও চিন্তার গোড়া সন্দেহ জাগিতে পারে নাই। …তাহাদর মনে এই শিক্ষা ও সংস্কার বদ্ধমূল হইতে দেওয়া হয় যে এই আরবি ফারসি কেতাবে যাহা কিছু লিখিত আছে, তাহা অলঙ্ঘনীয় সত্য। ইহার কোন বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহের স্থান নহে। যাহার মনে সন্দেহ জাগে, সে গুনাহার। এমনি করিয়া মুসলমানের জ্ঞানের উৎসকে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে।

শেষে লিখেন—

হিন্দু যদি আজ সমুদ্রযাত্রাকে অধর্ম ভাবিয়া ঘরে বসিয়া থাকিত, অথবা খ্রিস্টান যদি আঘাতের প্রতি আঘাতের পরিবর্তে অন্য গালখানি পাতিয়া দিত, তাহা হইলে তাহাদের জায়গা স্বর্গে হইলেও হইতে পারিত, কিন্তু এই মাটির দুনিয়ায় একেবারে অসম্ভব হইত। মুসলমানকেও যদি দরকার হয় এইরকম নির্মমভাবে সামাজিক বিধি নিষেধকে পরিবর্তন করিতে হইবে। ইসলামের মূল সূত্রকে পরিবর্তন করিতে বলিতেছি না এবং তাহার দরকারও নাই।

শিখার সে সংখ্যার সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেন এই অংশের শেষে একটা তারকা চিহ্ন বসান। প্রবন্ধের শেষে পাদটীকায় প্রবন্ধটির লেখক আবুল ফজলকে টিপ্পনি কাটেন। সম্পাদক সাহেব লিখেন—

লেখকের শোষোক্ত বাক্যটির তাৎপর্য কি বুঝিলাম না। পাছে তওবা করিতে হয় সেই ভয়ে কি এ বাক্যটি লেখকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলমের আগায় বাহির হইয়াছে? তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে এই বাক্যটি খাপ খাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না।

আবুল ফজল ধর্মের বিষয়ে দোটানায় ভুগতেন। প্রগতিশীল সংস্কারবাদীর তালিকায় থাকতে চাইতেন আবার ইসলামপ্রেমীর তালিকায়ও। এমন দোটনা তার জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক চিন্তায় দারুণভাবে প্রভাব ফেলে, জীবনের শেষ পর্যন্ত যার প্রমাণ তিনি দিয়ে গেছেন। যা হোক, এই ‘শিখা’ পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। আবুল ফজল এই সংখ্যার সম্পাদনা করেন। এরপর পত্রিকাটির আর কোন সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি।

ইতিহাস বলে বাঙালি শিক্ষিত মুসলমান সমাজে একসময় ব্যাপক উর্দুপ্রীতি ছিলো। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর এই প্রেমে নতুন জোয়ার আসে। পঞ্চাশে যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন রচিত হয় তখন মুসলমান সাহিত্যিকদের মাঝে অনেকে নতুন করে উর্দুর প্রেমে সিক্ত হন। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় বাংলা লেখক উর্দুর পক্ষে অবস্থান নেন, যাদের মাঝে কবি গোলাম মোস্তফা অন্যতম। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি আবুল ফজলের প্রেমে কখনোই ভাটা পড়েনি। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি বাংলার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এবং উর্দুর পক্ষ নেয়া শিক্ষক সমাজের সাথে সম্মুখ তর্কে লিপ্ত হতেন।

কিন্তু একই সময় আবার ব্যক্তিস্বার্থে উর্দুপ্রেমী সাহিত্যিকদের সাথে জোট বেঁধে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অগ্রজ সহযোদ্ধা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে অপ্রত্যাশিত বিবাদে জড়িত হন। যে বিবাদ ছিলো বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের চেতনাবিরোধী এবং স্পষ্টভাবে স্ববিরোধী। তিনি জীবনভর এরকম বেশকিছু স্ববিরোধী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হন, যার মূলে ছিলো ব্যক্তিস্বার্থ অথবা ব্যক্তিগত বিরোধ।

১৯৫২ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লেকচারার থেকে প্রফেসরে উন্নীত হন। একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন। এসময় সিলেবাস প্রণয়ন নিয়ে বিতর্কে বাংলাপ্রেমী আবুল ফজল আর উর্দুপ্রেমী কবি গোলাম মোস্তফা যৌথভাবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। শুধু এই দু’জনই নন, এই আক্রমণের সাথে জড়িত ছিলেন আরো কয়েকজন মুসলিম সাহিত্যিক, যারা আশা করেছিলেন সদ্যজাত পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে নিজেদের সাহিত্যকর্ম স্থান পাবে। কিন্তু দেশ ভাগের পাঁচ বছর পরও নিজেদের লেখা পাঠ্য তালিকায় না দেখে অতিশয় দুঃখ পান এবং নতুন বিভাগীয় প্রধান শহীদুল্লাহকে নিশানা করে প্রতিবাদের আওয়াজ তোলেন। যদিও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে টার্গেট করা অযৌক্তিক ছিলো, কারণ দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি নতুন সিলেবাস প্রণয়নে হাত দেন এবং সেই কাজ তখনো শেষ হয়নি।

এর আগে আগে আবুল ফজল ১৯৪৮ সালে ‘জিন্দেগী’ পত্রিকায় ‘সিরাজুল ইসলাম’ ছদ্মনামে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান-বিরোধী মনোভাব’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে এই প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কোন মুসলমান অধ্যাপক নিয়োগ না দেয়া, হিন্দু লেখকদের লেখা কমিয়ে না আনা, মুসলমান লেখকদের রচনা অধিকভাবে যুক্ত না করাসহ আরো কিছু হিন্দু বিদ্বেষী অথবা মুসলিম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে ড. শহীদুল্লাহকে মুসলমান বিদ্বেষী এবং ভারতপ্রেমী আখ্যা দেন। এই প্রবন্ধে যেসব লেখকদের লেখা যুক্ত না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তার মধ্যে আবুল ফজল রচিত নাটক ‘কায়েদে আজম’ ও গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’ অন্যতম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যে হিন্দু সাহিত্যিকদের আধিক্য আবুল ফজল পছন্দ না করলেও তিনি ঢালাওভাবে হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। তবে নিজ ধর্মীয় সমাজের স্বার্থের দেখভাল করতেন। আবুল ফজল দারুণভাবে রবীন্দ্রপ্রেমী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খানের সরকার যখন রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান আদর্শের পরিপন্থী বিবেচনা করে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।

কর্মজীবনের অধিককাল পর্যন্ত আবুল ফজল শিক্ষকতা করেছেন। পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শেষে ১৯৪১ সালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর কলেজে বাংলা বিষয়ের লেকচারার পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৪৩ সালে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে আসেন। ১৯৫৬ সালে অধ‍্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন।

এসময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার সূত্রপাত হয় ড. নীলিমা ইব্রাহিমকে বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে। বাংলা একাডেমি তখন নানান অনিয়মের ভারে জর্জরিত। যুদ্ধ পরবর্তী নারী পুনর্বাসন কাজে নীলিমা ইব্রাহিমের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতার কারণে তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই আস্থা থেকে তাকে রুগ্ন বাংলা একাডেমিকে সুস্থ করার দায়িত্ব দেন। কিন্তু বিষয়টি পছন্দ হয়নি আবুল ফজলের। তিনি ‘বিচিত্রায়’ কলাম লিখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখেন, “কেন একজন মেয়েমানুষকে বাংলা একাডেমীর ডি.জি., বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, রোকেয়া হলের প্রভেষ্ট ও মহিলা সমিতির সভানেত্রী করা হয়েছে?”

অথচ এই আবুল ফজলই ১৯৩১ সালে ‘শিখা’ পত্রিকায় লিখেছিলেন —

মেয়েদের শিক্ষা, অবরোধ প্রথার উচ্ছেদ ইত্যাদি সম্বন্ধে বাঙালি-মুসলমান সমাজে বহুদিন হইতে আলোচনা চলিতেছে। কিন্তু আমাদের সমাজনেতারা শুধু বাক্যের ব্যবসাদারিতেই সমস্ত শক্তি ব্যয় করিয়া নিজেরা ফতুর হইতেছেন এবং সমাজকেও বিড়ম্বিত করিতেছেন। Example is better than precept, একথা তাঁহারা বুঝিতেছেন না, বা বুঝিয়াও না বুঝিবার ভান করিয়া মনে করিতেছেন আমরা সমাজের নেতা, সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত pioneer — ইয়া উয়া! আজ এই ঢাকা সাহিত্য সমাজের সভায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁহাদের স্ব স্ব পরিবারের মহিলাদের এই সভায় যদি লইয়া আসিতেন, তাহা হইলে এই আন্দোলন আজ একদিনে অন্তত আরো দশ বৎসর আগাইয়া যাইতে পারিত এবং সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনের সঙ্গে তাঁহাদের যে নাড়ির যোগ রহিয়াছে, তাহাও প্রমাণিত হইয়া যাইত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ আমরা তাহার উল্টা দেখিতেছি।

আবুল ফজল এমনই ছিলেন। যখন তার কোন কিছু পছন্দ হয়নি, কিংবা নিজ স্বার্থে আঘাত লেগেছে, তখনই তিনি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতেন, নারী প্রগতি বিদ্বেষী হয়ে উঠতেন। সে বছর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ পরীক্ষায় ফল বিপর্যয় ঘটে। এসময় এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষক সমাজের সমালোচনা করে কিছু কথা বলেন। আবুল ফজল ভেবেছিলেন এই কথাগুলো ফল বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, কারণ তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। অপমানবোধে জর্জরিত আবুল ফজল ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দেন এবং তীব্র সমালোচনা করেন। এই ঘটনাটি সরকার ভালোভাবে নেয়নি। ফলে তার কাজকর্মে বেশ চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু আবুল ফজল তার কথা থেকে চুল পরিমাণও সরে যাননি। তিনি অটল ছিলেন। তার এমন আপসহীনতার জন্য তখনকার বুদ্ধিজীবী সমাজ আবুল ফজলকে ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।

কিন্তু পঁচাত্তরের শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর পর তার বিবেক কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যায়। জিয়াউল হক, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের পরিণতি খুব কাছ থেকে দেখা আবুল ফজল ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সামরিক সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১৯৭৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত তিনি এই পদে কর্মরত ছিলেন।

আমাদের সময়ের সমালোচক হুমায়ুন আজাদ আবুল ফজলকে নিয়ে একটি ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। যে মন্তব্যটি বর্তমানে প্রবচন হিসেবে বহুল ব্যবহৃত, যদিও এর নেপথ্য ঘটনা অনেকের অজানা।

বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।

আবুল ফজল কোন মহামানব কিংবা ঐশী শক্তি সম্পন্ন কেউ ছিলেন না। ছিলেন না রাগ, ক্ষোভ, লোভ ও মোহের উর্ধ্বের কেউ। দোষ ও গুণের মিশেলে একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি প্রেম ও পরিশ্রম তাকে অসাধারণ করে তুলেছে। সর্বোপরি তিনি ছিলেন বাক স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। যেকোন জায়গায়, যেকোন পরিস্থিতিতে নিজের মতটি নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তার মতামত কখনো মুক্তচিন্তার পক্ষে গেছে, কখনো সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। এই পক্ষাবলম্বনে তিনি কুটিলতার আশ্রয় নিতেন না, রাখঢাক রাখতেন না। তাই তার জন্মের শত বছর পরও আমরা খুব সহজে তাকে ব্যাখ্যা করতে পারছি, বিশ্লেষণ করতে পারছি।

আবুল ফজলের রচনাবলীর শিরোনামগুলো অত‍্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, ভ্রমণকাহিনীসহ বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন। চৌচির (১৯৩৪), প্রদীপ ও পতঙ্গ (১৯৪০), মাটির পৃথিবী (১৯৪০), বিচিত্র কথা (১৯৪০), রাঙ্গা প্রভাত (১৯৫৭), রেখাচিত্র (১৯৬৬), দুর্দিনের দিনলিপি (১৯৭২) তার অন্যতম রচনাবলী।

বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখায় একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবুল ফজলকে ডক্টরেট ডিগ্রী উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। তার পুরষ্কার প্রাপ্তির তালিকা বেশ খানিকটা দীর্ঘ। বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬), নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮০), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আবদুল হাই সাহিত্য পদক (১৯৮২) এবং সর্বশেষ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।

১৯৮৩ সালের ৪ মে বার্ধক্যজনিত কারণে জন্মভূমি চট্টগ্রামে তাঁর মৃত্যু হয়।


তথ্যসূত্র –
১. রেখাচিত্র – আবুল ফজল
২. আবুল ফজল – গুণীজন
৩. ফজল, আবুল – বাংলাপিডিয়া
৪. স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা
৫. খোন্দকার সিরাজুল হক রচিত মুসলিম সাহিত্য-সমাজ : সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম
৬. একটি পুরনো বিতর্ক -কালি ও কলম
৭. নীলিমা ইব্রাহিম -গুণীজন

মন্তব্য করুন