চলতি বছর দেশে এ পর্যন্ত (৪ অক্টোবর, ২০২০) মোট ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে বলার চেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। এটা আইন ও সালিশ (আসক) কেন্দ্রের হিসাব। এর বাইরেও ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা, নারী নির্যাতনের ঘটনা। যা থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। আর বিচার তো দূর অস্ত! তারপরও যে ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে তার সংখ্যা ও বীভৎসতার ধরণ দেখলে চমকে উঠতে হয়। যেন ধর্ষকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।
আসকের হিসেবে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩ জন করে নারী ধর্ষিত হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ৯৭৫ জনের মধ্যে ২০৮ জনই শিকার হয়েছেন গণধর্ষণের। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন নারী, আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। এর বাইরেও উল্লিখিত সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ জন, যার মধ্যে ১২ জন আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে তিন নারী ও ছয় পুরুষ।
এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা নানা কারণে দেশজুড়ে আলোচিত হয়। মূলত সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য কোন কারণে, মানে ঘটনা ধামাচাপা না দিতে পারার কারণে প্রকাশ্যে আসা ঘটনাগুলোতেই মানুষের দৃষ্টি যায়। বেশিরভাগই থেকে যায় আলোচনার বাইরে। এই আলোচিত ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলেও দেখা যায়, নারী ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা রীতিমতো বেপরোয়া। কোনরকম ভয়ডর নেই, দ্বিধা নেই তাদের মধ্যে। কোন কোন ঘটনায় অভিযুক্ত নিজেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শাস্তির ভয় নেই তাদের। নেই কোন শঙ্কা। কি শহর কি গ্রাম, দিন কি রাত— ইচ্ছে হল, ধর্ষণ করে ফেললাম। কিন্তু কেন এত বেপরোয়া ধর্ষকরা?
তার প্রধান কারণ রাজনৈতিক। বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। ভেঙে পড়েছে রাষ্ট্রের সমস্ত কাঠামো। আইন-প্রশাসন-বিচার বিভাগ— কোন প্রতিষ্ঠানই আর সঠিক পথে নেই। প্রবলভাবে শাসক নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসী এক তীব্র স্বৈর-তান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছে এই দেশে। ফলে অপরাধ ও অপরাধীর এক অভয়ারণ্য আজ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। আর অপরাধের স্বর্গরাজ্যের অন্যতম ভিক্টিম নারীরা।
জন-বিচ্ছিন্ন আওয়ামীলীগের নেতারা নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে লালন করে একদল দুর্বৃত্ত। তাদের প্রশ্রয়েই সমাজে সংগঠিত হচ্ছে নানা অপরাধ। দেখা দিয়েছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রাদুর্ভাব। আমাদের সমাজের নৈতিকতায় নারী হচ্ছে ভোগ্য। টাকা, জমি, নদী দখলের মতো তাই নারীও তাদের কাছে দখলের বস্তু। আর তা ঘটে সরকার দলীয়দের ছত্রছায়ায়, তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। তাই প্রায় প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় দেখা গিয়েছে ধর্ষক/ধর্ষকরা সরকারদলীয় হিসেবে সক্রিয় অথবা ক্ষমতাশালীদের ছায়ায় লালিত। সর্বশেষ নোয়াখালীর ঘটনায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় অভিযুক্তরা সরাসরি ছাত্রলীগ কর্মী। এইভাবে প্রতিটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ধর্ষক সরকারদলীয় পরিচয়ের। দেখা যাবে ধর্ষকদের বাঁচাতে আড়ালে আবার কখনও প্রকাশ্যে সক্রিয় মুজিবকোটধারীরা।
সবশেষ নোয়াখালীর ঘটনাটির দিকে তাকালে এটা আরো স্পষ্ট হবে। অভিযুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি সরকার দলের সমর্থক বা বিভিন্ন স্তরের নেতা, কর্মী। এবং এদের প্রভাব এতটাই যে এদের একটা বাহিনী (দেলোয়ার বাহিনী) আছে রীতিমতো। এটা গোপন কোন বাহিনী নয়। এলাকার মানুষজন এই বাহিনী ও তাদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ। এই বাহিনীর ভিত এতটাই শক্তিশালী যে প্রশাসন পর্যন্ত তাদের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল এতদিন। ৪ অক্টোবর র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেছেন, ‘দেলোয়ার বাহিনী ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। দেলোয়ার এলাকায় অস্ত্রধারী চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত থাকেন। দেলোয়ারের বিরুদ্ধে দুটি চাঁদাবাজির মামলা আছে।’ —এই হচ্ছে অবস্থা! এমন একটা ভয়ঙ্কর বাহিনী নোয়াখালী শহরের বুকের কাছেই দৌরাত্ম করে বেরিয়েছে। আর প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ নীরব। তো, এই অবস্থায় দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হবে না কেন?
আরেকটি কারণ হচ্ছে সমাজের ডানপন্থার বিকাশ। সোজা কথায় ধর্মান্ধতার বাড়বাড়ন্ত। রাষ্ট্রও পুরো দমে তাদের সেল্টার দিচ্ছে। ধর্মান্ধদের মন জুগিয়ে চলছে। মনে রাখতে হবে ধার্মিকদের রেডিক্যাল অংশের কাছে নারী মানেই ঘরে থাকবে, আর শস্য ফলাবে। তাদের ঘরের বাইরে পা ফেলা মানেই অপরাধ! এই দেশে নারী নির্যাতিত হওয়া মানেই নারীর দোষ। তার পোশাক ঠিক নাই, চরিত্র ভাল না, চাল চলন ভাল না, ওড়না পরে না— এইসব নানা দোষে এই সমাজের মেয়েরা জন্মাবধি দুষ্ট। ধর্মীয় ওয়াজগুলোতে নারী নিয়ে যত আলোচনা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের নিয়ে যত আলোচনা হয় তার সিংহভাগই নারীর প্রতি, নারী সত্তার প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ। সমাজ চায়, নারী থাকবে বিনীত, অবনত, কোমল, ভোগ্য ও অবগুণ্ঠিত।
যে নারী ঘরের বাইরে পা দেয় সেতো ন্যাচারালি তাদের এই শর্তগুলোকে ভেঙে ফেলে। তখনই ধর্মপ্রবণ, সামাজিক পুরুষ হয়ে ওঠে প্রতিশোধ পরায়ণ। যেন নারীকে ফের বাধ্য করতে না পারলে নেমে আসবে কেয়ামত; ভেঙে পড়বে আকাশ। যার মধ্যে দিয়ে নারীদের জন্য সমাজে প্রতিকূলতাপূর্ণ পরিস্থিতির তৈরি হয়। একটি মেয়ে একা রাস্তা বের হয়ে যদি কোনরকম হয়রানির শিকার হয়, সেই দোষটাও বর্তায় ওই মেয়েটির ওপর। এই হচ্ছে সোসাইটির মোরালিটি।
এরই মধ্যে ধর্মের টোটকা নিয়ে মঞ্চে হাজির হেফাজত ইসলাম নেতা বাবুনগরী। তিনি দাবী জানিয়েছেন, ধর্ষণ বন্ধে পর্দা বাধ্যতামূলক করার। মানে, ধর্ষক নয়, তিনি নারীর পোশককেই দায়ী করছেন। এই যে ধর্মগুরুদের পক্ষ থেকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে নারীর পোশাককে দায়ী করা হয়, এইটা ভয়াবহ। এর মধ্য দিয়ে ধর্মগুরুরা ধর্ষককে আসলে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। আর ধর্ষিতাকে দায়ী করছে, কেন তুমি পর্দা করোনি? এটা তোমার দোষ! এই ‘তৌহিদী’ চেতনাকেও খুব কার্যকরভাবে পুঁজি করে ধর্ষকরা। ফেসবুক-ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও পাওয়া যাবে যেখানে তথাকথিত পরকীয়া হাতেনাতে ধরার নাম করে সংঘবদ্ধভাবে নারীকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। এর নিচের হাজার হাজার কমেন্ট পাওয়া যাবে যেখানে নারীর প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
এই সোসাইটির কাছে নারী আসলে এক চরম প্রতিপক্ষ। যাকে সঙ্গমের মধ্য দিয়ে, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে, অবদমনের মধ্যে দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। শুধু আমাদের বাংলাদেশই নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি হচ্ছে এই। যার ফলে কোন নারী নির্যাতিত হলেই সহজেই শুরু করা যায় ভিক্টিম ব্লেমিং। অনলাইনে রয়েছে শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক নেটওয়ার্ক। রয়েছে ডানপন্থী সুশীল— যারা নানাভাবে প্রোটেকশন দেয় ধর্ষকদের, প্রকারান্তরে উৎসাহিত করে নারী নির্যাতনে।
নোয়াখালীর ঘটনায় আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। নির্যাতনের ঘটনার পর ভিক্টিমের চুপ থাকা। মানে আইনের আশ্রয় না নেয়া। এটা নির্দেশ করে রাষ্ট্রের প্রতি, প্রশাসনের প্রতি নাগরিকদের প্রবল অনাস্থার। আর এটা একদিনে তৈরি হয়নি। মানুষ জানে, আইনের কাছে গেলে প্রতিকারের বদলে উল্টো তার নিজের হয়রানির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেখানে অভিযুক্তরা সরকারদলীয়। এটা মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকেই জেনেছে। যদিও ওই নারী ঘটনার পরদিন স্থানীয় ইউপি সদস্যকে ঘটনা জানিয়ে বিচার দাবি করেছিলেন। কিন্তু ইউপি সদস্য বিষয়টি তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েও তা করেননি। উল্টো ওই নারীকে আরো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। বখাটেরা ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ফের অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। একপর্যায়ে তিনি সন্ত্রাসীদের ভয়ে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
রাষ্ট্রও বিচারের বদলে খুনেই খুঁজেছে সমাধান। যার অফিসিয়াল নাম ‘ক্রসফায়ার’— বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এই খুনের মধ্যে দিয়ে অপরাধীর সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের সমস্ত আলামত মুছে ফেলছে রাষ্ট্র। ফলে জানা যাচ্ছে না অপরাধীর পেছনে কারা আছে, কাদের সেল্টারে ঘটেছে ঘটনাগুলো। ফলে অপরাধী নিহত হলেও অক্ষত থেকে যাচ্ছে অপরাধের উৎস। সেই উৎস থেকে আবার জন্ম নেবে ধর্ষক। আর এভাবেই এই খুনি রাষ্ট্র আবার জন্ম দিচ্ছে অজস্র ধর্ষকের।
সরকার সব ঘটনায়ই দাবী করে তারা কঠোর শাস্তি দেবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই ধর্ষণের ঘটনায় শাস্তি হচ্ছে। বেশিরভাগ মামলাই ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। ধর্ষক জামিন পায়, বের হয়ে আবার অপরাধে জড়ায়, ভিক্টিমকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি দেয়। ভিক্টিমকে লাঞ্ছিত করে। আর এসবের পেছনে আড়ালে সমর্থন দিচ্ছে কোন মুজিবকোট।
আসকের পরিচালক নিনা গোস্বামী ২৮ সেপ্টেম্বর এক সাক্ষাৎকারে ডয়েচে ভেলকে বলেছিলেন, ‘মাত্র শতকরা তিন ভাগ ধর্ষণের মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পান।’ বছর কয়েক আগে প্রথম আলোর এক সমীক্ষায়ও উঠে এসেছিল, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার শাস্তি হয় মাত্র ৩ ভাগের। বাকি ৯৭ ভাগ মামলার আসামিরাই থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নোয়াখালীর ঘটনায় যখন কিছু প্রতিবাদী বিক্ষোভে উত্তাল শাহবাগে, দেশের বিভিন্ন স্থানে তখন খবর বেরিয়েছে নোয়াখালীরই সুবর্ণচরে গৃহবধূকে গণধর্ষণের মূলহোতা উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন ১ বছরের জামিন পেয়েছেন। বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের প্রথম ভোরটা শুরু হয়েছিল সুবর্ণচরের এই রুহুল আমিনদের ধর্ষণে পিষ্ট এক নারীর আর্ত চিৎকারে। এই আমাদের দেশ। এই আমাদের বেঁচে থাকা। যেখানে ধর্ষিতার আর্তচিৎকারে ভোর হয়; আর রাষ্ট্রের কোলে উল্লাসে বাঁচে ধর্ষক।
ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির আইন হওয়া উচিত…