প্রবন্ধধর্মবাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা | আবুল হুসেন

বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা | আবুল হুসেন

শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহ এই অঞ্চলে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ। আবুল হুসেন যে সময়ে বাঙালি মুসলমানের সমস্যা নিয়ে এই লেখাটি লিখেছিলেন, তার থেকে প্রায় ৮০ বছর পরে এসেও বাঙালি মুসলমান একই সমস্যায় দাঁড়িয়ে আছে।

বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা | আবুল হুসেন

শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহ এই অঞ্চলে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ। আবুল হুসেন যে সময়ে বাঙালি মুসলমানের সমস্যা নিয়ে এই লেখাটি লিখেছিলেন, তার থেকে প্রায় ৮০ বছর পরে এসেও বাঙালি মুসলমান একই সমস্যায় দাঁড়িয়ে আছে।

বাঙালি মুসলমানের জীবনের দিকে যখন দৃষ্টিপাত করি তখন দেখি সে জীবন নিতান্ত হীন, নিতান্ত দরিদ্র, নিতান্ত সংকীর্ণ। অর্থ বলুন, রুচি বলুন, আনন্দ বলুন, কিছুই সে জীবনে নাই। মানুষের জীবন ধারনের জন্য যতটুকু না হলে চলে না সেইটুকু মাত্রই তার সম্বল। চতুর্দিক হতে তার সমস্ত সম্পদ সরে যাচ্ছে। সমাজের গৌরব যা দিয়ে বাড়াতে হয় তার কিছুই তার নাই বললে অত্যুক্তি হবে না। আজ বাঙালি মুসলমান দর্শন, বিজ্ঞান, আর্ট কোনোটিতেই নাই। সম্পদ ও কল্যাণ যে পথে আসে সে পথ তার পক্ষে রুদ্ধ হয়ে আছে। কেবল ভিক্ষুক, কারা-নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, পর-পদদলিত, পরাশ্রয় ভিখারীর দল বেড়ে চলেছে। আজ প্রায় দেড়শত বৎসর হতে চলল ব্রিটিশ পতাকা এদেশে উড়ছে। সেই পতাকার তলে দাঁড়িয়ে হিন্দু আজ বিশ্বজ্ঞানের অধিকারী হয়ে বিশ্ব সম্পদ আহরণ করতে শুরু করেছে। দর্শন বিজ্ঞান, আর্ট প্রভৃতি সমস্ত বিভাগে হিন্দু আজ প্রতিপত্তি অর্জন করে স্বদেশ স্বজাতি ও স্বধর্মের গৌরব বর্ধন করেছে। মুসলমান সমস্ত সম্পদ এর পথ রুদ্ধ করে অবনতির চরমসীমায় দ্রুত অগ্রসর হয়েছে। এই পার্থক্যের কারণ কি?

কেন মুসলমানের এই দুর্গতি?

এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে গেলে বলতে হবে আমাদের শিক্ষা নাই- জ্ঞানের সঙ্গে বহুদূর ক্ষতি ও বিরোধ করে বসেছি এবং বিজ্ঞান ও আর্টকে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্র হতে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি- এই ভয়ে, পাছে তাতে আমাদের ধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম আমাদের এতই নাজুক! ব্রিটিশের সঙ্গে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্ত মন যখন এ দেশে আসল এবং আমাদের আড়ষ্ট মনকে আঘাত করল তখন হিন্দুরা সে আঘাতে জেগে উঠে সে জ্ঞানদীপ্ত মনকে আলিঙ্গন দ্বারা বরণ করে নিল আর আমরা সে আঘাতে জাগতে তো চাই-ই নাই বরং চোখ রাঙিয়ে সে মনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ইউরোপের জ্ঞানকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি- কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের সেই নিদারুণ ভুলের কোন সংশোধনেরই চেষ্টা করি নাই।
অথচ এই বলে আমরা স্বান্তনা পাই যে, একদিন মুসলমানই ইউরোপকে তার দর্শন বিজ্ঞান শিখিয়েছিল। কিন্তু এইটুকু আমরা বুঝি না যে, আজ আমরা কড়ার ভিখারি- আমাদের মুখে সে গর্ব, সে আস্ফালন আদৌ শোভা পায় না।

আজ যদি আমরা সেই গৌরবের অধিকারী হতে চাই এবং তার দাবি করতে চাই আবার আমাদের মধ্য ইবনে খালদুনের মত ঐতিহাসিক, আল গাজ্জালী, ইবনে রোশদ, ইবনে সীনার মত দার্শনিক, হযরত ওমরের মত চরিত্রবান রাষ্ট্রবিদ, গেবরের মত বৈজ্ঞানিক, আবু হানিফার মত তত্ত্বাদর্শী প্রতিভার আবির্ভাব হওয়া চাই। তাহলে আমরা অতীতের সত্যকে প্রমাণ করতে পারব- নতুবা আমাদের মুখে সে অতীতের গৌরব- কাহিনী অন্যের নিকট অলীক উপকথা বলে প্রতীয়মান হবে। নিজকে খাড়া করে, নিজেকে সৃষ্টি করে অতীতকে সত্য বলে প্রতিষ্টিত করতে হবে। এরই অন্য নাম অতীতকে নতুন করে সৃষ্টি করা। এই নব সৃষ্টি সুশিক্ষার উপর নির্ভর করে। হিন্দু আজ নানা শাস্ত্রে পান্ডিত্য লাভ করে নানা জ্ঞানে বিভূষিত হয়ে তার অতীতের প্রতি বর্তমান জগতের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু আজ আমরা সমকক্ষ হতে পারছি না কেন? তার কারণ সুশিক্ষার অভাব। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি চিত্ত বিকাশ ও মস্তিষ্ক সম্প্রসারণ এর অন্তরায় হয়েছে। এই শিক্ষা পদ্ধতি কেমন করে যুগের প্রয়োজন মিটাতে পারে সেই হচ্ছে সমস্যার সমস্যা।

দেশের কল্যাণ-বিধি যদি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হয় তাহলে মোটের উপর বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির যে কি হিন্দু কি মুসলমান কাহারও পক্ষে উপযোগী নয় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মুসলমানদের শিক্ষা পদ্ধতি অনেকটা বিভিন্ন এবং তার ফলও বিভিন্ন- এজন্য আমি এস্থলে মুসলমানদের শিক্ষা সমস্যা সম্বন্ধে বলতে চাই। এই শিক্ষা পদ্ধতির ফলে মুসলমান সমাজ অনেকটা অন্যান্য উন্নতিমুখী জাতির উপর ক্রমশ বোঝাস্বরূপ (drag) হয়ে উঠছে- এখনই ভালো করে সমঝে দেখা প্রয়োজন। বর্তমান জগতের যে যে দেশে মুসলমান আছে সেই সেই দেশে তাদের অবস্থা নিতান্ত হীন। তাদের দুরবস্থা তত্তৎদেশের অমুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নতির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন আমাদের শ্রদ্ধেয় শহিদুল্লাহ সাহেবের পত্রে পড়লাম যে, ফ্রান্সের মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থা বাংলাদেশের মুসলমানদের চেয়ে খুব ভালো নয়। গত বৎসর প্রফেসর লিমের মুখে শুনেছিলাম চীনের কোটি কোটি মুসলমান নিতান্ত দুঃস্থ নিরক্ষর ও নির্বোধ। এ সমস্ত কথার আস্থা স্থাপন আমরা নাও করতে পারি, কিন্তু একথা ঠিক যে, বর্তমান জগতের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য কোনো দেশের কোন মুসলমান কোন উল্লেখযোগ্য কিছুই সৃষ্টি করেননি। বর্তমান দর্শন, বিজ্ঞান, আর্ট ঘেঁটে দেখুন মুসলমানের সৃষ্টি কিছু নাই বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। অবশ্য আমার জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ। যদি কেউ আমাকে দেখিয়ে দিতে পারেন তবে আমি খুব বাধিত হব। কিন্তু যদি এই কথা সত্য হয় তাহলে কি খুব লজ্জার কথা নয়? জ্ঞানের রাজ্যে মুসলমান একেবারে গরহাজির; এর কারণ কি? যে মুসলমান একদিন নতুন নতুন তথা আবিষ্কার করে শ্রী, কল্যাণ ও জ্ঞানকে বহুমুখী করে ছড়িয়ে দিয়েছিল তারই বংশধর আজ বিপুল অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। এটা ভাববার কথা।

মুসলমানদের এই দুর্গতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ডা. Crozier তাঁর ‘Progress and Civilization গ্রন্থে বলেছেন, ‘Islam did open up and outlet first social aspect of human thought and aspiration but soon its secret structure begin to reveal itself and was found to be incapable of expansion, give wit of sympathy and fatal maternal and intellectual advancement. The Quran professed to be not only a spiritual revelation but a scientific treatise; to close not only the book of inspiration but the book of knowledge. It accordingly discouraged all attempts of man who discovered the order of the world and thereby to improve his condition; its central doctrine led him to response indolently on the decrease of an inexpensive fate. The consequence was under this belief human mind stagnated ; as we see at this hour in those nations that a deeply imbued with its spirit, progress, civilization and morality lie rotting together.’ অর্থাৎ ‘সত্যই ইসলাম মানব চিন্তার ও আকাঙ্ক্ষার সামাজিক দিকটা বিকৃত করবার জন্য একটা পথ উন্মুক্ত করেছিল; কিন্তু শীঘ্রই ইহার মূল ভিত্তি ও গঠন প্রকাশিত হয়ে পড়ল- ফলে দেখা গেল ইহার উপর সৌধ নির্মাণের আর কোন উপায় নাই- এবং ইহা বৈজ্ঞানিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞান বৃদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোরআন যে কেবল ধর্মগ্রন্থ বলে দাবি করে তাহা নহে, সর্বজ্ঞানের ভান্ডার বলে পরিচিত। কুরআনের আবির্ভাবে শুধু যে খোদার বাণী রুদ্ধ হয়েছে তাহা নহে, সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানও রুদ্ধ হয়েছে। কোন পুস্তক নাই বা হবে না, যা কখনো কুরআনের সমকক্ষ হবে- এটা হল মুসলমানের ধর্মমত। কাজেই, এই বিশ্বাসের বশবর্তী মুসলমানরা জগতের রহস্য উদঘাটনের সর্বচেষ্টা ত্যাগ করেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বকীয় জীবনের শ্রী ও সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টাও ত্যাগ করেছে। তকদিরের উপর সমস্ত দোষ চেপেই সে নিষ্কৃতি লাভ করতে চাচ্ছে। এতে মুসলমানের মন ও কর্মস্রোত রুদ্ধ হয়ে গেছে। তাই দেখতে পাই যেখানে মুসলমান সেখানে উন্নতি, সভ্যতা ও নৈতিক-বল সমস্তই একাধারে ধ্বসে যাচ্ছে।’ এ কথা হয়তো ষোল আনা ঠিক নয়; কিন্তু এর মধ্যে যে সত্যটুকুর ইঙ্গিত আছে সেটা আজ প্রণিধানযোগ্য।

এখন আমাদের ঘরের দিকে তাকাই। আজ আমরাও যে উন্নতিমুখী হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল শুভ চেষ্টায় আমাদের দুর্বুদ্ধি ও দুর্গতির দ্বারা বিঘ্ন ঘটাচ্ছি তা বোধ হয় প্রমাণ করতে হবে না। তারই কারণ নির্ধারণ করা এই প্রবন্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য। আজ আমাদের কৃতজ্ঞতার সহিত স্বীকার করতে হবে যে ব্রিটিশরা এদেশে পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করেই দেশবাসীর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছে। প্রথমত সে ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের আইন-কানুন জানতে হলে তাঁদের ভাষা পরিচিতি ও গ্রন্থের চর্চা করা প্রয়োজন। এজন্য ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা মাদ্রাসা এবং জোনাথন ডানকান ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে বেনারেসে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলিকাতা মাদ্রাসা সর্বপ্রথম ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা কেন্দ্র। সরকার এই উভয় শিক্ষা কেন্দ্রে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আরবি ও সংস্কৃত শিক্ষার বিস্তার দ্রুত চলতে থাকে। স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রমূখ পণ্ডিতগণের গবেষণায় আরবীয় সংস্কৃতি বিদ্যার চর্চা বহুল পরিমাণে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড মিন্টো দেশীয় বিদ্যার সঙ্গে ইউরোপীয় জ্ঞান-চর্চার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিন্টোর প্রস্তাব কার্যে পরিণত করা হয় নাই। উক্ত টাকা আরবি এবং সংস্কৃত গ্রন্থসমূহ মুদ্রিত করবার কাজে ব্যয় করা হয়।

ইতিমধ্য দুইটি কারণের আবির্ভাবে সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয়। প্রথমত খ্রিষ্টান পাদ্রীদের চেষ্টা এবং দ্বিতীয় কারণ ইউরোপীয় শিক্ষার জন্য কলিকাতার তৎকালীন চিন্তাশীল দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হিন্দুনেতৃবর্গের স্বতঃপ্রণোদিত দাবি ও আন্দোলন। স্কটিশ চার্চ, কলেজ ও মাদ্রাসা খ্রিস্টান কলেজ পাদ্রিদের কীর্তি; আর হিন্দু কলেজ হিন্দুনেতৃবর্গের সেই আন্দোলনের ফল। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিবৃত করার আর প্রয়োজন এখানে নাই; কিন্তু যে মহাপুরুষ এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণ ছিলেন তার দুই-একটি কথা এখানে উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করি। রাজা রামমোহনই সর্বপ্রথম ‘ইউরোপীয় শিক্ষা’র জন্য ভারতবাসীর আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই তিনি ইংরেজিতে দক্ষ হয়েছিলেন; শুধু ভাষায় নয়, ইংরেজি দর্শন, ইতিহাস ও কালচারে তিনি বিশেষ অভিজ্ঞ হয়েছিলেন। তখনও দেশে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। রামমোহন শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন প্রণালী অবলম্বন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। এই নব-পদ্ধতির দ্বারা তিনি দেশবাসীর গতানুগতিক স্থিতিশীল মনের উপর পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। তিনি স্বয়ং অতীতের কুসংস্কার ও ধারণা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত উজ্জ্বল হয়ে দেশবাসীকে গলা ছেড়ে এই নবশিক্ষায় আহবান করেছিলেন। কলকাতায় যখন প্রথম সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব হয়, তখন তিনি তার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের পরিবর্তে আধুনিক আর্ট কলেজ এর আদর্শে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ জেমস বলেন, ‘To him must be ascribed the introduction of liberal education in Bengal’ বাংলার আধুনিক শিক্ষার জন্য সমুদয় বাহাদুরি রামমোহনের প্রাপ্য! তিনি এই সম্পর্কে বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে যে পত্র লিখেন তার মধ্যে তিনি সংস্কৃত শিক্ষার বিরুদ্ধে অনেক কথা প্রকাশ করেন। এ স্থলে তিনি বলেন, ‘The Seminary (Proposed Sanskrit School) similar in character to those who is existed in Europe before the time of Lord Bacon, only be expected to load the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practical use to the possessors or to society.’ অন্যস্থলে তিনি বলেন, ‘It had been intended to keep the British Nation in ignorance of real knowledge. The Baconian philosophy would not have been allowed to displace the system of the Schoolmen which was the best calculated to perpetuate ignorance. In the same manner, the Sanskrit system of Education would be the best calculated to keep the country in darkness, if such had been the policy of the British legislature. But as the improvement of the native population is the object of the Government; it will consequently promote a more liberal and enlightened system of instruction, Mathematics, Natural philosophy, chemistry, anatomy, other useful science which may be accompanied with the sums of propose by employing a few gentlemen of talent and educated in Europe and providing a college furnished with necessary books, instruments and other apparatus.’ এই পত্রে স্পষ্ট বুঝা যায় যে ফারসি, আরবী ও সংস্কৃতি শিক্ষায় যে এদেশের কোন কল্যাণ সাধিত হবে না এবং ইংরেজি শিক্ষা ব্যতীত দেশের কুসংস্কার দূরীভূত হবে না তাহা রামমোহন সম্যকরূপে উপলব্ধি করেছিলেন। এই দূরদর্শিতার ফলে এদেশের যুগসঞ্চিত দৃঢ়নিবদ্ধ ধারনাকে উচ্ছেদ করতে তিনি যে বিপুল সহায় হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। বাংলা তথা ভারতের সৌভাগ্য যে, সে যুগে রামমোহনের মত মহাপুরুষ জন্মেছিলেন এবং তার সঙ্গে মহাচেতা ডেভিড হেয়ার এবং স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট সংযুক্ত হয়েছিলেন।

কিন্তু দুঃখের সহিত লিখতে হবে যে, আজ পর্যন্ত মুসলমান সমাজে রামমোহনের মত পাশ্চাত্যজ্ঞানদীপ্ত প্রতিভার আবির্ভাব হয় নাই। রামমোহন যখন পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য আন্দোলন করেন তখন মুসলমান রাজ্যহীন হয়ে ক্ষোভে-দুঃখে ইংরেজকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে থাকে। সুতরাং ইংরেজি শিক্ষার কথা তার মুখ ফুটে উঠতেই পারে না। মানুষ সাধারণত প্রাচীনপন্থী স্থিতিশীল। শিক্ষা ক্ষেত্রে একথাটি আরও সত্য। ওয়ারেন হেস্টিংস এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মুসলমান সমাজকে স্থির করবার জন্য কলকাতা় মাদ্রাসা স্থাপিত করেন।

দূরদর্শী হিন্দু নেতৃবর্গ কাল বিলম্ব না করে এবং মুসলমানদের মতো আক্ষেপে দিন না কাটিয়ে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানকে আয়ত্ত করবার জন্য হিন্দু কলেজের ভিত্তি স্থাপন করেন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। হিন্দু কলেজ কালক্রমে প্রেসিডেন্সি কলেজে পরিণত হয়। মুসলমান সমাজ কলকাতা মাদ্রাসা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকল। কলকাতা মাদ্রাসার পর চট্টগ্রাম ঢাকা হুগলি মাদ্রাসা ব্যতীত সরকার ১৯২৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানদের জন্য অন্য কোন শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন নাই কিংবা ১৯২৬ সালের প্রতিষ্ঠিত সাদাত কলেজ ব্যতিত মুসলমান সমাজ স্বাধীনভাবেও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য কোন শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে নাই। তার কারণ মুসলমান সমাজে তার জন্য তীব্র কোন আন্দোলন হয় নাই। হিন্দু নেতৃবর্গ যাহা ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করতে সরকারকে বাধ্য করেছিলেন তাহাই মুসলমান সমাজ পেয়েছে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মাত্র ১৯২৬ সালে। এই হিসাব ধরলে বলতে হবে মুসলমান সমাজ হিন্দু সমাজের ১০৯ বৎসর পশ্চাতে। একশ নয় বছরের জের যদি পূরণ করতে হয় তাহলে যে আজ মুসলমানকে কি করা উচিত তাহাও মুসলমান নেতৃবর্গ অবগত নন। যদি ১৮১৭ সালের হিন্দু কলেজের শিক্ষকদের সহিত বর্তমান ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষকদের তুলনা করি তাহলে বুঝতে পারা যায় মুসলমান সমাজে প্রকৃত শিক্ষার জন্য কোন ক্ষুধা নাই কিংবা তার জন্য কোন আকাঙ্ক্ষাও নাই। ডিরোজিওর মত শিক্ষক হিন্দু সমাজের শিক্ষাকে কতখানি উন্নত করেছেন তা ভাবলে সত্যিই ইসলামিয়া কলেজের ব্যবস্থা দেখে নিতান্ত নিরাশ হতে হয়। বর্তমান মুসলমান সমাজ কি ডিরোজিওর মত লোককে আর এখন পেতে পারেন? কখনও নয়। এমন অবস্থায় ইসলামিয়া কলেজের যে সমস্ত বিষয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা আরও অধিকতর উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের হাতে দেওয়া উচিত ছিল। এইরূপ অল্প উপকরণ দিয়ে এই কলেজ কেমন করে মুসলমানের জ্ঞানকে প্রস্ফুটিত করতে সমর্থ হবে তা ভেবে পাইনা। যে সমস্যার সমাধান কল্পে হিন্দু সমাজ হিন্দু কলেজ পেয়েছিল আজ ১০০বছর পরে আমাদের সেই সমস্যা বিষম হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু ওই সমস্যা ঠিক ১৮১৭ সালের ব্যবস্থা ধারা সমাধান করলে প্রকৃত সমাধান পাওয়া যাবে না। আজ আমাদের নতুন করে সে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

একশত বৎসর পূর্বে হিন্দু সমাজ সংস্কৃত শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে পাশ্চাত্যজ্ঞানকে বরণ করেছিল-  একশত বছর পরে আমরা সেই আরবি শিক্ষাকে পুনঃপ্রবর্তিত করেছি নবপ্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা সমূহে। প্রাচীন শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করে যে প্রকৃত শিক্ষা হয় না সেই বুদ্ধি আজও আমাদের হয় নাই। আজ তাই আমরা প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে একটুখানি ইংরেজি জুড়ে দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা দিচ্ছি।

সেনসাস ঘেঁটে দেখি একটি হিন্দু ছেলে আট বৎসর বয়সে যা আয়ত্ত করে ঠিক তাই আয়ত্ত করে একটি মুসলমান ছাত্র এগারো বৎসর বয়সে। কাজেই শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চ শিক্ষায় মুসলমান হিন্দুর কাছে হটে যেতে বাধ্য। মুসলমানদের ধর্ম শিক্ষার জন্য উৎকট উদ্বিগ্নতা। কথা না বলতে শিখতে দুর্বোধ্য আরবি শব্দের সঙ্গে লড়াই করতে বাধ্য হয়। হয় পিতা না হয় শিক্ষক বেত্রহস্তে সেই আরবি শব্দ কণ্ঠস্থ করাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। প্রতিদিন প্রাতে যখন শিশুরা প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যের সহিত একটু পরিচয় করবে ঠিক সেই সময় তাকে কোরআন বগলে কি কাঁধে করে মসজিদে যেতে হয়। সেখানে ওস্তাদজীর সেই নিদারুণ বেত্রাঘাতের সহিত তার জীবনযুদ্ধ আরম্ভ হয়। সেই নিষ্ঠুরতার দৌরাত্ম্যের মধ্য মুসলমান ছাত্রের ধর্মশিক্ষা আরম্ভ হয়। অতি কষ্টে আরবি শব্দ কণ্ঠস্থ করতে করতে তার শিক্ষার প্রতি তীব্র ঘৃণার উদ্রেগ হয়। সুকুমার-মতি শিশুদের অনেকেই এই নিষ্পেষণের চাপে একেবারে ভেঙে পড়ে। একদিকে তার সম্মুখে আরবি ভাষা অন্যদিকে ওস্তাদজীর তাম্বি ও বেত্রাঘাত- এই উভয় সংকটের মধ্যে মুসলমান শিশুর শিক্ষা শুরু হয়। এই জবরদস্তির ফল যে বিষময় সময় হয়েছে সমাজপতিরা আজও তা খতিয়ে দেখছেন না- কোরআন খতম করে অনেকেই শিক্ষার হাত হতে চির বিদায় গ্রহণ করে এবং উত্তরকালে তারাই নানাবিধ ও অধর্মের অনুষ্ঠান করে। কোন এক দার্শনিক বলেছেন, morality enforced is immorality in fact. জবরদস্তিতে ধর্ম শিক্ষা দিলে তার ফল বিপরীতে ফলে। মুসলমান সমাজের মধ্যে আজ যারা নানা কু-আচারে লিপ্ত তাদের বাল্য জীবনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তাদের অনেককেই একমাত্র সম্বল সেই বেত্রাঘাত খেয়েছে এবং সেই বেত্রাঘাতই তাদিগকে বিপথে চালিয়েছে। শিক্ষার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা যে এহেন কোরআন শিক্ষার আশু-ফল তা প্রমাণ করার জন্য বেশি কষ্ট পেতে হয় না। যে সমস্ত ছাত্র মসজিদে কোরআন পড়েছে তাদের কয়জন শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি করেছে? আর যারা সৌভাগ্যক্রমে কোরআন শিক্ষার পর বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তারা সাধারণত পরিণত – বয়স্ক – কিন্তু তাদের মস্তিষ্কের শক্তি দুর্বোধ্য ভাষা কন্ঠস্থ করতে করতে যথেষ্ট পরিমাণে কাহিল হয়ে পড়ে এবং তাদের মানসিক স্ফূর্তি একেবারেই থাকে না। এমতাবস্থায় মুসলমান ছাত্র অনেকটা আধমরা হয়ে যেন শিক্ষা লাভ করতে যায়। তার নিকট হতে বেশি আশা করা বাতুলতা। এজন্য আমাদের শিক্ষা-পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে দায়ী।

ব্রিটিশের প্রতি বিদ্বেষ-বশত মুসলমান সমাজের সারথিগণ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করলেন। সে ফতোয়ার বিষময় ফল আজও সমাজের শিরায় শিরায় বর্তমান। কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর মুসলমান শিক্ষার্থী মাদ্রাসাতে ভর্তি হয়েছে কিন্তু ইংরেজি বিদ্যালয়ে খুব কম আকৃষ্ট হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাই বাঙালি মুসলমানদের জীবনে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। মাদ্রাসা হতে উত্তীর্ণ হয়ে মৌলবি সাহেবগণ গ্রামে গ্রামে ধর্ম শিক্ষা দিয়ে স্ব স্ব উদরান্নের সংস্থান করেছেন। তাদের সেই ধর্মব্যবসাকে উঞ্ছবৃত্তি (অনিশ্চিত জীবিকা) ব্যতীত আর কিছুই বলা যায় না। তারা পল্লীতে পল্লীতে ঘুরে নিরক্ষর গোমরাহ নির্বোধ মুসলমানকে শিষ্যত্ব বরণ করে তাদের মূর্খতাকে ক্রমশ পাকিয়ে তুলেছেন। যে সমস্ত উপাখ্যান, উপকথা আউড়ে তারা ইসলামের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করেছেন এবং ইসলামের প্রবর্তক মহাপুরুষ মহম্মদকে নানা কুসংস্কারের আবর্জনা আদৃত করে তাদের সম্মুখে ধরেছেন এবং তদ্বারা শ্রমক্লান্ত পানাহার-অন্বেষণে সদাব্যস্ত পল্লীবাসী মুসলমানদের ধারণা ও বুদ্ধিকে যেরূপে বিকৃত করেছেন তাতে আজ তারা এক অপরূপ জীবে পরিণত হয়েছে। তাঁদের জীবনে শ্রী নাই- তারা এ দুনিয়ার সৌন্দর্য সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কোন আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে শেখে নাই। কালক্রমে শিক্ষা ও সম্পদ অর্জনের উপযোগী জ্ঞানের অভাবে যখন গ্রাম্য মুসলমানের সঙ্গতি কমতে শুরু করল ও সঙ্গে সঙ্গে মৌলবি সাহেবগণের উঞ্ছবৃত্তিও অর্থ লাভের প্রতিকূল হতে লাগল তখনই তারা অর্থকরী অর্থাৎ ‘চাকরি করা বিদ্যা’ ইংরেজি শিক্ষার অনুভব করলেন। তখন ইংরেজি শিক্ষা জায়েজ করবার জন্য নানা হাদিস খুঁজে বের করা হলো। তারা গ্রামে গ্রামে দুই একটি ছেলেকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে দিতে থাকলেন এবং তাদের আদর্শ দেখে নিরক্ষর পল্লীবাসী মুসলমানরাও ইংরেজি বিদ্যালয়ের পক্ষপাতী হলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইংরেজি বিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রের ক্রমাগত বর্ধন ঘটেছিল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রফট সাহেব তার রিপোর্ট লেখেন, অবস্থাসম্পন্ন মুসলমান ছাত্র ইংরেজি বিদ্যালযয়ে দ্রুত প্রবেশ করছে।’ দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি দেখান, ‘১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিভাগে মাত্র ৮৫৬ জন মুসলমান ছাত্র ছিল, ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে ১৩২৬১ জনে উন্নীত হয়।’ ভূদেব বাবুও বলেন, ‘দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি পাবনা প্রভূতি জেলার ভদ্র মুসলমানগন কোরআন শিক্ষা ব্যতীত আরবি বিদ্যালয় শিক্ষাকে নাপছন্দ করেন এবং ক্রমশ ইংরেজি বিদ্যালয়গুলি তাদের আদরণীয় হয়ে উঠেছে।’

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরবি শিক্ষার প্রতি মুসলমান জনসাধারণের (masses) বিশ্বাস ও ভক্তি এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ অক্ষুণ্ণ রইল। বিশেষত মাদ্রাসা হতে উত্তীর্ণ মৌলভী সাহেবগণ তাদের পেশা বহাল রাখবার জন্যই হোক বা অন্য কারনেই হোক ঐ বিশ্বাস (credulity) অটল করে রাখতে সহায় হলেন। পক্ষান্তরে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান আরবি শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। এইরূপে মুসলমান সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দুইটি ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। উভয় দলের সঙ্গে কোনো রফা বনিবনাও হলো না; বরং একে অপরের নিন্দা অপবাদ দিয়ে সমাজের জনসাধারণকে বিব্রত করতে লাগলেন। জনসাধারণ মৌলভী সাহেবদের প্রভাবে যুব সঞ্চিত কুসংস্কার-পীড়িত হয়ে ইংরেজি শিক্ষিতগণকে ঘৃণা করতে লাগলো। তারা তাদের প্রচারিত ধর্ম বিশ্বাসের প্রভাবে যে তিমিরে সেই তিমিরেই পড়ে থাকল। প্রকৃত শিক্ষার কথা তাদের কানে কি পৌঁছায়? শিক্ষিতগণ সরকারের চাকুরীতেই জীবন কাটাতে লাগলেন। মুসলমান সমাজে চিন্তাশীল লোকের আবির্ভাব হলো না। আরবি শিক্ষাকে ইংরেজি শিক্ষা দ্বারা আধুনিকায়ন করে দর্শন ও বিজ্ঞানের আলোকে নতুন করে প্রবর্তিত করবার কথা মুসলমান সমাজের মনে জাগল না। আরবি শিক্ষা যে আধুনিক জগতের জীবন সমস্যার সমাধানের অনুকূল নয় সে কথা মুসলমান আদৌ বুঝল না। মধ্যযুগের প্রবর্তিত কালাম মন্ত্র বালাগাত শিক্ষার জন্য শক্তি ও অর্থ খুঁজে বর্তমান যুগের পক্ষে অনেকখানি নিরর্থক, সে কথা গলা ছেড়ে বলার মতো শক্তিমান পুরুষের আবির্ভাব আজও মুসলমান সমাজে হয় নাই। ইংরেজি ও আরবির যে সমন্বয় বর্তমান যুগের প্রয়োজন সিদ্ধ হতে পারে, তেমন সমন্বয়ের চেষ্টা আজও হয় নাই। ফলে, ইংরেজি-আরবি দ্বন্দ্ব এখনও প্রবলরূপে বিদ্যমান থাকায় সমাজ-মনের ঋজুতা ও একাগ্রতা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব চুকিয়ে ফেলবার জন্য কিছু চেষ্টা যে হয় নাই তা বলা যায় না। দুঃখের বিষয় সে চেষ্টায় এমন কোন শক্তিমান পুরুষের হাত পড়েনি- যার জ্ঞান ও রুচি প্রাচ্য প্রতীচ্যের সংযোগ-সাধন করতে পারে এবং মুসলমানের মুক্তির জন্য যার বুদ্ধি ও অনুভূতি সম্পূর্ণ সজাগ। যে চেষ্টা হয়েছে তার ফলে ১৯১২ সালে পুরাতন আরবি মাদ্রাসাগুলির পরিবর্তে নতুন মাদরাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিবর্তন কিছুই হয় নাই- পাঠ্য তালিকায় ইংরেজি ও বাংলা সংযুক্ত হয়েছে, কেননা তা না হলে চাকরি পাওয়া দুষ্কর। সরকারের ঘরে চাকরি জু্টাতে হলে ইংরেজি জানা দরকার- কিন্তু জনসাধারণ শুধু ইংরেজি শিখতে নারাজ অথচ চাকরির জন্য উদ্বিগ্ন। এমন অবস্থায় ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত না করে কিংবা আধুনিক জগতের দাবির দিকে লক্ষ্য না করেই নব মাদ্রাসাশিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হলো। পুরাতন মাদ্রাসার সমস্তই থাকল, কেবল ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ও উর্দু’র পরিবর্তে বাংলা শিখবার ব্যবস্থা করা হলো। এই পদ্ধতি মুসলমান সমাজের যে মনঃপূত হয়েছে তা সরকারের কাগজপত্র হতে প্রমাণ করা যায়। মুসলমান জনসাধারণ এখন ছাত্রকে মাধ্যমিক ইংরেজি বা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে, পাঠায় জুনিয়র ও সিনিয়র মাদ্রাসায়। এইগুলোতে দুই বাঘ পড়বে- দীনও হবে দুনিয়াও হবে। ছেলেরা ইংরেজি শিখে আর কাফের হবে না। তাদের লুঙ্গি, টুপি, কুর্তা সমস্তই ঠিক থাকবে-মনের মধ্যে কোন বদ খেয়াল ঢুকবে না, মাতা পিতার আর শঙ্কার কারণ থাকবে না। এমন চমৎকার শিক্ষা পদ্ধতি আর কোথায় পাওয়া যাবে?

এইরূপে জনসাধারণের অন্ধবিশ্বাসকে (credulity) এমনি করে ব্যবহার করা হয়েছে যে M.E ও H.E School হতে মুসলমান ছাত্র সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। শিক্ষা বিভাগের রিপোর্টে দেখি:

১৯২৩-২৪ ১৯২৪-২৫ ১৯২৫-২৬
M.E School  শতকরা ১৫.২% শতকরা ১৪.৪% শতকরা ১৩.২%
H.E School শতকরা ১৯.৪ % শতকরা ১৮.৫% শতকরা ১৬.৪%


কারণ মক্তব নবপ্রবর্তিত মাদ্রাসা ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং মুসলমান অভিভাবক ঐ মাদ্রাসাতেই ছাত্র পাঠাতে অতিশয় উদ্বিগ্ন।

১৯২৩-২৪ ১৯২৪-২৫
মাদ্রাসা  ৩৪৬ ৩৭৪
ছাত্র ২৬,১৫৬ ৩১,৬১৩
সরকারি ব্যয় ৩,৩৯,২৯৬ ৬,১৯,৭৭৬


*শতকরা ৪২ জন মুসলমান ছাত্র মক্তবে পড়ে।

পরবর্তী অংশ পড়তে ক্লিক করুন

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন