প্রবন্ধধর্মবাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা | আবুল হুসেন

বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা | আবুল হুসেন

শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহ এই অঞ্চলে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ। আবুল হুসেন যে সময়ে বাঙালি মুসলমানের সমস্যা নিয়ে এই লেখাটি লিখেছিলেন, তার থেকে প্রায় ৮০ বছর পরে এসেও বাঙালি মুসলমান একই সমস্যায় দাঁড়িয়ে আছে।

বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা | আবুল হুসেন

শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহ এই অঞ্চলে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ। আবুল হুসেন যে সময়ে বাঙালি মুসলমানের সমস্যা নিয়ে এই লেখাটি লিখেছিলেন, তার থেকে প্রায় ৮০ বছর পরে এসেও বাঙালি মুসলমান একই সমস্যায় দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম অংশ পড়তে ক্লিক করুন

নব মাদ্রাসার শিক্ষা যে আদরণীয় হচ্ছে তার কারণ- ইহাতে আরবি ও ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ভালোভাবে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে যে এই শিক্ষায় মুসলমান সমাজের জীবন শ্রীসম্পন্ন হবে না- তার মন জাগবে না- রুচি ফিরবে না- বুদ্ধি বিকশিত হবে না- জগতের জ্ঞান গ্রহণ করতে তার শক্তিও বাড়বে না। শুধু ভাষা শিখলেই যে জ্ঞান বর্ধিত হয়, বুদ্ধি বিকশিত হয়, মন সম্প্রসারিত হয়, কর্ম শক্তি বাড়ে, এরূপ ধারণার বশবর্তী হয়েই বোধহয় প্রবর্তকগণ নব-মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু শিক্ষাতত্ত্ববিদগণ একবাক্যে বলবেন, এরূপ ধারণা নিতান্ত ভুল। মন বিকশিত ও বুদ্ধি সজাগ করতে যে সমস্ত বিষয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ছাত্রের সামর্থ্য অনুসারে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, সেগুলি প্রকৃষ্ট উপায়ে শিক্ষার ব্যবস্থা যে শিক্ষা পদ্ধতিতে থাকেনা সে পদ্ধতি জীবন সমস্যা সমাধান করতে পারে না। যে- শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক নাই- সে শিক্ষা পঙ্গু, যেমন যে জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক নাই সে জীবন অন্ধ। যে- শিক্ষা হৃদয় প্রশস্ত করে না – বুদ্ধিকে জাগ্রত করে না – চিত্তকে মার্জিত করে না – সংস্কার হতে মুক্তি দেয় না, সে-শিক্ষা জাতির প্রাণ বিনাশ করে। সংকীর্ণ মন নিয়ে কোন জাতি টিকে থাকতে পারে না। শ্রদ্ধেয় প্রমথ চৌধুরী মহাশয় বেশ বলেছেন, ‘মনোজগতে যে জাতি একঘরে সে জাতি পতিত।’

মাদ্রাসা শিক্ষার পরিনাম চিন্তা করলে আমার ঐ কথাটাই মনে পড়ে। আজ নব মাদ্রাসায় বর্তমান জগতের দর্শন, ইতিহাস বা আর্ট কিছুরই স্থান নাই। অথচ যে সমস্ত শিক্ষা কেন্দ্রে এই সমস্ত বিষয় স্থান করা হয়েছে সেখানে মুসলমান যাচ্ছে না। আর কিছুকাল পরে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা সাধারণ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিতান্ত কম হয়ে যাবে। তখন এই নব-মাদ্রাসা হতে উত্তীর্ণ ছাত্রগণ তাদের সংকীর্ণ মন, স্বল্প-দৃষ্টি, আড়ষ্ট বুদ্ধি নিয়ে মুসলমান সমাজকে জগতের অন্যান্য শক্তিমান, জ্ঞান দীপ্ত জাতির সম্মুখে নিত্যান্ত হেয় বলে প্রতিপন্ন করবে। নব মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষা ও জীবনের সঙ্গে যোগ সাধন করতে পারে নাই। এরূপ শিক্ষা খাপ খায় না, মনকে মুক্ত করতে না পারে, সে-শিক্ষা জীবনকে সরস সুন্দর করতে পারে না। যে শিক্ষা মন মুক্ত ও শক্তিশালী করতে পারে না, সে শিক্ষা শিক্ষাই নয়।

এস্থলে শিক্ষার উদ্দেশ্য কি এ সম্বন্ধে কিঞ্চিত আভাস দেওয়া প্রয়োজন মনে করি। শিক্ষার উদ্দেশ্য দেশ-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন। কোনো দেশে কোনো কালে কোনো এক ব্যক্তি শিক্ষার উদ্দেশ্যে একান্ত করে চিরকালের জন্য নির্ধারিত করতে পারে না। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনও পরিবর্তিত হয়- সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের উপায় ও পরিবর্তিত হয়। মানুশের জীবন বিবিধ ও উপকরণ দ্বারা পুষ্ট হয়। সেই সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করবার শক্তি অর্জন এবং মানুষের মস্তিষ্ক হৃদয়, ও হস্ত পদ আদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সম্পূর্ণ বিকাশ সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে শিক্ষার আবশ্যক তাতে মানুষ আপনার শক্তি প্রখর করে – জগতের রহস্য অবগত হয় – সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং বিশ্ব স্রষ্টার অপরূপ শক্তিতে আস্থাবান হয়ে তার দিকে ক্রমশ আকৃষ্ট হয়। ব্যক্তি হিসেবে মানুষকে জানতে হবে – কী তার বর্তমান কী তার অতীত এবং ভবিষ্যতে কী তাকে হতে হবে সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয় ও মন কে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত করতে হবে। বুদ্ধি প্রখর হলে তার দৃষ্টিশক্তি বাড়ে এবং হৃদয় সম্প্রসারিত হলে প্রেম ও অনুভূতি জাগে।

যে শিক্ষা হৃদয়ও মনের চর্চায় বিঘ্ন ঘটায় সে- শিক্ষা জাতির পক্ষে মারাত্মক। হৃদয়, মন, ইন্দিয়া দির বিকাশ সাধনের সঙ্গে ধর্ম স্পৃহা কেউ জাগ্রত করতে হবে। তবেই মানুষের সমুদয় শক্তি প্রখর হবে। এইরূপে মানুষের অনন্ত সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে যে শিক্ষার দ্বারা, সে শিক্ষার চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক উন্নতি ও ঐশী গুণ সাধন। এইজন্য হযরত বলেছেন, ‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’ (খোদার গুণাবলী লাভ করতে চেষ্টা কর)। মানুষের চরম বিকাশের প্রথম পথ হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি (emancipation of intellect)- যাতে জগতের প্রয়োজন অনুসারে যুগ ধর্মের ইঙ্গিত অনুসারে স্বীয় জীবন নিয়ন্ত্রিত করা সহজ হয়। অতীতের কোন যুগ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে যারা বর্তমানকে অস্বীকার করে তাদের বুদ্ধি মুক্ত নয়। সুতরাং তাদের শিক্ষাও অসম্পূর্ণ। বর্তমান জগতে যে সমস্ত জাতি জগতের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে প্রাণপণ করছে তারাও একদিন অতীতের কোনো ধর্ম-গুরুর বাণীকে চিরন্তন সত্য মনে করে সম্মোহিত হয়ে ছিল- জগত আপন মনে নানা আবর্তন বিবর্তন এর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছিল- কিন্তু তাদের কোন খেয়ালই ছিল না- হঠাৎ একদিন কোন বিদ্রোহীর চরম আঘাতে জেগে উঠে দেখে- যে সত্য তারা আঁকড়ে বসে আছে সে সত্য কোন সমস্যাই তাদের সমাধান করতে পারছে না। তখন থেকে তারা সে সত্যকে পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যস্ত হয়েছে। তা করতে গিয়ে তারা অনেক প্রাচীন সত্যকে ত্যাগও করেছে। তার কারণ তাদের বুদ্ধি মুক্ত হয়েছে। বুদ্ধি মুক্ত হলে জগৎ ও জীবনই যে পরম সত্য, কেবল তা বুঝার শুরু হয় না- বরং তখন মানুষ আপনার সম্পদ শ্রী সমস্ত একে একে আয়ত্ত করতে সমর্থ হয়। তখনই সে সমাজের সমস্ত অভাব পূরণ করতে ও তার দাবি রক্ষা করতে পারে। সমাজ স্থির হয়ে থাকে না- জগত যেমন চলে সমাজও তেমনি চলে। আপনা হতেই সমাজ মন পরিবর্তন লাভ করে। মানুষ শিক্ষা দ্বারা বিকশিত – শক্তি সমাজের উন্নতি সাধণে ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন সাধনে ব্যবহার করে। পরিবর্তনশীল সমাজের অভাব ও দাবি অনুসারে মানুষের শক্তি প্রবল হওয়া আবশ্যক- তজ্জন্য শিক্ষা পদ্ধতিও ক্রমশ সেই শক্তিকে প্রখর করবার জন্য পরিবর্তিত পরিবর্ধিত হওয়া আবশ্যক। এজন্য শিক্ষা ও জীবন একসূত্রে গাঁথা দরকার। জীবনের প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষা-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হওয়া আবশ্যক। যুগ বিশেষের মন্ত্র ও শাস্ত্র কন্ঠস্থকরাই চরম পদ্ধতি বলে গণ্য হলে সে শিক্ষা জীবনকে সংহত করতে পারে না। সেরূপ শিক্ষার অধীনে যারা থাকেন বাইরে এসে দেখেন জীবনের সঙ্গে তাঁরা একেবারে অপরিচিত। ফলে, দুঃখ-দৈন্যই তাঁদের ভাগ্যে ঘটে। জীবন যা চায় সে শিক্ষা তাকে তা দেয় নাই। আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষা অনেকটাই এই দোষে দুষ্ট। বিশেষত মুসলমানদের শিক্ষা পদ্ধতি আর জীবনধারা একেবারেই পৃথক।

যুগ ধর্মকে অস্বীকার করে যে জাতি শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত করে সে জাতি হতভাগ্য। মন ও হৃদয় সম্প্রসারণের জন্য মানুষের অনন্ত আকাঙ্ক্ষা আছে। সেই বিপুল আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করতে মানুষের সাধু, বিজ্ঞ, শক্তিমান নরনারীর সমবেত চেষ্টা প্রয়োজন। সেই আকাঙ্ক্ষা একবার জাগলে অন্ধকারের মধ্যে আলোকস্তম্ভের মতো উহা মানুষকে নব নব শুভ চেষ্টায় আহবান করে মনুষ্য- বিকাশ ও মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য। সে আকাঙ্ক্ষা জাগাতে হলে সর্বপ্রথম চাই উপযুক্ত শিক্ষা-পদ্ধতি। কিন্তু নব-মাদ্রাসা-শিক্ষা-পদ্ধতি পাঠ্য তালিকাটি একবার বিশ্লেষণ করলে তা বেশ বুঝা যায়, বিষয়গুলির সমাবেশ কোন শিক্ষানীতি দ্বারা সমর্থন করা যায় না। সুদূর অতীতের চিন্তাধারা প্রসূত সূত্র-সমূহ মুখস্ত করাই এই শিক্ষার উদ্দেশ্য। তাতে চিন্তার স্বাধীনতা স্ফূর্তি লাভ করে না, কারণ সে সূত্রকে অকাট্য সত্য বলে শিক্ষার্থীকে মেনে নিতেই হয়। সে তার পারিপার্শ্বিক জীবন হতে লব্ধ-জ্ঞান দ্বারা সে সূত্রকে সমালোচনা করতে পারে না। সে শিক্ষা তাকে দেওয়া হয় না। এই যে শুধু ‘মেনেই নেওয়া’ এর চাইতে শিক্ষার বিড়ম্বনা আর কি হতে পারে? এতে চিত্তবৃত্তি বিকশিত হয় না, বুদ্ধি স্তম্ভিত বিড়ম্বিত হয়ে ক্রমশ জড়তায় আচ্ছন্ন হতে থাকে। ধারণ-শক্তি এতে রুদ্ধ হয়ে যায়। চিন্তাস্রোতে ভাটা পড়ে। মাদ্রাসা-শিক্ষা মস্তিষ্কের খাদ্য জোগায় না। গণিত,- যাতে বুদ্ধি বিকশিত হয়- তার মাত্র যৎকিঞ্চিত শিক্ষা দেওয়া হয়- তার মধ্যে আবাব বীজ গণিত বা algebra গরহাজির। বর্তমানে Logic, বর্তমানে ইতিহাস ভূগোল -যাতে মনের স্ফূর্তি হয়- দৃষ্টি খোলে – হৃদয় বিকশিত হয়- তার স্থান মাদ্রাসায় নাই। মাদ্রাসার ইতিহাসের পাঠ্য- সীমা দেখলে মনে হয় ইসলামের ইতিহাস হযরত আলীর সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদুনের পরের ইতিহাস পাঠ্যপযোগীই নয় এদের নিকট। জগতের সঙ্গে পরিচয় করতে হলে যে সমস্ত বিষয় শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন তার কিছুরই ব্যবস্থা হয় নাই। সাহিত্য ও কাব্য যাতে জীবনের রুচি ও সৌন্দর্যগুণ বর্ধিত হয় তারও স্থান অতি সামান্য। এই শিক্ষায় ধর্মশাস্ত্র ও ধর্মজীবন দুটি পৃথক করতে শেখায় না। এতে এই ধারণা জন্মে যে ধর্মশাস্ত্র কণ্ঠস্থ করলে ধর্মজীবন লাভ ঘটে। ফলে, অনেক সময়ে দেখা যায় অনেক মৌলভী সাহেব ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়েও নিতান্ত গর্হিত জীবন যাপন করেন। তাঁরা কিছুতেই বুঝেন না ধর্ম জীবন যাপন করতে হলে শুধু ধর্মশাস্ত্র কণ্ঠস্থ করলেই চলে না। সঙ্গে সঙ্গে জীবন যাপনের সমুদয় কায়দা কানুনও শিখতে হয়, হৃদয় ও মনোবৃত্তিগুলির চর্চা করতে হয়। ধর্মশাস্ত্রকে কণ্ঠস্থ করে শিকেয় তুলে রাখলে চলে না। তাকে অন্যান্য পুস্তকের সংসর্গে এনে আয়ত্ত করতে হয়। বুঝতে হয় জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয় এবং তজ্জন্য আবশ্যক হলে কিছু কিছু ত্যাগও করতে হয়- কারণ জীবন আমাদের কাছে শাস্ত্রের চেয়েও সত্য। ‘জীবন নানা শাস্ত্র সৃষ্টি করে’- আজ আমাদের এই কথা ভাল করে বুঝে মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা এ জীবন সুন্দর তো হবেই না বরং ধর্মজীবনও আমাদের গর্হিত হতে থাকবে।

কেহ কেহ বলেন, মাদ্রাসায় ছেলেরা অল্প খরচে লেখাপড়া শিখতে পায়। কথাটি ঠিক-কিন্তু একথাও হয়তো আপনারা জানেন-’ সস্তার তিন অবস্থা’ সস্তা জিনিস সব সময়ই আক্রা। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর অনেকই জায়গীরে থেকে পড়েন। এই জায়গীরে যারা থাকেন তাঁদের জীবন অতি কঠোর। কিন্তু জায়গীরের থেকে শিক্ষা লাভ করে তাঁরা যতটুরালাভ করেন আমার মনে হয় তাঁরা তার দশগুণ বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হন। জায়গীরে থেকে প্রভুর হুকুম তামিল ও সুনজর বজায় করতে করতে শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা যে দিন দিন কত হীন হয়ে পড়ে তা বর্ণনা করা যায় না – পরিণামে তার চরিত্র যে দূর্বল হয়, তেজ ও সাহস যে ক্ষীণ হয়ে পড়ে তা বলাই বাহুল্য। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝা যায় তার জীবন কত ক্ষীণ, আকাঙ্ক্ষা কত দূর্বল-সাহস কত কম- মুখ কত বিশীর্ণ! সমস্ত চেহারাতেই যেন তার দৈন্য ফুটে পড়ছে; জীবনের স্বাদ যেন তার ফুরিয়ে গেছে- কোন বস্তুতেই যেন তার আর স্পৃহা নাই! এরূপ জীবন্মৃত হয়ে এই ঝঞ্ঝা পীড়িত সংসারে তার পথ কেটে বের করতে হয়। কিন্তু সে পথ কাটতে যে শক্তির দরকার সে শক্তি অর্জন করার শিক্ষা মাদ্রাসা হতে পাওয়া যায় না।

তারপর মাদ্রাসায় যেরূপ প্রণালিতে শিক্ষা প্রদান করা হয় তাও শিক্ষার্থীর মনবিকাশে অনুকূল নয়। শৈশবে মাতৃভাষার সহিত পরিচয় ঘটবার আগেই আরবি প্রাথমিক ও তার উর্দু তর্জমা কণ্ঠস্থ করতে করতে শিশুর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। ৮/১০ বৎসর বয়সেই একটি বালককে তিনটি ভাষা পড়তে হয়, আরবি, উর্দু ও বাংলা। তার দুই বৎসর পরই ইংরাজি তার উপর চাপে। ১২ বছর বয়সে তাকে চারটি ভাষার সহিত যুঝতে যুঝতে জুনিয়র মাদ্রাসা সীমা অতিক্রম হয়। তার পূর্বেই এইরূপ নিষ্ঠুর পাঠ্যপদ্ধতির চাপে অনেককে শিক্ষাক্ষেত্র হতে চির বিদায় গ্রহণ করতে হয়। এই ব্যবস্থার বিহিত প্রতিকার সত্বর করা প্রয়োজন। নতুবা আর কিছুকাল পরে দেখব আমরা ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি বিভাগে চিরদিনের তরে গরহাজির হয়েছি। হিন্দু-সম্প্রদায় উত্তরোত্তর নানা জ্ঞান আহরণ করে শক্তিমান হবে আর আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন কূপে লুকিয়ে থাকব। জগতের সঙ্গে আমরা একেবারেই যোগ হারিয়ে ফেলব। শুধু ইংরাজি ভাষা আমাদের রক্ষা করবে না। ইংরাজি ভাষার সঙ্গে ইংরাজি দর্শন বিজ্ঞান কাব্য প্রভৃতি গ্রহণ করতে হবে- হজম করতে হবে- তার উপর আমাদের ধর্ম শাস্ত্রের যুগ ধর্ম সম্মত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আমাদের শিক্ষা একমুখী করতে হবে- কেমন করে করা দরকার তা ভাবতে হবে।

এখানে আমি আমাদের শিক্ষা-সমস্যার মাত্র একটি দিক আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রয়াস পেয়েছি। এই সমস্যার অন্যদিক যথা স্ত্রীশিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনা এস্থলে করতে গেলে আপনাদের ধৈর্য হারিয়ে ফেলব। এরই মধ্যে আপনাদের ধৈর্যের অনেকখানি পরীক্ষা হয়েছে।

উপসংহারে আমি এই বলতে চাই যে, আজ আমাদের সকল দুর্গতির কারণ হচ্ছে আমাদের আড়ষ্ট বুদ্ধি- অন্ধ বিশ্বাস, বর্তমান জীবন সম্বন্ধে ঔদাসীন্য এবং বর্তমান জগতের জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কহীনতা। তার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি অনেকখানি দায়ী। মুসলমান সমাজের ঐক্য-সাধন বা একদিল করতে হলে আমাদের শিক্ষা-পদ্ধতি একমুখী করতে হবে-জগতের সমস্ত বিদ্যা বর্তমান জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। আজ আমাদের সকল শুভ চেষ্টা আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে মুক্ত করতে নিয়োজিত হোক।

– শিখা প্রথম বর্ষ, ১৯২৭

লেখাটি নির্বাচন, সংগ্রহ ও কম্পোজ করেছেন- মহিউদ্দিন শরীফ

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন