(দ্বিতীয় অংশ)
অবিশ্বাস: এক সময় ওয়াজ মাহফিলের অডিও ক্যাসেট বের হতে শুরু করে। এরপর সম্ভবত মাওলানা যুক্তিবাদী নামক এক ব্যক্তির ওয়াজের ক্যাসেট সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো। নব্বইয়ের দশকে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এসে যুক্তিবাদীর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসান। এই দু’জনের ওয়াজের মাঝে কি কোন পার্থক্য আছে? থাকলে তা কেমন?
সুষুপ্ত পাঠক: আহমদ ছফা সাঈদীর ওয়াজ সম্পর্কে বলেছিলেন, “সাঈদী যদি ওয়াজ না করে গান গাইতেন, তাহলেও খুব জনপ্রিয় গায়ক হতেন। দ্বিতীয়ত তাঁর বলার মধ্যে তিনি একধরনের ড্রামাটিক সাসপেন্স তৈরি করেন। তিনি একজন ভাল অভিনেতা এবং শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতা রাখেন। তৃতীয়ত নাটক বা গান শুনতে পয়সা লাগে, ওয়াজ শুনতে পয়সা লাগে না। চতুর্থত যৌন আবেদনমূলক ছায়াছবি মানুষ যে কারণে এনজয় করে, সাঈদীর বক্তৃতায় তাও রয়েছে। ওর বক্তৃতায় আধুনিক ব্লু-ফিল্মের উপাদান রয়েছে। তিনি যদি একঘণ্টা বক্তৃতা করেন তার মধ্যে অন্তত দশ মিনিট থাকবে যৌনতা। পঞ্চমত ব্লু-ফিল্ম দেখার পর দর্শকের মনে এক ধরনের পাপবোধ জাগে, অন্যদিকে ওয়াজ শোনার পর মনে পূণ্যের সঞ্চার হয়। সুতরাং আমি দেখলাম যে সাঈদীর জনপ্রিয়তা অস্বাভাবিক কিছু নয়”। ছফা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত থেকে কোনদিন শুনেননি। তিনি গ্রামে গিয়ে দেখেন তার ভাবী ক্যাসেটে এই ওয়াজ শুনছেন। ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রিতে যুক্তিবাদী, সাঈদী, তোফাজ্জল হোসেনদের রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। ছফার সময়ের সেই ওয়াজের বাজার আর নেই। আবদুর রাজ্জ্বাক বিন ইউসুফদের ওয়াজের ধরণ এখন অনুকরণীয়। সাঈদী ও যুক্তিবাদীর (হাবিবুর রহমান) ওয়াজে মোটা দাগে কোন তফাৎ আমার চোখে নেই। ছফা সাঈদী সম্পর্কে যা বলেছিলেন যেমন তিনি সুকন্ঠি, এটা তার নিজস্বতা। ভালো অভিনেতা, যুক্তিবাদীর হয়ত এই দিকগুলো নেই। তবে একই ক্যাটাগরির ওয়াজই তারা করতেন। অন্তত আমি যতটুকু দেখেছি।
অবিশ্বাস: নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে ওয়াজ নিয়ে মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই বলাবলি করতেন “এখনকার ওয়াজে রাজনৈতিক বক্তব্য বেশি, তাই শুনি না।” এ বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন? এক শ্রেণীর মুসলমান যে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখেন, তার ভিত্তি কী? ইসলাম কি আদৌ কোন ধর্ম নাকি অলীক বিশ্বাসাশ্রিত তীব্র রাজনৈতিক মতবাদ?
সুষুপ্ত পাঠক: …যেমন ধরেন জামাত যখন বলে নৌকায় ভোট দিলে বউ তালাক হয়ে যাবে তখন বক্তা এর সপক্ষে কোন হাদিস কুরআন হাজির করতে পারে না। কাজেই বক্তাকে সহজেই রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়। কিন্তু রাজ্জ্বাক বিন ইউসুফ যখন বলেন ভোট দেয়াই হারাম, গণতন্ত্রই হারাম তখন তিনি নির্দিষ্ট কোন মার্কাকে নিয়ে বলেন না। আর তার কথার পিছনে কুরআন হাদিসের দলিলও থাকে। এক শ্রেণীর মানুষ ধর্ম আর রাজনীতিকে আলাদা করে দেখেন যখন চরমোনাই পীর বলেন হাতপাখায় ভোট দিলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে তখন। কারণ আক্ষরিক অর্থে কুরআন হাদিসের কোথাও তো বলা নেই হাতপাখা মার্কায় ভোট দিলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে। মানুষ তখন বলে, আরে ধর্মে তো ভোটের কথাই নেই যেখানে সেখানে হাত পাখায় ভোট দিলে বেহেস্তে যাবার কথা পীরের নিজের বানানো কথা… ইত্যাদি। এই হচ্ছে এক শ্রেণীর মুসলমানের ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার ভিত্তি। এরপরও আহমদ ছফার ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ যে ভন্ডামী দেখানো হয়েছে সেটা আসলে ধর্ম বিশ্বাস করা সব আধুনিক মুসলমানের মধ্যেই দেখা যায়। এরা জানে ইসলাম গণতন্ত্রের কথা বলে না। থাকলে ইসলামী খিলাফতে ইহুদী খ্রিস্টানরাও খলিফার পদের দাবীদার হত। তবু তারা মুখে বলবে- ইসলামে গণতন্ত্র আছে। কুরআন হাদিস সীরাত কোথাও গণতন্ত্র নুন্যতম সহিষ্ণুতার চিহৃ আমরা দেখতে পাই না। ইসলাম যে পৃথিবীর বাকী ধর্মগুলোর মত জপতপ করে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতাবাদী কোন ধর্ম নয় তা কুরআন নিজেই বলছে। নামাজ রোজা হজ্ব পালন করে ইসলামের হালাল হারাম মান্য করে সাচ্চা মুসলমান হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্য পৃথিবীতে ইসলামের আগমন হয়নি। সুরা আলে ইমরানের ১৪২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা কি ভেবেছো এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে, অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদ করে এবং কারা সবর অবলম্বনকারী? হযরত ইবন উমার আবু দাউদে একটা হাদিস বর্ণনা করেছেন এভাবে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তোমরা যদি নিজেদের মধ্যে ব্যবসা করতে থাক,আর ষাঁড়ের লেজের পেছনে চলতে থাক, এবং কৃষক হিসাবেই সন্তুষ্ট হয়ে যাও আর জিহাদ ছেড়ে দাও, আল্লাহ তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন যতক্ষন তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না যাও।“ দেখা যাচ্ছে কোন মতেই ইসলামকে আপনি আর দশটা আধ্যাত্মিকবাদী ধর্মের মধ্যে ফেলতে পারছেন না। যত রকমের ইসলামি সোর্স আছে, সেখানে হাজার হাজার দলিল পাওয়া যাবে যেখানে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য বলা হয়েছে, ইসলামী শাসন অমুসলিম রাজ্যগুলো জিহাদের মাধ্যমে দখল করে কায়েম করতে হবে। ইসলাম তাই একটি সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক দর্শন ছাড়া অন্য কিছু না।
অবিশ্বাস: ওয়াজ মাহফিলে কি শুরু থেকেই সহিংস বক্তব্যের প্রচার হতো নাকি তা নিকট অতীতে শুরু হয়েছে? সহিংস বক্তব্য প্রচারের নেপথ্যে কী কাজ করে? এটা কি তারা বিরুদ্ধ পক্ষকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে করে নাকি নিজেদের অস্তিত্বের সংকট বিষয়ক শংকা থেকে করে?
সুষুপ্ত পাঠক: আমি কিছু ওয়াজ বেশ বয়স্ক ব্যক্তিদের শুনিয়েছি যারা বাল্যকালে কৈশোরে যৌবনে গ্রামে প্রচুর ওয়াজ মাহফিলে যেতেন। তারা কেউ ইহুদী কবি কাফ ইবনে আশরাফকে হত্যা করতে গুপ্তচর পাঠানোর ঘটনা জানে না! মুহম্মদকে সমালোচনা করা কবিতা লেখার অভিযোগে তাকে খুন করতে মুহম্মদ তার সাহাবীকে পাঠিয়ে ছিলেন এরকম কোন কাহিনী তারা জানে না! তার মানে কি ৪০ বছর আগে ওয়াজে এই কাহিনীগুলো ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া হতো। নাকি তখনকার হুজুরদের প্রপার শিক্ষা ছিলো না? না, শিক্ষা ঠিকই ছিলো তবে তারা মনে করত সাধারণ মানুষ এসবে ভুল বুঝতে পারে। বাংলা কুরআন ও হাদিস অনুবাদকদের আমরা যেমন দাসীকে সেক্স করা ইসলামে হালাল এই সম্পর্কিত আয়াত ঘুরিয়ে পেচিয়ে অনুবাদ করতে দেখি যাতে সহসা বিষয়টা ধরা না যায়। ইংরেজি অনুবাদেও এরকম লুকোছাপার ব্যাপার নানা বিষয়ে দেখা গেছে। এমনটা করা হয় এই ভাবনায় যে, মানুষ পুরোপুরি ইসলামে নিবেদিত না হলে এই বিষয়গুলোকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হবে। তারা তাগুদি চিন্তা ও বিবেকবোধে যেভাবে নিমজ্জিত তাতে আল্লার বিধানকেই অবিশ্বাস করে বসবে। আমার মনে হয় ৪০-৫০ বছর আগের ওয়াজে হয়ত নানা কারণে ইসলামে খুনোখুনির ওয়াজ কম করা হত। তখন ইউটিউব ছিলো না বিধায় তখনকার রেকর্ড সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিলো না। তবে এই বিষয়ে মিশ্র অভিজ্ঞতার কথা নানা জনের কাছ থেকে শুনেছি। সিলেটের একজনের কাছে শুনেছি ৪০ বছর আগে তিনি যখন বালক তখন তিনি রসূলের বিরুদ্ধকারীকে হত্যা করা জায়েজ এমন ওয়াজ শুনেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এখন কেন সহিংস বিষয়গুলো ওয়াজে বেশি আসছে। এর দুটি কারণ বলে আমার কাছে মনে হয়, একটা হচ্ছে অনলাইনের কারণে নাস্তিকদের লেখালেখি, ভিডিও তৈরির মাধ্যমে ধর্মের যে নির্মোহ বিশ্লেষণ চলছে তাতে তারা নিজের অস্তিত্বহীনতাকে দেখতে পেয়েছে। রসূলের সমালোচনাকারী নাস্তিকদের হত্যা করা ওয়াজিব এটা ওয়াজে বেশি আসছে। নাস্তিকদের ফেইসবুক ইউটিউব ভিজিট করলে সাধারণ মুসলমান হয়ত ঈমান ধরে রাখতে পারবে না এই ভয়টা তো তাদের কাজ করেই। দ্বিতীয়ত, ইসলামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রসালো করে উপস্থাপন করার কোন দরকার নেই। দ্বীন যেমন তেমন করেই মানুষকে জানাতে হবে। ইসলাম প্রচার করতে গিযে মুনাফেকি করা যাবে না। এই চরমপন্থা অবস্থানও ওয়াজে সহিংসতা আসার আরেকটা কারণ হতে পারে।
অবিশ্বাস: ব্লগার হত্যা শুরুর পর জানা গেলো জঙ্গিদের অনেকেই মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি নামক এক ব্যক্তির খুৎবার বক্তব্য ও তার রচিত বই পড়ে জঙ্গিরা ব্লগার হত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলের বক্তা হিসেবে যারা অধিক পরিচিত, তাদের কারো নাম আসেনি। সেক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের বিস্তারে ওয়াজ মাহফিলের কী ভূমিকা? ওয়াজ মাহফিল কি আসলে ধর্মের রক্ষণভাগের দায়িত্ব পালন করে? অর্থাৎ এমন একটা শ্রেণী তৈরি করে যারা জঙ্গিবাদের প্রশ্নে চুপ থাকবে, কিন্তু ধর্ম বিষয়ক যেকোন বিরুদ্ধমতকে তীব্রভাবে প্রতিহত করবে?
সুষুপ্ত পাঠক: গুলশান হামলার পর আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ ও তারিক মনোয়ারের নাম কাগজে এসেছিলো। আমি যতদূর জানি তরুণদের জঙ্গি হয়ে উঠার পিছনে তাদের ওয়াজকে দায়ী করা হলে এই দুজন যথাক্রমে দুবাই ও আমেরিকা অবস্থান করেন। সবচেয়ে বেশি যার নাম এসেছে তিনি জাকির নায়েক। তার টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কয়েকটা দেশে। বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। তার পিস স্কুল বাংলাদেশে বন্ধ করা হয়েছে শুনেছি। জসিম উদ্দীন রাহমানি সংগঠক। তিনি যে মসজিদের খতিব ছিলেন সেটা ছিলো ধনী এলাকার মসজিদ। এলাকার ইমামকে সবাই খাতির করে। বিকেলবেলা অল্পবয়েসী ছেলেদের ডেকে মসজিদে নেয়ার বিষয়টা তো বাংলাদেশে ছিলোই। লজ্জ্বায় পরে বা অনুশোচনায় পড়েই হুজুরের ডাকে মসজিদে যেতে হয়। বৈকালিক বয়ানের মাধ্যমে জসিমউদ্দীন ছেলেদের প্রাথমিক দীক্ষা দিতে সক্ষম হন। আপনি ক্রিকেট শিখতে মাঠে যাবেন কোচের মাধ্যমে টেকনিক শিখতে। আর বড় ক্রিকেটার হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইউটিউবে বড় বড় ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দেখবেন তারা কিভাবে ব্যাট চালায়। আবার টিভিতে খেলা দেখে মাঠে প্রক্টিসে গিয়ে খেলোয়ার হবার ইচ্ছা জাগতে পারে। যেমন ইন্টারনেটে সিরিয়াতে যোগাযোগ তৈরি হয়ে পরে স্থানীয় আইএসের এজেন্টের মাধ্যমে সিরিয়া যাবার ঘটনার কথা আমরা জানি। ওয়াজকে আমি প্রেরণা হিসেবে দেখি যে কিনা আগ্রহ তৈরি করে দিবে। ওয়াজ মাহফিল তো সদস্য সংগ্রহ করে না। ওয়াজ তা আপনি ময়দানে বসে শুনেন বা কম্পিউটারে- শুনে শুনে জিহাদে কতলে আগ্রহী হলে আপনি একজন জসিমউদ্দীন রাহমানির সন্ধান করবেন কারণ আপনাকে সংগঠিত হতে হবে। জাকির নায়েক সেই দায়িত্ব নিবে না। রাজ্জাক বিন ইউসুফকে তো আপনি হাতের কাছে পাবেন না। জঙ্গিবাদে চুপ আর ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো গোষ্ঠি আসলে আলোচিত ‘মডারেট মুসলমান’। ওয়াজ মাহফিল আয়োজনে হঠাৎ প্রশাসনে বাধা দিলে এরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আবার ওয়াজে চিত্র তাদের দেখালে বলে, আরে এইসব কাঠমোল্লারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয় যা ইসলাম সমর্থন করে না। তাহলে এইসব মনগড়া ব্যাখ্যা দাতাদের ওয়াজ তো পন্ড করে দেয়া উচিত তাই না? তখনই এদের ল্যাঞ্জা (ব্লগের ভাষায়) বের হয়ে যাবে। ওয়াজ এই মডারেট প্রজন্ম তৈরি করেনি। এটা তৈরি করেছে আধুনিকতা ও ধর্মীয় নির্যাসের অসামঞ্জস্যতার মিশ্রনে। ই্ংরেজ আমলে ধুতির উপর কোট চাপিয়ে যে কেরানীবাবু তৈরি হয়েছিলো, এ-ও তেমনি একটা জিনিস।
অবিশ্বাস: ইদানিং ওয়াজ মাহফিলগুলোতে মানুষের অংশগ্রহণ একেবারেই কমে এসেছে। দেখা যায় মঞ্চের সামনে গোটা পঞ্চাশেক মানুষ বসে আছে, কিন্তু চারপাশে এক দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে রেখেছে। এভাবে মাইক ব্যবহারের কারণে মানুষজনকে মাহফিল স্থলে আসার দরকার হচ্ছে না, নাকি মানুষ আসে না দেখে মাইকের এমন ব্যবহার হচ্ছে, আপনার কী মনে হয়?
সুষুপ্ত পাঠক: দর্শক একেবারে কমে গেছে কথাটা ঠিক না। ওয়াজ এখন বারোমাসী বিজনেস। একসময় কেবল শীতকালীন ছিলো। এখন হয় কি গ্রাম গুলোতে ১৪-১৫ বছরের উপরের কোন কিশোরকেই খুব বেশি একটা দেখবেন না। হয়ত বিদেশ নয়ত ঢাকা এসেছে জীবিকার প্রয়োজনে। যে কারণে গ্রামে বুড়ো আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক জনগণের সংখ্যাই বেশি। দেশের যে পরিমাণ ধর্মান্ধতার চাষ হয়েছে তাতে ওয়াজের শ্রোতার সংখ্যা কমার কোন কারণ দেখি না। আমাদের মিডলইস্ট শ্রমজীবীদের মধ্যে ফেইসবুকে ওয়াজের পেইজগুলো ভীষণ জনপ্রিয়। এরকম পেইজ আছে শত শত। তারা দূর প্রবাসের কারণে অনলাইনে আশ্রয় নিয়েছে। দেশে থাকলে ঠিক মাহফিলে উপস্থিত থাকত। শহরে রিকশাঅলাদের একটা বড় অংশ বছরে একবার গ্রামে যায়। এদের মুখে শুনেছি বাড়ি গিয়ে এরা ফজরের ওয়াক্তে আর ঘুমাতে পারে না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে একদল মুসল্লী লাঠি হাতে টিনের দেয়ালে শব্দ করে নাম ধরে নামাজের জন্য ডাকাডাকি করে মসজিদে নিয়ে গিয়ে নামাজ পড়ায়। মুখে দাড়ি না রাখার জন্য তিরস্কার করে। মানে বুঝা যাচ্ছে গ্রামে কি রকম করে একটা ইসলামিক পরিবেশ জেঁকে বসেছে। সেই প্রেক্ষিতে ওয়াজে লোক কম থাকার কোন কারণ নেই। কোন কোন ওয়াজে সেরকম চিত্র যদিও দেখা যায়। সেটা মনে হয় নানা রকম যৌক্তিক পরিস্থিতে ঘটে থাকে। একই সঙ্গে বলা জরুরী, ওয়াজ এখন সাতদিন ব্যাপী হচ্ছে। হুজুর হেলিকপ্টার দিয়ে মাহফিলে আসছেন। ওয়াজকারীদের সবাই নিজস্ব গাড়িতে চলাফেলা করেন। মসজিদে ইমামতি করে এরকম ইনকাম সম্ভব ছিলো না। ওয়াজের বাজার ভালো থাকার কারণেই ঘটছে। তবে এই ওয়াজই তাদের বারোটা বাজাবে। অনলাইনের ওয়াজের ভিডিওগুলো আমাদের হাতে পড়ে আমাদের এঙ্গেল থেকে যখন বিশ্লেষণ করে সেগুলো শেয়ার করি মানুষ তখন ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে তা উপলব্ধি করতে পারে। আমরা যখন বলেছি নবী দুইজন দাসী ছিলো যাদের তিনি বিয়ে করেননি। লোকজন বিশ্বাস করবে কিনা দ্বিধা করেছে। কিন্তু ওয়াজের হুজুর যখন একই কথা বলছে তখন তাদের অবিশ্বাস করার কিছু নেই। আমরা সেই ভিডিও শেয়ার করে মানুষের কাছে তুলে ধরছি।
অবিশ্বাস: যারা ওয়াজ মাহফিল করেন, তাদের মাঝে কয়েকটা শ্রেণী আছে, আমরা জানি। এরমধ্যে বর্তমানে দু’টি শ্রেণীকে খুব সহজে শনাক্ত করা যায়। একপক্ষ বলে ইসলাম মানুষ হত্যার কথা বলেনি, আরেকপক্ষ বলে নাস্তিক বা মুরতাদ হত্যা করা মুসলমানদের কর্তব্য। এই দুই শ্রেণীর মাঝে এই ব্যবধানটা কি কৌশলগত পার্থক্য নাকি মতপার্থক্য? এমন পার্থক্যের কারণ কী?
সুষুপ্ত পাঠক: কৌশলগত পার্থক্য। এই কৌশলগত পার্থক্য গড়ে উঠেছে মতপার্থক্য থেকে। মানে হচ্ছে, সশস্ত্র জিহাদী দলগুলো যেমন মনে করে জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করার সময় এসে গেছে কিন্তু ভোটের মাধ্যমে যে সব ইসলামিক দলগুলো এখনো খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তারা মনে করেন এখনো সেই পরিস্থিতি আসে নাই যখন শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা বদল করে ইসলামিক হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তবে কোন পক্ষই কিন্তু বলে না ইসলামে জিহাদ নেই বা ইসলাম কায়েম করতে চেষ্টা করা যাবে না। খেয়াল করুন ‘মানুষ হত্যা’ এটা কি কেউ সমর্থন করতে পারে? দাঙ্গাবাজ যুদ্ধাবাজ- এসব কি শুনতে ভালো লাগে? না ভাল অর্থে এসব ব্যবহার হয়? জঙ্গিবাদ ইসলামে আছে- এটা কি ওহাবীরাও স্বীকার করে? কেন করবে কারণ ইসলাম কখনই মনে করে না সে সন্ত্রাস করছে! ইসলাম আল্লার শাসনতন্ত্র দুনিয়ার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে জিহাদ করতে বলে, এটা করতে গিয়ে যে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাধা দিবে সেই হাতকে ভেঙ্গে দিতে হবে যদি শক্তি থাকে। এটাকে বলে আল্লার রাস্তায় জিহাদ করা। এটাকে আপনি বলছেন জঙ্গিবাদ, বলছেন মানুষ হত্যা, তারা কেন এই দাবী মেনে নিবে? জাকির নায়েকের পিস টিভিতে সব বক্তাই ইসলামে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলত। খুনোখুনি ঝগড়া ফ্যাসাদ ইসলাম কতটা খারাপ চোখে দেখে সেটা বলত। কিন্তু এসব দুনিয়াবী ব্যাপারের সঙ্গে তারা তো জিহাদ কতলকে এক করে দেখে না। কিন্তু নবীর কটুক্তিকারীকে হত্যা করা ওয়াজিব- এই বিষয়টি নিয়ে ছোট্ট একটা গ্রুপ- যেমন ধরেন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ তাকিয়াবাজী করেন। তিনি আবদুল্লাহ বিন সা’দ মুরতাদ হয়ে যাবার পরও মক্কা বিজয়ের দিন তাকে মুহম্মদ সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন দেখিয়ে দাবী করেন মুরতাদ হত্যা যদি বিধান থাকত তাহলে নবী সা’দকে কেন ক্ষমা করলেন। মাসুদ সাহেবের কথাতে দুর্বলতা আছে। সা’দ মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলো বলেই মুহম্মদ তাকে ‘ক্ষমা’ করেছিলেন মানে সে অপরাধ করেছিলো। বুঝা যাচ্ছে ধর্মত্যাগ করা ছিলো তার জন্য একটা অপরাধ। আমরা জানি সা’দের জন্য প্রাণ ভিক্ষা করেছিলো তারই দুধভাই হযরত ওসমান। তার অনুরোধে মুহম্মদ শেষ পর্যন্ত তার প্রাণ ভিক্ষা দেয় নতুবা সা’দের নাম হত্যা তালিকার শীর্ষে ছিলো। মাসুদ সাহেবরা এটা করেন ইসলাম সম্পর্কে যাতে মানুষ খারাপ ধারণা না করে। উনারা মনে করেন ইসলামের খিলাফতের রাজনীতির ছিলছিলা সাধারণ মানুষ তাদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করতে পারবে না। নানা রকম প্রবোধ দিয়ে ইসলামের সব রকম অন্ধকারকে তারা ঢেকে রাখেন। এই কাজটা বা কৌশলটা বেশ জনপ্রিয়। ইসলামের স্বার্থে এরকমটা করা জায়েজ। পাশ্চত্যের বেশ কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে পরে ছেড়ে দিয়েছিলো। ইসলাম সম্পর্কে হুজুরদের থেকে যে কথা শুনে পরে তারা ইসলাম গ্রহণ করে ইসলাম স্টাডি করতে গিয়ে দেখে তা সম্পূর্ণ বিপরীত! তারা ইসলাম ত্যাগ করে বলেছিলো তাদের ভুল বুঝানো হয়েছিলো।
অবিশ্বাস: ব্লগার রাজীব হত্যার রায়ে মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানিকে হত্যার সাথে জড়িত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়নি। যদিও হত্যাকারীরা বলেছে তারা রাহমানির বক্তব্য থেকেই হত্যায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আদালত বলেছে তদন্তকারী দল যেসব প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, তাতে রাহমানির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ‘উদ্বুদ্ধকারী’ ‘প্ররোচনাকারী’দের অপরাধী হিসেবে দেখছে না। প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার আহবানকারীদেরও অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করছে না। এর কারণ কী?
সুষুপ্ত পাঠক: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আদালত কি ভারতের আদালতের মত রায় দিতে সক্ষম? আদালত দেশকাল দেশের মানুষকে একেবারে মাথায় না রেখে রায় দিতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। সমকামিদের পক্ষে ভারতীয় আদালত রায় দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সেখানে বাস করে। হিন্দু ধর্মও সমকামিদের বিরুদ্ধে নানা রকম শাস্তির বিধান দিয়ে রেখেছে। তবু এরকম রায় ভারতীয় আদালত দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। সমকামি বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আদালত কি সমকামিদের পক্ষে রায় দিতে পারবে? বা এই বিষয় আদালত কি কার্যতালিকায় রাখবে নাকি ফেলে দিবে? বাংলাদেশের আদালত হুজুরদের ফতোয়া দেয়াকে বৈধ বলেছেন। একটা দেশে আইন আদালত থাকার পরও হুজুররা মুসলমানদের সামাজিক জীবনের উপর ফতোয়া কিভাবে দিবে? তাহলে হুজুরের ফতোয়া আর রাষ্ট্রীয় আইন সংঘর্ষিক হয়ে গেলো না? ভারতীয় আদালত কিন্তু সেখানকার মুসলিম নারীদের তিন তালাকের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে যা সরাসরি ইসলামী শরীয়া আইনের বিরুদ্ধে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে আদালত আসলে দেশকাল দেখেই রায় দেয়। জসিমউদ্দিন রাহমানি বক্তব্য থেকে যদি গুলশান ম্যাসাকারে অংশ নেয়া তরুণরা উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে কান টানলে মাথা আসার মত সামনে চলে আসবে জসিমউদ্দিন রাহমানি কার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন? তখন দেখা যাবে তিনি কুরআন হাদিস দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তারপর কী করবেন? জসিমউদ্দিন রাহমানিকে সাজা দিলে বাকী থাকল তার ধর্ম বিশ্বাস যা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। দেখেন আদালতে এই বিষয়গুলি কিন্তু আসবেই যে জসিমউদ্দিন রাহমানিকে দোষী করা হয়েছে উশকানির জন্য। তখন প্রশ্ন উঠবে এই লোক কাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন? তদন্তকারী দল ঠিকই দেখেছে এই মুফতি সাহেব ইসলাম সম্পর্কে একজন বড় পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে তার কথার পক্ষে সহি ইসলামিক রেফারেন্স দেয়া আছে। তারা জানেন তাকে দায়ী করে বা তার সংম্পৃক্ত করে চার্জশীট দিলে আদালতে তাকে প্রশ্ন করা হবে তিনি কীসের ভিত্তিতে এ ধরণের কথা বলেছেন বা লিখেছেন। বেশ জটিল ব্যাপার।
অবিশ্বাস: বর্তমানে ওয়াজগুলোতে একটা প্রতিপক্ষ ধরে পরিকল্পিত ভাবে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। আওয়ামীলীগ এই পরিকল্পিত বিদ্বেষের পুরোনো শিকার। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ওয়াজের মঞ্চে দেখা যায়, এমনকি শামীম ওসমান, কামরুলরা মাহফিলে ওয়াজ করে। লীগ নেতাদের এমন আচরণ কৌশলগত, নাকি এরা সত্যিই ধর্মান্ধ হয়ে গেছে?
সুষুপ্ত পাঠক: ৯১ সালে নির্বাচনে হারার পর আওয়ামী লীগ থেকে রব উঠেছিলো ধর্মনিরপেক্ষতাকে আওয়ামী লীগের শত্রুরা সেটাকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে প্রচার করে। পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আগে থেকেই উপমহাদেশের ওলামারা ক্ষিপ্ত ছিলো। তারা শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিনকে কাফের মনে করত। সৌদির একজন প্রতিনিধি যখন ৭৪-৭৫ সালে ঢাকায় এলো তিনি বাইতুল মোকাররম পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেন এত মানুষ এখানে নামাজ পড়ছে! সঙ্গে ছিলেন ডক্টর কামাল হোসেন, তাকে সেই সৌদি প্রতিনিধি বলেছেন, এত মানুষ নামাজ পড়ছে এখানে, শুনেছিলাম আপনারা মুসলমানদের নামাজ পড়তে দেন না…। এটা কামাল হোসেন এটিএন নিউজে নিজের মুখে বলেছিলেন। এরপর ৯১ সালের নির্বাচনে হারার পর কাগজে এসেছিলো, আওয়ামী লীগ নেতাদের বলা হয়েছে নিজ নিজ এলাকার মসজিদে সাপ্তাহে একদিন শুক্রবার নিয়মিত নামাজ পড়তে যাবে। নেতাদের মাথায় টুপি ধর্মকর্ম করার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছিলো। আবদুস সামাদ আজাদ তারপর থেকে সব সময় মাথায় টুপি পড়ে থাকতেন। ঘটা করে তখন শেখ হাসিনার নামাজ পড়ার পোস্টার বের হলো। কারণ এর আগে বিএনপি এডিটিং করে শেখ হাসির হাতে শাখা ও মাথায় সিদুর পরিয়ে ভারতের একটা মন্দিরে ঘন্টা বাজাচ্ছে পোস্টার বানিয়েছিলো। সেই পোস্টার আমি দেখেছি। আমাকে দেখিয়েছিলো এলাকার বিএনপি করে যারা তারাই। হাসিনা যে হিন্দু সেটাই তারা প্রমাণ দেখাচ্ছিল আমাকে…। এটা আসলে খুব ট্র্যাজেডি আওয়ামী লীগের জন্য। আওয়ামী লীগ আসলে কখনই ধর্মহীন পার্টি ছিলো না। সাত মার্চের ভাষণ তারা শুরু করেছিলো কুরআন তেলাওয়াত করে। দেশ স্বাধীন হবার পর তারাই প্রথম দেশকে ইসলামিকরণে অনেকগুলো প্রজেক্ট হাতে নেয়। এখন শুনছি তারা রেডিও টেলিভিশনে আজান প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলো। যাই হোক, তবু আওয়ামী লীগ হিন্দুদের দল এই ‘অপবাদ’ থেকে বাঁচতেই লীগকে ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করতে হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে নেতারা যে উপমহাদেশের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বুড়োকালে ধর্মীয় গোড়ামীতে আক্রান্ত হন নাই তা হলপ করে বলা যাবে না। যেমন ধরেন একটা বাচ্চার নাম রাখতে গিয়ে একজন রাখল ‘রামাদান’। এখান থেকেই তার বর্তমান রুচি ও ধর্মীয় পরিচয়টা আমরা পেয়ে যাই। সেই ব্যক্তি যদি রাজনীতিবিদ হন তাহলে তার ব্যক্তি রুচিটা অবশ্যই রাজনীতিতে আপনা আপনি চলে আসবে। সেটা যে এখন ঘটছে না তা নয়। তার মানে আমি মনে করি দুটো কারণই এখানে ঘটছে। তবে নিজেদের সেক্যুলার হিন্দুদের দল এই তকমা থেকে বেরিয়ে আসতেই রাজনীতিটা বেশি করছে বলেই মনে হয়।