‘তুই খ্রিস্টান কলেজে পড়েছিস, তুই খ্রিস্টান। তোর জন্য তোর পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হলো’। সীমানা বিরোধের জের ধরে দুই পরিবারের বিরোধ মীমাংসায় উপস্থিত হয়ে এই ঘোষণা দেন তরফপুর পাথালিয়া মসজিদের খণ্ডকালীন মোয়াজ্জিন মাসুদ মিয়া।

তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই কথা বলেন ওই মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম মাষ্টার।

গত ১ মে এ ঘটনার পর চার মাস ধরে ওই গ্রামের নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া জুয়েল খানের পরিবারকে সমাজ চ্যুত করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় ওই পরিবারের কেউ সমাজের অন্য কোনো লোকের সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করলে তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙে এলাকা ছাড়া করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া গত ঈদুল আজহায় ওই পরিবারটিকে সামাজিকভাবে পশু কোরবানি অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।

অমানবিক এ ঘটনাটি ঘটেছে মির্জাপুর উপজেলার তারফপুর পাথালিয়াপাড়া গ্রামে। এ ঘটনায় ওই গ্রামের শরিফুল ইসলাম, আবদুল বাছেদ মিয়া, রমজান আলী, আবদুল লতিফ, তারিকুল ইসলাম ও লিটু আনামসহ ১৯ জনকে আসামি করে ২৩ আগস্ট টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মির্জাপুর আমলি আদালতে মামলা করেন নটর ডেম কলেজের সাবেক ছাত্র জুয়েল খান।

জুয়েল তরফপুর পাথালিয়াপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে। তিনি নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। গত বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স পাস করে ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

শনিবার দুপুরে তরফপুর পাথালিয়া পাড়া গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে একাধিক লোকজনের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে।

মামলার অভিযোগ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশী আবদুর রশিদ খানের ছেলে শরিফুল ইসলামের সঙ্গে বাড়ির সীমানা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জুয়েলের পরিবারের বিরোধ চলে আসছে। পূর্ববিরোধের জের ধরে গত পয়লা মে বিকেল চার দিকে আসামিরা লাঠি, লোহার রড নিয়ে জুয়েলদের বাড়িতে প্রবেশ করে পরিবারের সদস্যদের মারপিট করতে থাকে। এ সময় মামলার আসামি একই গ্রামের শামসুল হকের ছেলে মাসুদ বাদীকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘তুই খ্রিষ্টান কলেজে (নটর ডেম কলেজে) এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় লেখাপড়া করেছিস তুই নাস্তিক। নাস্তিকের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তোর জন্য আজ থেকে তোর পরিবারকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন (এক ঘরে) থাকবে’।

মামলা সূত্রে জানা যায়, এ সময় জুয়েল ও তার ভাই মারুফ খান এ কথার প্রতিবাদ করলে আসামিরা তাদের হত্যার উদ্দেশ্যে আরও মারপিট করতে থাকে। তাদের এলোপাতাড়ি মারপিটে জুয়েলের বৃদ্ধ বাবা মফিজুল ইসলাম, মা আমেনা বেগম, নানি ইয়ারন বেগম ভাই মারুফ খান এবং এক বছর আট মাস বয়সী ভাতিজা মাহির আহত হন। বিবাদীর লাঠির আঘাতে জুয়েলের বৃদ্ধা নানি ইয়ারন বেগমের ডান হাতের হাড় জখম হয়।

এ সময় তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে উপজেলার জামুর্কী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। ঘটনার পর থেকে ওই পরিবারটিকে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। এ ঘটনার পরও তাদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে বলে জুয়েলের মা আমেনা বেগম জানান।

শনিবার দুপুরে তরফপুর পাথালিয়া গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা গেছে।

জুয়েলের বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, চার মাস ধরে আমরা বাড়ির বাইরে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি না। নিজেদের জরুরি দরকারেও বাইরে যেতে ভয় করে।

জুয়েল খানের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার নেতৃত্বদানকারী পাথালিয়া পাড়া মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সমাজ চ্যুত করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। জুয়েলের পরিবার সমাজের কারো সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারে না।

ওই গ্রামের বাসিন্দা স্বাস্থ্যকর্মী মাহামুদুল হাসান বলেন, জুয়েলের পরিবার সমাজের কাউকে মানে না। তা ছাড়া মসজিদ সম্পর্কে কটাক্ষ করে। তাই সমাজের মুরুব্বিরা তাদের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তরফপুর গ্রামের বাসিন্দা তরফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আব্দুল বাছেদ মিয়া বলেন, জুয়েলদের পারিবারিক বিরোধের সালিস করতে গিয়ে আমরা মামলার আসামি হয়েছি।

মির্জাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সায়েদুর রহমান বলেন, বিষয়টি খুবই অমানবিক। জুয়েল খান নটর ডেম কলেজে পড়ার কারণে তরফপুর পাথালিয়া গ্রামের কতিপয় গ্রাম্য মাতব্বর তাকে খ্রিষ্টান উপাধি দিয়ে তার পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়।

দেশ রূপান্তর

মন্তব্য করুন