বাগেরহাটের সংখ্যালঘু গ্রাম গুলোতে এখন বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। নির্যাতন হুমকি-ধমকির পাশাপাশি এই চাঁদাবাজি সংখ্যালঘুদের ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। সন্ত্রাসীরা লুটপাট ও ধর্ষণের পর এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা চাইতে এসে তারা সংখ্যালঘুদের শাসিয়ে যাচ্ছে⎯এ দেশে থাকতে হলে এই পাঁচ বছর তাদেরকে ট্যাক্স দিয়েই থাকতে হবে। গত ছয় দিন ধরে বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে দেদারছে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় সরবে গিয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। গরিব হিন্দু পরিবারগুলোর কাছে পরিবার প্রতি এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। আর একটু অবস্থাসম্পন্ন পরিবার গুলোর ক্ষেত্রে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা ধার্য করা হচ্ছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ বা তারও বেশি টাকা ধার্য করা হচ্ছে এবং এই চাঁদা প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হচ্ছে। চাঁদা না দিলে মারধর, মেয়েদের লাঞ্ছিত করা , গরু-ছাগল নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সংখ্যালঘুরা যে যেভাবে পারছে চাঁদা দিয়ে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকে চাঁদার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ি বাড়ি চাঁদাবাজির পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের দোকানে দোকানে গিয়েও চাঁদবাজরা হানা দিচ্ছে। চাঁদা না দিলে দোকানপাট ভাংচুর করছে। চাঁদা এবং হামলার ভয়ে এই জেলার বাজার গুলোতে অবস্থিত হিন্দুদের মালিকানাধীন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দোকান নির্বাচনের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। এদিকে এই এলাকার চাঁদাবাজির কোন অভিযোগ পুলিশের কাছে যাচ্ছে না। কোন সংখ্যালঘু পরিবারই জনকন্ঠের সাথে আলাপকালে এসব অভিযোগ নিয়ে থানায় যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলে জানিয়েছে। থানা-পুলিশ করে তাদের বিপদের মাত্রা আরও বাড়াতে চায়না। কারণ পুলিশ চলে গেলে তাদের ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে যাবে। চিতলমারী উপজেলার সীমান্ত সংলগ্ন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলো চাঁদাবাজির সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার। যারা হামলা করছে তারাই চাঁদাবাজি করছে। বাঁশবাড়িয়া, ট্যাংরাখালি, লড়ারকুল, কচুরিয়া, আন্ধারমানিক, সন্তোষপুর, নাছিরপুর, বানিয়ারি, খড়মখানা, ব্রাহ্মগাতি, দুর্গাপুর, শ্যামপাড়া প্রভৃতি গ্রামের একাধিক ব্যক্তিকে ইতোমধ্যেই চাঁদাবাজির চাহিদা পূরণ করতে হয়েছে। কাকে, কখন, কোন সময়ে দিতে হবে সেই ঘোষণা দিয়ে এলান জারি করা হয়েছে। বাঁশবাড়িয়ার নেপাল কীর্ত্তনিয়া চাঁদার টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর নিকট থেকে ১৮শ’ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। সন্তোষপুরের ডা. জগদীশ হালদারের নিকট একটি বড় অংকের চাঁদা দাবি করা হয়েছে। ডুমুরিয়ার হরেন, অসীমানন্দ, অর্ণব বিশ্বাসকে একটি বড় অংকের টাকা শোধ করতে বলা হয়েছে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ধার্যকৃত অর্থ পরিশোধ না হলে ভয়াবহ পরিণতি হবে বলে তাদের শাসানো হয়েছে। চিতলমারী বাজারের হিন্দুদের দোকানে দোকানে চাঁদা চাওয়া হয়েছে। মোল্লাহাট উপজেলার সংখ্যালঘুদের ওপর সমানতালে চাঁদাবাজি চলছে। নাম প্রকাশ না করে জনৈক ভুক্তভোগী জনকন্ঠকে চিঠিতে জানিয়েছেন, অস্ত্র উচিয়ে ভয় দেখিয়ে চাঁদার অর্থ হাতিয়ে নেয়ার এই প্রক্রিয়াটি ঘটছে চুপিসারে। আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকা মানুষেরা প্রতিরোধ তো দূরের কথা, প্রতিবেশীদের সামনেও মুখ খুলছে না । কোনভাবে জানাজানি হলেও তারা ঘটনাটি পুরোপুরি অস্বীকার করছে। মোল্লাহাট সদরের পূর্বপাশের হিন্দু অধ্যুষিত গিরিশনগর গ্রামটি এই নীরব চাঁদাবাজির শিকার। ছোট্ট এক মুদি দোকানিকেও চাঁদার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এখানকার এক মহিলা ইউপি সদস্য ও চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন। রামপাল উপজেলায় গ্রামের পর গ্রামেও চলছে সরব ও নীরব চাঁদাবাজি। এখানকার নলবুনিয়া গ্রামের শুধুমাত্র ভিটে পাহারাদানকারী বয়স্কদের কাছে জানা যায় দুঃসহ চাঁদাবাজির ঘটনা। আকুল মাঝির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চাওয়া হয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। আকুল মাঝির ভাই নিখিল ও মনোরঞ্জন মাঝির কাছেও যথাক্রমে ২৫ ও ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এখানকার জিতেন, সন্তোষ মণ্ডল , জুড়োন মণ্ডল, সুধীর মণ্ডল, স্বপন মণ্ডল, মনোরঞ্জন হালদার প্রমুখের কাছে ৫ হাজার টাকা করে চাওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলের চাঁদাবাজির নায়ক নজরুল মোড়ল। তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতা রাজ্জাক হালদারের দক্ষিণ হস্ত হিসাবে বিশেষ পরিচিত। ৫০/৬০ জনের একটি দল নিয়ে এই ব্যক্তি গ্রামের পর গ্রামে হামলা, ভাংচুর,লুটতরাজ, চাঁদবাজি করছে। গত রবিবার রামপাল থানা পুলিশ এই অত্যাচারী নজরুল মোড়লকে গ্রেফতার করে। তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য স্থানীয় বিএনপি নেতা তদ্বিরও করেছেন। বিএনপির ছত্রছায়ায় লালিত হাবিব সর্দার, আখতার প্রমুখরাজনগর, বুড়িরডাঙ্গা, উজলকুর প্রভৃতি ইউনিয়নের সংখ্যালঘুদের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই উপজেলার অবরুদ্ধ গ্রাম শো গুনায় চলছে একই ধরনের ভীতিকর অবস্থা। এখানকার প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। পরিবারের আর্র্থিক সামর্থের ওপর চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। দরিদ্র পরিবারে ৫০ টাকাও চাওয়া হয়েছে। বিত্তশালীদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে। বাইনতলা ইউনিয়নের বারুইপাড়া, রামনগর, আঙ্গরিয়া, শো গুনা, দুর্গাপুর, গিলাতলা সুন্দরপুর, কুমলাই প্রভৃতি গ্রামের অধিকাংশ সংখ্যালঘু পরিবারে চাঁদা ধরা হয়েছে। বৈরাগীর এলাকায় তাপসের কাছে ২০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। নির্মল রায় ও তপন মণ্ডলের কাছেও চাঁদা দাবি করা হয়েছে। মিঠেখালি ইউনিয়নের চৌধুরীডাঙ্গা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছে ২০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। তিনি ৫ হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলেছেন। বিএনপি নেতা রাজ্জাক হালদারের অনুগতরা এই চাঁদাবাজি করে চলেছে। উলুবুনিয়ায় এই বাহিনীর সদস্যরা ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না পেয়ে তারা তিনটি ঘের দখল করে নিয়েছে। জয়খাঁ গ্রামের ইউপি সদস্য প্রবীণতম ব্যক্তি জিতেন বৈরাগীর কাছে এক লাখ টাকা দাবী করা হয়েছে। এখানকার প্রবোধ মৃধার কাছে চাওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। উলুবুনিয়ার ইলিয়াস মেম্বারের কাছে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। মিঠেখালি ইউনিয়নের খাসেরডাঙ্গা, সাতপুকুরিয়া, ধনখালি, খরখড়িয়া প্রভৃতি হিন্দু অধু ̈ষিত গ্রামগুলোয় চলছে চাঁদাবাজির তাণ্ডব। গোপেরহাটের একমাত্র তেলের দোকানদার সমর হাওলাদার চাঁদাবাজদের চাহিদা পূরণ না করায় বেদম পিটুনি খেয়েছেন। তার কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকাও ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে । খড়খড়িয়া গ্রামের এক সংখ্যালঘুর বাড়িতে বসে দুর্বৃত্তরা সভা করেছে। সেই সভার সিদ্ধান্ত মতে, ৮ জন সংখ্যালঘু চিংড়ি ঘের মালিকের কাছে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে। চাঁদাবাজরা চাঁদা না পেয়ে বাড়ির সম্পদ লুট করে নিচ্ছে। বিশেষ করে মোল্লাহাট এলাকার সংখ্যালঘুদের বাড়ি থেকে গরু নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ক্ষেতের ফসল কেটে নষ্ট করা হয়েছে। এমনকি বাড়ি থেকে গাছপালাও কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে মারুফ নামে এক বিএনপি নেতা পার্টির নামে এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করেছে।
দৈনিক জনকন্ঠ, ১৬ অক্টোবর ২০০১