মুক্তচিন্তা আন্দোলনস্বতন্ত্র ব‍্যক্তিত্বআহমদ শরীফ | যিনি বাংলাদেশের নাম রেখেছেন

আহমদ শরীফ | যিনি বাংলাদেশের নাম রেখেছেন

আহমদ শরীফ | যিনি বাংলাদেশের নাম রেখেছেন

ঊনিশ শতকের কলকাতায় রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সমাজ সংস্কার এবং ডিরোজিওর নেতৃত্বে নতুন চিন্তা নির্মাণের আন্দোলন একইসাথে ঘটেছে। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের হাত ধরে কিঞ্চিৎ উদারপন্থী সংস্কার কাজ শুরু হয়। কিন্তু তখন নতুন চিন্তা নির্মাণের জন্য কোন ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী ছিলো না। ফলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতা আবুল হুসেনের মৃত্যুর পর বাকি সংগঠকরা সংস্কার কাজ বাদ দিয়ে আবার ধর্মঘরে ফিরে যায়। একটু আধটু তৎপরতা থাকলেও তাদের সাম্প্রদায়িক ভূমিকার কাছে তা ম্লান হয়ে যায়। শেষের দিকে মুসলিম সাহিত্য সমাজের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আবুল ফজলরা মূলত মূর্খ মৌলবীদের হাত থেকে ইসলামের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। এটাকে সংস্কার না বলে কর্তৃত্বের লড়াই বলা বেশি যুক্তিসঙ্গত। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার একমাত্র কারণ তখন সবকিছু ভেঙে সম্পূর্ণ অদেখা অজানা অভিনব কিছু করার মত মানুষের অভাব ছিলো। কলকাতায় ইয়ং বেঙ্গল যেমন একই সাথে ব্রাহ্ম সমাজ ও মূল হিন্দু সমাজ -উভয় সমাজ ধরে টান দিতো, ধর্মকে বাতিল করে দিয়ে মানবতার কথা বলতো, বিশ শতকের ঢাকায় তেমন কেউ ছিলো না।

এমন একজন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য ঢাকাবাসীকে আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একসময় শেষ হয় অপেক্ষার প্রহর গোণা। কিন্তু তখন মুসলিম সাহিত্য সমাজের মত কিঞ্চিৎ উদারবাদী অথবা আধা উদারবাদী কোন তৎপরতা ছিলো না। তা না থাকার কারণে যাদেরকে উদ্দেশ্য করে সংস্কার বা নতুনত্বের আহবান, তারা পড়েছিলেন বিপদে। ঠিকমত হজম হয়নি বা সামান্যও মানিয়ে নিতে পারেনি। নতুন এবং পুরোনোর সাঝে সরাসরি সংঘাত সৃষ্টি হয়। যোগাযোগের জন্য মাঝখানে আরেকটি পক্ষ ছিলো না। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, কিন্তু লাভ ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। কারণ যিনি নতুন চিন্তার বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি একাই একটি সংগঠন, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আন্দোলন, একটি অধ্যায়।

তিনি আহমদ শরীফ। হঠাৎ এলেন। কোন পূর্বাভাস ছাড়া। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কেন, আধা বাঙালি-আধা মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজও এর জন্য প্রস্তুত ছিলো না। আহমদ শরীফ তাদেরকে প্রস্তুতি নেয়ার সময়ও দিলেন না। সাহস ও চিন্তার উপর্যুপরি আঘাতে লন্ডভন্ড করে দিতে থাকেন অজ্ঞতা ও মূর্খতার অন্ধকার প্রাচীর। তার তান্ডব শুরু হওয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একবারের জন্যও থেমে থাকেনি। এই দীর্ঘ যাত্রায় তিনি সবকিছু আমূল বদলে দেন। কথার নতুন ভাষা, চিন্তার নতুন গতিরেখা, আন্দোলনের নতুন ইশতেহার, লড়াইয়ের নতুন হাতিয়ার নির্মাণ করেন। নির্মাণ করেন আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক আলোকজ্জ্বল রূপকল্প।

একটি শব্দ ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে তাঁর সম্পর্কে ব্যবহার করেন পরিচিত ও অন্তরঙ্গরা। শব্দটি ছোট কিন্তু তার অর্থ-আয়তন অভিধানের বড় বড় শব্দের থেকে অনেক ব্যাপক। শব্দটি ‘অনন্য’। তাঁরা বলেন, ডক্টর আহমদ শরীফ অনন্য। এমন আর নেই, আর পাওয়া যাবে না পলিমাটির এই ছোট ব-দ্বীপে। দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তাঁর।
—হুমায়ুন আজাদ

অন্য সবার মূল্যায়ন ছাপিয়ে উপরের মূল্যায়নটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ হুমায়ুন আজাদ তার জীবদ্দশায় কখনো কাউকে এমন নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধামাখানো ব্যাখ্যা করেননি। একমাত্র আহমদ শরীফের বেলায় এসে হুমায়ুন আজাদকেও সংযত হতে হয়েছে। না তিনি ভয়ে কিংবা অন্য কোনো জড়তা বা দ্বিধা থেকে সংযত হননি। সংযত হয়েছেন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়।

শুধু হুমায়ুন আজাদ নন, বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত আহমদ শরীফের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি জড়িয়ে আছেন এই দেশের জন্মের সাথে, ইতিহাসের সাথে, ভাষার সাথে, সাহিত্যের সাথে। জড়িয়ে আছেন আন্দোলন, সাহস, সুন্দর ও শুদ্ধতার সাথে। তিনি ছিলেন অসামান্য, অকপট, অভ্রান্ত। কথা, কাজ ও জীবনকে এক রেখে যাপন করা এত সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটি তিনি করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। তার নীতি, আদর্শ ও চারিত্রিক দৃঢ়তার সামনে ঘোরতর শত্রুও সম্মতি ও স্বীকারের ইশারা নিয়ে হাজির হতো।


জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্রতীরবর্তী পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে আহমদ শরীফের জন্ম। তার বাবা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের কেরানি। মা সিরাজ খাতুন ছিলেন গৃহিনী। আবদুল আজিজ ও সিরাজ খাতুনের পাঁচ সন্তান। তিন ছেলে, দুই মেয়ে। আহমদ শরীফ ছিলেন চতুর্থ। ১৯৪৬ সালে পিতা আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর তিনি ফুফু ও ফুফার সাথে বসবাস শুরু করেন। তখন তার বয়স পঁচিশ বছর। আহমদ শরীফের ফুফুর নাম বদিউন্নিসা এবং ফুফা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন পুরোনো বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত লাইব্রেরি। ফুফার সান্নিধ্যে এসে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে নতুন করে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। এই যোগাযোগের মাঝেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন তিনি।


 

আহমদ শরীফ প্রতিভা সম্মান করতেন, প্রতিভার যত্ন নিতেন, প্রতিভা ভালোবাসতেন। কিন্তু প্রতিভার বিনয়কে প্রত্যাখ্যান করতেন, গ্রহণ করতেন ঔদ্ধত্যকে। তিনি মনে করতেন বিনয়ী প্রতিভা সর্বদা প্রচলিত সময় ও প্রথার সাথে মানিয়ে চলে, আত্মসমর্পন করে। প্রতিভার বিনয় দিয়ে কোন নতুন সৃষ্টি হয় না, নির্মাণ হয় না। সৃষ্টি ও নির্মাণহীন প্রতিভা সমাজ ও মানুষের কোন কাজে আসে না।

আসলেই ঔদ্ধত্য ছাড়া সৃষ্টি হয় না, মঙ্গল হয় না। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আহমদ শরীফ নিজে। তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য, বর্ণনাতীত সৃষ্টি, ধারনের বাইরে অর্জন। তিনি তার প্রথম সৃষ্টি দিয়েই ইতিহাসে জায়গা করে নেন। আহমদ শরীফ সম্পাদিত দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত ‘লায়লী মজনু’ ছিলো বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম বই। বাকি জীবনে এমন অনেক ‘প্রথম’ এর সাথে তার নাম উচ্চারিত হয়েছে। তিনি জড়িয়ে আছেন আমাদের গৌরবে, আমাদের অতীতে এবং ভবিষ্যতে, যা বর্তমানে আমরা গড়ে তুলছি।

আহমেদ শরীফ জড়িয়ে আছেন ‘বাংলাদেশ’ নামের সাথে। ১৯৬২ সালে যখন সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়, আহমদ শরীফ তখন এর সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। পরে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমারের উদ্যোগে গঠিত অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার (অপূর্ব সংসদ) এর সাথে। তিনি এই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন সভাপতি, বাগমার ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এই গোপন সংগঠনের ইশতেহার লিখেন আহমদ শরীফ।

১৯৬৫ সালে অপূর্ব সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত, আহমদ শরীফ রচিত ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’ প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ প্রস্তাব করা হয়। এর আগে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামের প্রস্তাব করার তথ্য পাওয়া যায় না। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে অপূর্ব সংসদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। তখন বুদ্ধিজীবী ও সৃজনশীল মানুষদের সম্মানজনক মূল্যায়ন ছিলো, এখনকার মত অন্ধকার ছিলো না অতীতের সেই দিনগুলো। আহমদ শরীফ ‘বাংলাদেশ’ নাম প্রস্তাব করার পর শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক ভাবে ঘোষণা দেন ‘আজ থেকে এই প্রদেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।

অপূর্ব সংসদ ও আহমদ শরীফ জড়িয়ে আছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সাথেও। ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’ প্রবন্ধের শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতার প্রথম চার লাইন জুড়ে দেয়া হয়। এই গানটিকে তারা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মূল্যায়ন করতো। পরবর্তীতে মুজিব নগর সরকারও ‘আমার সোনার বাংলা’ কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর কী কারণে যেন ‘অপূর্ব সংসদ’ এর নাম হারিয়ে যেতে থাকে। অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেলেও অপূর্ব সংসদের কথা সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ বর্তমানে প্রজন্মের সাথে অপূর্ব সংসদ এর মত সংগঠনগুলোর কোন সম্পর্ক রচিত হয়নি।

বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশে জন্য আহমদ শরীফের হৃদয় ছিলো সুবিশাল আকাশের চেয়েও বিশাল। দেশ, দেশের মানুষকে তিনি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলা ভাষা বিশারদ ছিলেন। কিন্তু ‘বাংলা’ কেবল তার জীবিকা নির্বাহের উপলক্ষ ছিলো না। ছিলো মন ও মননের সর্বাঙ্গ জুড়ে। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি যেকোন হুমকি নিজ হাতে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসতেন। ১৯৬১ সালে আইয়ুব খান যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করেছিলো, যারা সোচ্চার কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেন আহমদ শরীফ তাদের একজন।

আটষট্টিতে দেশ শাসনে আইয়ুব খানের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে উন্নয়ন দশক উদযাপনের প্রতিবাদে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অনুষ্ঠানে আইয়ুব খান শাসনের সমালোচনা করে প্রবন্ধ পাঠ করেন। ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে একজন শিক্ষক হিসেবে, বুদ্ধিজীবী হিসেবে বসে থাকেননি। লেখক শিল্পীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আয়োজিত প্রতিবাদ সভার অন্যতম আয়োজক ও বক্তা ছিলেন। সেবছর ২৪ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে ছাত্রলীগের সভায় পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করার দাবি জানান।


শিক্ষাজীবন
১৯৩৮ সালে পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ পাশ করেন। ১৯৪২ সালে একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএ পাশ করেন। সেবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এমএ পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ। অভিসন্দর্ভের বিষয় – সৈয়দ সুলতান, তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ।


 

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠিত হলে আহমদ শরীফ এর সভাপতির দায়িত্ব নেন। এর তিনদিন পর ৫ মার্চ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের শপথবাক্য পাঠ করান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশ ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম নিশানা ছিলেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী তাকে খুঁজে পায়নি। তিনি পাকচক্ষুর অন্তরালে থেকে মুক্তির সংগ্রামে নিজের সাধ্যমত ভূমিকা রাখেন।

বিজয় ধরা দেয়ার খানিক পূর্বে বুদ্ধিজীবীদের উপর চলা নির্মম হত্যাযজ্ঞে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়ে। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশাকে হারিয়ে বাংলা বিভাগের বিরানভূমিতে আহমদ শরীফ ছিলেন একা। সবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। শুধু বাংলা বিভাগ নয়, তিনি যেন বাংলাদেশের সকল বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব একা পালন করার পণ করলেন। ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীন দেশের মন ও মননশীলতা বিনির্মাণে তিনি অকাতরে কাজ করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৪ ডিসেম্বর না থাকলে হয়তো চিন্তা চেতনায় আমরা অনেক বেশি ভালো থাকতাম, তবুও যতটুকু ভালো আছি তার মূলে রয়েছেন আহমদ শরীফ।

তিনি রাজনৈতিক আদর্শে ছিলেন স্বচ্ছ, নীতিতে স্পষ্ট আর বক্তব্যে অকপট। এসবে কখনো নত হননি, নুইয়ে পড়েননি। শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ সময়ে সবাই দলে দলে বাকশালে যোগ দিয়েছেন। এমনকি শেখ সাহেবের প্রত্যক্ষ শত্রুরাও। পরবর্তীতে তার হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন, এমন লোকজনও বাকশালে দস্তখত করেছে। কিন্তু আহমদ শরীফ করেননি। অনেক অনুরোধ ও চাপ থাকার পরও করেননি। কারণ তিনি মনে করেছিলেন বাকশাল জাতির জন্য সঠিক পথ নয়। তিনি এটা মনে করেছেন, এবং স্থির থেকেছেন। কোন ষড়যন্ত্রে ছিলেন না, তোষামোদিতে ছিলেন না, ছিলেন না আপোষকামিতায়।

শেখ মুজিবর রহমানকে সহপরিবারে হত্যার পর খুনীদের তৈরি সরকারের সাথে অনেক লেখক বুদ্ধিজীবী সম্পর্ক স্থাপন করে। শুধুমাত্র শেখ সাহেবের সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে কেউ কেউ পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছেন। এসব নামের মাঝে আহমদ শরীফ নামটির ছায়াও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুজিবের বাকশাল পছন্দ করেননি, তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু সেজন্য তার শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে মজা নিতে হবে, এমন নিকৃষ্ট চিন্তার কথা কল্পনাও করতে পারেননি। বরং তার জীবদ্দশায় যতগুলো শাসনামল দেখেছেন, তাদের সকল অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন।

রুখে দাঁড়িয়েছেন জিয়ার আমলে যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমোদন দেয়া হয়, যখন মানবতাবিরোধী রাজাকারদের পূনর্বাসন শুরু হয়। স্বৈরাচার এরশাদকে যে ক’জন বুদ্ধিজীবী জ্বালিয়ে ছেড়েছেন, আহমদ শরীফ ছিলেন তাদের অন্যতম। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের জায়গা থেকে রেখেছেন সাহসী ভূমিকা। সেসময় স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে ও গণতন্ত্রের স্বপক্ষে তার শক্তিশালী প্রবন্ধগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারনে অসামান্য অবদান রাখে।


কর্মজীবন
১৯৪৪ সালে এমএ পাশ করার পর দুর্নীতি দমন বিভাগে চাকরির প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেন। ১৯৪৫ সালের আগস্টে লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে ফেনীর সালেহা মাহমুদের সাথে তার বিয়ে হয়। ১৯৪৮ সালে ফেনী ডিগ্রি কলেজে যোগ দেন বাংলার অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৪৯ সালে কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করার পর ১৯৫০ সালের ১৮ ডিসেম্বর তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। মাঝে কিছুদিন দায়িত্বের অদলবদল শেষে ১৯৬৯ সালে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর চূড়ান্তভাবে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি জীবনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সিনেট সভাপতি, শিক্ষক ক্লাবের সভাপতি এবং চারবার কলা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন এবং ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ঐ পদে কর্মরত ছিলেন।


 

১৯৮৭ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’ কর্তৃক ‘একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায়’ গ্রন্থের সম্পাদনা করেন। আরো দুইজন সম্পাদক ছিলেন কাজী নুরুজ্জামান ও শাহরিয়ার কবির। ১৯৯২ সাল ছিলো আহমদ শরীফের জন্য বেশ কঠিন সময়। কারণ এসময় তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্রেফ যুদ্ধ করে গেলেন। ১৯ জানুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হলে তিনি তার উপদেষ্টা হন। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে আলোচনা সভার সভাপতির ভাষণে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী ধর্মান্ধ অপশক্তির উত্থানের বিরদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে শক্তিশালী বক্তব্য রাখেন।

সে বছর ২৬ মার্চ ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গঠিত গণ আদালত-১ এর অন্যতম বিচারক ছিলেন তিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধীরা ছিলো আহমদ শরীফের প্রধান টার্গেট। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার লিখিত শব্দগুলো দিয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইল ঘিরে রাখা যাবে। ১৯৯২ সালের ২২ নভেম্বর জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে ‘স্বদেশচিন্তা সংঘ’র আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণের পর সরকারি প্রশ্রয়ে মৌলবাদী চক্র দেশব্যাপী ঘৃণ্য অবস্থার সৃষ্টি করে। মৌলবাদী পত্রিকাগুলো তার উপর হামলার উস্কানি দিয়ে সংবাদ ও কলাম প্রকাশ করতে থাকে। এরই জের ধরে আহমদ শরীফকে হত্যার হুমকি, তাকে মুরতাদ ঘোষণা, তার বাসায় বোমা নিক্ষেপ এবং দেশের নানা জায়গা থেকে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়।

কিন্তু তাকে রুখে দেয়া যায়নি। তিনি মামলায় হাজিরা দিয়েছেন, হুমকি ও হামলার জবাব লেখনীর মাধ্যমে দিয়েছেন। ভয়ে চুপসে যাননি, আত্মসমর্পন করেননি। বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবীদের মত ভন্ড, ভীরু ও সমর্পনপ্রেমী ছিলেন না। এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের টিকে থাকার জন্য একটা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয়। জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের আরামপ্রদ ছায়া ছাড়া বুদ্ধিজীবীরা নিদ্রাযাপন করতে পারেন না। কিন্তু আহমদ শরীফের কোন পরাক্রমশালী রাজনৈতিক দলের ছায়ার দরকার হয়নি। তিনি ছিলেন সমাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ অনুসারী। সবসময় সমাজতন্ত্রের জয়গান গেয়েছেন। অথচ কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সাথেও সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১৯৯৪ সালের ২৮ জুলাই ভারতের কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আয়োজিত স্মরণসভায় অংশ নিয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন সেই অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামাত কর্মীরা সশস্ত্র আক্রমণ চালালে অন্য বক্তারা আত্মরক্ষার্থে মঞ্চ ছেড়ে চলে যান। কিন্তু এই তান্ডবের মাঝেও আহমদ শরীফ বসেছিলেন। পরে বাম রাজনৈতিক কর্মী হাসান ফকরী তাকে সেখান থেকে তাকে টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।

মানুষের সর্বশেষ আবিস্ক্রিয়া হচ্ছে সমাজতন্ত্র, সর্বশেষ বলেই বোধ হয় সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর গরিব দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রই সর্বোকৃষ্ট। সেজন্যই আমি সমাজতন্ত্রের পক্ষপাতী। কিন্তু সমাজতন্ত্র বললেই মানুষ ক্ষেপে যায়, তার কারণ হলো শাস্ত্র। মানুষ বিশ্বাস-সংস্কার অনুসারে চলে। তাদের ভূতে ও ভগবানে বিশ্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ওই বিশ্বাসই তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নিয়তিবাদী হয়, অদৃষ্টবাদী হয়। নতুন ব্যবস্থার জন্যে তাই আঘাত করা দরকার বিশ্বাসের দুর্গে। প্রথম লেখা থেকে আজ পর্যন্ত আমি মানুষের পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার-নিয়ম-শাস্ত্র-প্রচলিত আইন-কানুন-সবকিছুকেই আঘাত করেছি। বিশ্বাসের দুর্গে আঘাত করেছি, কেননা বিশ্বাস হচ্ছে যুক্তির অভাব। যেসব বিশ্বাস উন্নতির, আধুনিকতার, প্রগতির সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে বাধা, সেগুলোকে আঘাত করেছি। শাস্ত্রীয় আচার-আচরণ সবটাই কুসংস্কার, তার বিরুদ্ধে চিরকাল লিখেছি।
—ড. আহমদ শরীফ। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে।

বাংলাদেশে বর্তমানে মুক্তচিন্তা চর্চার যে ভয়ডরহীন ধারা বহমান। তার শুরু হয় আহমদ শরীফের সময়ে। এর আগে অনেকে অনেক সময় নিজেকে নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘোষণা দিয়ে দেশ, দেশের মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্রচিন্তার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে পারেননি। আহমদ শরীফ পেরেছেন। তার মেধা ও প্রতিভার স্পর্শে হৃষ্ট হয়েছে বাংলাদেশের শরীর ও মনন। তিনি মানুষের চিন্তার দরিদ্রতা নিয়ে যেমন ভাবতেন, সম্পত্তির দরিদ্রতা নিয়েও ভাবতেন। সত্যিকার অর্থে একটি সার্বিক উন্নয়ন চিন্তা গড়ে তোলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের রাজনৈতিকরা নিজেরা দূষিত হয়েছে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি দূষিত করেছে, এখন সেই দূষনের মাঝেই বসবাস করছে। এর মাঝে যতটুকু শুদ্ধতা আছে, তার পুরোটা জুড়ে আহমদ শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কারণ তিনি স্পষ্ট ও আলোকিত।

যেটাকে আপনারা মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িকতা বলেন, যাকে আপনারা ধর্মদ্বেষণার কথা বলেন, যাকে আপনারা জাতি দ্বেষণার কথা বলেন—সবগুলো হচ্ছে ইতরতার কথা। মনুষ্যত্বের কথা নয়। আমাদের মনুষ্যত্বের বিকাশ করতে হবে। মনুষ্যত্বটাই হচ্ছে সংস্কৃতি, এবং সেই সংস্কৃতি-মনুষ্যত্ব এখন ইউরোপের মনীষীরা আমাদের শেখায়। সব মানুষ-ইউরোপের মানুষ সবগুলো ভালো নয়, কিন্তু যে মনীষী সে ভালো। এবং যে জ্ঞানী সে নাস্তিক। এই কথাটা ভাবতে হবে । এই পর্যন্ত—এই পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো নাস্তিককে কোনো আস্তিকের চেয়ে চরিত্রে ভালো ছাড়া খারাপ দেখা যায় নাই। হেন অপরাধ নাই আস্তিকে করে না এবং গুণ নাই যা একজন নাস্তিকের নাই। যত নাস্তিকের নাম জানি তাদের নাই। এবং নাস্তিকেরা গড়ে আস্তিক মানুষের থেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ। কারণ তাদের মধ্যে একজন নাস্তিক হওয়ার আগে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়। নির্ভীক মানুষ হয়। আত্মপ্রত্যয়ী, তার পরে নাস্তিক হয়। কাজেই নাস্তিক বললেই খারাপ হয় না। যে কারণে কমিউনিজম আমাদের দেশে টিকলো না। কয় যে, তারা নাস্তিক । অথচ কমুনিস্টরা মানুষের সেবা করতেই চেয়েছে। অন্য মানুষের মধ্যে চোর-ডাকাত-বদমাশ-খুনি-লম্পট যত পাওয়া গেছে, নাস্তিকের মধ্যে তত পাওয়া যায় নাই, কমিউনিস্টের মধ্যে। তবু তারা গৃহীত হয়নি। এবং আমাদের দেশের মুসলমানরা ভারি খুশি—যেন কমিউনিজম গেছে আর ইসলামের জয় ঘোষিত হয়ে গেছে। কিছুই বোঝে না। না বোঝার জন্য তাদের দোষ দেয়া যায় না। যে শিক্ষা পেলে বোঝে, সে শিক্ষার ব্যবস্থা আমরা করিনি। এই সংস্কৃতির ওপরে যে আমাদের কত রকমের হামলা চলছে তার কথা বলে শেষ করা যায় না।
—ড. আহমদ শরীফ। আমাদের সংস্কৃতির উপর সাম্প্রতিক হামলা।

তিনি সবসময় বলতেন নাস্তিকরা শ্রেষ্ঠ। আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকরা উন্নত। কিন্তু আমরা জানি আস্তিকদের মত নাস্তিকরাও ভন্ড হতে পারে, কপট হতে পারে, সেবাদাস হতে পারে। বর্তমান সময়টা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আসলে আহমদ শরীফও তা জানতেন। কিন্তু তিনি চাইতেন নাস্তিকরা আস্তিকদের চেয়ে উন্নত হোক। উন্নত হোক চিন্তায়, ভাবনায়, মননশীলতায়। তিনি বাংলাদেশের মানুষদের জন্য মুক্তচিন্তার রোডম্যাপ তৈরি করে গেছেন। এ বিষয়ে লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। দিয়েছেন সংখ্যাতীত ভাষণ-বক্তৃতা।

তার ‘ফ্রিথিঙ্কার্স সমাজ’ প্রবন্ধে সবচেয়ে ভালোভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কিভাবে সমাজে মুক্তচিন্তা আন্দোলনের বিকাশ করতে হবে, কিভাবে সংঘবদ্ধ হতে হবে, চারিত্রিক উন্নতি ঘটাতে হবে, কিভাবে কাজ করতে হবে -তার সুনিপুন বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ফ্রিথিঙ্কার্সদের জীবনের পুঁজি-পাথেয় হচ্ছে যুক্তিবাদ, উদারতাবাদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। ফ্রিথিঙ্কার্সদের জানতে হবে জাতিগত ও ধর্মগত স্বাতন্ত্র্য-চেতনাই মানুষে মানুষে দ্বেষ-দ্বন্ধ, সংঘর্ষ-সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। মুক্তচিন্তক মাত্রই স্বকালীন বা সমকালীন জীবন-জীবিকার প্রশ্নে ধর্ম ও সমাজের চেয়ে নীতি ও নৈতিকতাকে বেশি গুরুত্ব দিবে। তারা বিজ্ঞানমস্ক হবে, বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণায় আস্থাহীন এবং বিজ্ঞানের সত্যে, তত্ত্বে ও তথ্যে আস্থাবান হবে।

আহমদ শরীফ মনে করেন মুক্তচিন্তক মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিপক্ষ। তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ফ্রিথিঙ্কার্সরা প্রগতিবাদি। প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্ধে প্রগতিশীলরা অহিংস নীতি অনুসরণ করবে, মানবাধিকার ও মানবতাবোধ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিবে। প্রতিবাদে তারা কথা বলবে, লিখবে, আঁকবে, গাইবে। প্রতিক্রিয়াশীলতা মোকাবেলার জন্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হচ্ছে সেরা অস্ত্র। এর জন্য সহিংস হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

আমাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলে গেছেন মুক্তচিন্তকরা নিজেদের মধ্যে যে-কোনো বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে, তর্কে-বিতর্কে স্বাধীনভাবে নিঃশঙ্ক নিঃসংকোচ আলোচনা করবে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে আলাপে অপরিচিতির বাধা থাকলে তার সঙ্গে মতামত বিনিময়ে ‘জিজ্ঞাসাও করো না, উত্তরও দিও না’ -এই নীতিই হবে অনুসৃত। তিনি বহুমতের, বহুপথের মানুষের সম্মিলনে একটি দৈশিক বা রাষ্ট্রিক জাতি গড়ে ওঠার কথা বলেছেন। কেউ কারো জাতিগত পরিচয় বা অধিকার কেড়ে নিবে না, কেড়ে নিতে চাইলে মুক্তচিন্তকরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে। সবাই সবার কথা বলবে, ভাব-চিন্তা প্রকাশ ও গ্রহণে স্বাধীন থাকবে। কেউ কারো প্রতি জোর করবে না।

তিনি ছিলেন মানবতাবাদী মানুষ। মানুষের প্রতি ভালোবাসায় তিনি জাত, ধর্ম, বর্ণ বিচার করতেন না। খুঁজতেন না শিক্ষিত-অশিক্ষিত ব্যবধান। এজন্য তার সমসাময়িক মানুষেরা আহমদ শরীফকে ‘অসাধারণ’ ‘অনন্য’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন।

যখন আমরা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অনেক অধ্যাপক ও ছাত্রের মধ্যে কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা এবং ধর্মান্ধতা দেখে হতবাক হয়ে যাই, তখন ড. আহমদ শরীফের বিজ্ঞানমনস্কতা ও অসামান্য অগ্রসর চেতনার পরিচয় পেয়ে এই প্রগতিশীল ব্যক্তির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তিনি শুধু কথায় তার অগ্রসর মানসের পরিচয় দেননি কাজেও তা প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে যাতে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান না হয় এবং তাঁর মরণোত্তর চোখ দুটি সন্ধানী এবং মৃতদেহ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগকে দান করার জন্যে একটি উইল করে যান। সংবাদপত্রে পড়েছি মহৎপ্রাণ ড. আহমদ শরীফের দুই চোখের দুটি কর্ণিয়া দু’জন অন্ধ ব্যক্তির চোখে বসানো হয়েছে। এই দুজনের মধ্যে একজনের নামের আগে ‘হাফেজ’ শব্দটি রয়েছে। আখেরে একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মহান ‘মুরতাদ’-এর দান করা চোখ একজন হাফেজের কাজে লাগল। ড. আহমদ শরীফ যা যা দেখতেন অবিকল সেসবই কি দেখছেন এখন সেই হাফেজ সাহেব? হ্যা, দেখছেন ঠিকই। কিন্তু ড. আহমদ শরীফ যেভাবে দেখতেন, সেভাবে তিনি দেখতে পাবেন না। অনেক কিছুই তিনি দেখেও বুঝতে পারবেন না আমাদের শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক-লেখকের মতো। কারণ, যে চেতনার অধিকারী ছিলেন তিনি সেই চেতনা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের নেই। জানি না কোন আগামী দশকে, কোন শতাব্দীতে হবে!
—শামসুর রাহমান [কথায় ও কাজে অভিন্ন এক আদর্শ পুরুষ]

আহমদ শরীফের পর বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার যাত্রাপথে আর কখনো ক্লান্তি আসেনি। তার ছাত্ররা, ছাত্রদের ছাত্ররা এমনকি যারা সরাসরি ছাত্র নয় তারাও আহমদ শরীফের চিন্তা ভাবনার উদারতা দ্বারা প্রভাবিত। তিনি আছেন আমাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও পরামর্শদাতার ভূমিকায়। জীবিত অবস্থায়ও তিনি ছিলেন তার সময়ের মুক্তচিন্তকদের অনুপ্রেরণার উৎসব। সবাইকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন, পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। ১৯৯৩ সালে নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাস সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হলে তিনি বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেন। দুই বছর পর ১৯৯৫ সালে যখন হুমায়ুন আজাদের নারী বইটি নিষিদ্ধ হয়, তখনও তিনি এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। যখনই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, লেখক-শিল্পীরা বাধাগ্রস্থ হয়েছেন, আহমদ শরীফের মুখ ও কলম সমানতালে চলেছে।

লেখালেখি ও পুরস্কার

কলেজে পড়ার সময় তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধের নাম ছিলো ‘ভাষা বিভ্রাট’। বুঝতেই পারছেন ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছোট পত্রিকাগুলোয় নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। এরপর বিরতিহীন লিখে গেছেন। অক্লান্ত লিখে গেছেন। কোন গল্প, কবিতা, উপন্যাস না লিখেও তার মৌলিক রচনার সংখ্যা প্রায় চৌদ্দ হাজার, এবং গবেষণাগ্রন্থসহ তা লক্ষ পৃষ্ঠার কম হবে না। নিষ্ঠার সাথে কর্মজীবনের দায়িত্ব পালন করে, শিক্ষকতা ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকে, রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকেও এত এত মানসম্পন্ন রত্ন রচনা করা যায়, তা আহমদ শরীফকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি নেয়ার পর তার মেধার বিচ্ছুরণ ঘটাতে কিছুদিন সময় নেন। এরমধ্যে গবেষণা সহকারি থেকে লেকচারার পদে উন্নীত হন, আবার গবেষণা সহকারি পদে ফিরে যান, আবার লেকচারার পদে ফিরে আসেন। এমন আসা যাওয়ার মাঝে পুঁথি সাহিত্য নিয়ে নিবিড় গবেষণা ও সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যান। ১৯৫৭ সালে ইতিহাস সৃষ্টি করে পুঁথি সাহিত্য নিয়ে তার প্রথম ফসল ঘরে ওঠে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি আহমদ শরীফ সম্পাদিত দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত ‘লায়লী মজনু’ ছিলো বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম বই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেরও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ তাঁর সম্পাদিত পুথি পরিচিতি (১৯৫৮)।

অধ্যাপক শরীফ মধ্যযুগের চল্লিশটির বেশি কাব্যের পুথি সম্পাদনা করেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো আলাওলের তোহফা (১৯৫৮) ও সিকান্দরনামা (১৯৭৭), মুহম্মদ খানের সত্য-কলি-বিবাদ-সংবাদ (১৯৫৯), মুসলিম কবির পদসাহিত্য (১৯৬১), জয়েনউদ্দীনের  রসুলবিজয় (১৯৬৪), মুজাম্মিলের নীতিশাস্ত্রবার্তা (১৯৬৫), মধ্যযুগের রাগতালনামা (১৯৬৭), বাঙলার সূফীসাহিত্য (১৯৬৯), আফজল আলীর নসিহতনামা (১৯৬৯), বাউলতত্ত্ব (১৯৭৩), সৈয়দ সুলতানের  নবীবংশ,  রসুলচরিত (১৯৭৮) ইত্যাদি।

তার বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (দুখন্ড ১৯৭৮, ১৯৮৩) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। এটিকে তার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে তার আরো দু’টি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ (১৯৭৭) ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য (১৯৮৫)।

বাংলাদেশের সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন সময়ে যে প্রবন্ধগুলি রচনা করেছেন তার সংকলন গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: বিচিত চিন্তা (১৯৬৮), সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা (১৯৬৯), স্বদেশ অন্বেষা (১৯৭০), জীবনে সমাজে সাহিত্যে (১৯৭০), প্রত্যয় ও প্রত্যাশা (১৯৭১), যুগ যন্ত্রণা (১৯৭৪), কালের দর্পণে স্বদেশ (১৯৮৫), বাঙালীর চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা (১৯৮৭), বাঙলার বিপ­বী পটভূমি (১৯৮৯), বাঙলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র (১৯৯০), মানবতা ও গণমুক্তি (১৯৯০), বাঙলা, বাঙালী ও বাঙালীত্ব (১৯৯২), প্রগতির বাধা ও পন্থা (১৯৯৪), এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা (১৯৯৪), স্বদেশ চিন্তা (১৯৯৭), জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা (১৯৯৭), বিশ শতকে বাঙালী (১৯৯৮), বিশ্বাসবাদ, বিজ্ঞানবাদ, যুক্তিবাদ, মৌলবাদ (২০০০) ইত্যাদি।

আহমদ শরীফ বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, একুশে পদক, দাউদ সাহিত্য পুরষ্কারসহ আরো কিছু পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানীয় ডি.লিট উপাধীও লাভ করেছেন। অসামান্য অবদানের জন্য তার স্মৃতিতে ঘোষিত হয়েছে আহমেদ শরীফ স্মৃতি পুরষ্কার যা প্রতিবছর প্রদান করা হয়।

জীবনের শেষ সময়

জীবনের শেষ ভাগে তিনি মূলত বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্ক সভায় বক্তৃতা দিয়ে কাটিয়েছেন। তাও খুব বেশি না। এসময় তিনি নিজেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে নেন জীবনের শোরগোল থেকে। এসবের মাঝে শেষবারের মত বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলগুলোকে একত্র করার চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু সফল হননি। ১৯৯৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য নিজ মৃতদেহ দানের স্বীকারপত্রে স্বাক্ষর করেন। চোখ দু’টি দান করেন সন্ধানীকে। স্বীকারপত্রে তিনি লিখেছেন – সেই অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল,

চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণপ্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরে কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।

১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঠান্ডাজনিত অসুখে ভোগেন। ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে নেয়ার পথে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও চিন্তাবিদ আহমদ শরীফ মৃত্যুবরণ করেন।


তথ্য
১. জীবনপঞ্জি, আহমেদ শরীফ রচনাবলী ১ম খন্ড
২. রাজনৈতিক আন্দোলনে অধ্যাপক আহমদ শরীফ, হাসান ফকরী। —আহমদ শরীফ – শ্রদ্ধাঞ্জলী
৩. স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ অধ্যাপক আহমদ শরীফ, আবদুল আজিজ বাগমার। —আহমদ শরীফ – শ্রদ্ধাঞ্জলী
৪. স্বায়ত্বশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতার ডাক – মুহম্মদ হাবিবুর রহমান

নতুন লেখার নোটিফিকেশন পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

কপিরাইট সংক্রান্ত

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা ভালো লাগলে, গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, কিংবা অপছন্দ করলে নিজে বকা দিয়ে অন্যকে বকা দেয়ার সুযোগ করে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। লেখার শুরুতে এবং শেষে ফেসবুকসহ ডজনখানেক এপসে শেয়ার দেয়ার অপশন আছে। চাইলে কপি করেও শেয়ার দিতে পারেন। কিন্তু দয়া করে নিজের নামে অথবা জনাবা সংগৃহীত ভাইয়ের নামে, কিংবা মিস্টার কালেক্টেড এর নামে চালিয়ে দিবেন না। মূল লেখক এবং ওয়েবসাইটের নাম উল্লেখ করবেন। এবং দোহাই লাগে, এখান থেকে কপি করে নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন না।

মন্তব্য করুন