আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও সন্ত্রাসী তাণ্ডবে সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় গত এক সপ্তাহে প্রায় ৩০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৫ সহস্রাধিক। লুটপাট চলছে প্রতিমুহূর্তে। সংখ্যালঘুরা হয়েছে ‘বলির পাঁঠা’। বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে, দেশের ৩৬টি জেলায় কমবেশী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা হামলার শিকার হয়েছেন। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না আইনি সাহায্য এ অভিযোগ করেছে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর পুলিশ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা রাতারাতি বদলে গেছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, কথিত ‘আওয়ামী পুলিশের’ পরিবর্তে ‘জাতীয়তাবাদী পুলিশ’-এ পরিণত হয়ে এক শ্রেনীর পুলিশ সদস্য সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ-মাস্তানদের তাণ্ডবে বাধা না দিয়ে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ ও নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের আগে রাতারাতি জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক-বাহকে পরিণত হয়ে এক শ্রেনীর পুলিশ কর্মকর্তা কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ জলাঞ্জলি দিয়ে বিএনপি নেতাদের আশীর্বাদ লাভে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নতুন সরকার ও মন্ত্রীসভা গঠনের আগেই বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের বাড়িতে সাদা পোশাকে ঘুরঘুর করছে পুলিশ কর্মকর্তারা। নিরপেক্ষ ও সৎ পুলিশ কর্মকর্তারা অদৃশ্য শক্তির চাপে হাত-পা গুটিয়ে বসে রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ পরিবারের হাজার হাজার সদস্য এখন উদ্বিগ্ন। ভোলা, বরিশাল, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, শরিয়তপুর, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, চাঁদপুর, কুমিল্লা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, যশোর, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রাম-গঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুটপাট চলছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, সংখ্যালঘু পরিবারের তরুণীদের শালীনতাহানী, ধর্ষণ, এমনকি জোরপূর্বক তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে চলছে লুটপাট। গৃহর ঘর থেকে গরু, মহিষ, ছাগল লুট করে নেয়া হচ্ছে। দিনাজপুরের বিরল বোচাগঞ্জে, কুমিল্লার মুরাদনগর, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ, ঢাকা জেলার ধামরাই, সাভার, গাজীপুরের গাজীপুর, কালিয়াকৈরসহ দেশের দুই শতাধিক উপজেলায় প্রকাশ্যে তাণ্ডব চলছে। শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে চলছে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর হামলা। শ্রীপুর আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবার ও আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে চলছে ত্রাস। শ্রীপুর উপজেলার বটপীর বাড়ি আনসার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই উপজেলায় ১৪ জুলাইয়ের পর থেকে সন্ত্রাসীরা কমপক্ষে ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর চালায়। বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা এসব ঘটনার হোতা। প্রকাশ্যে সেসব সন্ত্রাসীরা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, মংলা, শরণখোলা, রামপালের বিভিন্ন গ্রামে শত শত সংখ্যালঘু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা। অনেক এলাকায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে সন্ত্রাসী হামলা ও লুটপাটের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের বড় মাপের নেতা, এমপি বা প্রার্থী সোচ্চার না হয়ে ‘অসুস্থতার ভান’ করছেন বলে কথা উঠেছে। তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, কেবল নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার ’অপরাধে’ সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস তাণ্ডব চলছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করেও প্রতিকার না পাওয়ায় কোন কোন পরিবার দেশত্যাগ করার মত অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকে দেশত্যাগ করেছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান। শোনা যাচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না এ কারণে যে, সরকার গঠনের পরই বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এই আশঙ্কায়। ভোলার কয়েকটি উপজেলায় সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা গত তিন মাস ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরও সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর সন্ত্রাসী তাণ্ডব ও লুটপাট চলেছে। নির্বাচিত সরকার দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। ‘৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর একই ভাবে দেশের ১৯ জেলায় সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা নির্যাতন, সন্ত্রাস ও লুটপাটের শিকার হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও দায়ী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন নেতা জানান, সংখ্যালঘুদের ওপর এবার সবচেয়ে বেশী নির্যাতন চলছে। উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবীও জানান, সংখ্যালঘুরা ‘বলির পাঁঠা’ হয়ে গেছে এখন।
দৈনিক জনকন্ঠ, ৮ অক্টোবর ২০০১