বাংলাদেশে সন্দেহভাজন জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আল্লার দল’এর সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
৫ নভেম্বর ২০১৯, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বলে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানিয়েছেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “সরকারের কাছে এ মর্মে প্রতীয়মান হয় যে, ‘আল্লাহর দল’ নামক জঙ্গি দল/সংগঠনটির ঘোষিত কার্যক্রম দেশের শান্তি শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ইতোমধ্যে দল/সংগঠনটির কার্যক্রম জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।”
সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা এ সংগঠন যে নিষিদ্ধ হচ্ছে, সে ইংগিত এ মাসের শুরুতেই দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
আরও সাতটি সংগঠনের তথ্য গোয়েন্দো পুলিশের হাতে রয়েছে এবং যাচাই-বাছাইয়ের পর এসব সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে গত ৩ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন তিনি।
এ নিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসাবে আটটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হল।
অন্য সাতটি সংগঠন হল- জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলাম।
এর মধ্যে জেএমবিসহ চারটি সংগঠন নিষিদ্ধ হয় ২০০৫ সালে। বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যার দায়ে জেএমবির শীর্ষনেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
উগ্রপন্থা প্রচারের জন্য ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরীরকে।
পুলিশ ও র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যে নেতৃত্বশূন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতার খবর আসে।
সংগঠনটির আমির মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী ওই মামলার রায়ে দোষি সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন। তার দুই অনুসারীর মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন এবং আরও চারজনের বিভিন্ন মেয়াদের সাজার রায় এসেছে।
২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পরিকল্পনাকারী বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হকের নেতৃত্বে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালিয়ে আসছিলেন। ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবির সহযোগিতায় ‘আল্লার দল’ সারা দেশে নতুন করে সংগঠিত হয়ে উঠছে বলে খবর আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
অগাস্ট মাসে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আল্লার দলের ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহিম আহমেদ হিরোসহ আট জ্যেষ্ঠ নেতা র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৫ সালে মতিন মেহেদী ওরফে মুমিনুল ইসলাম আল্লার দল নামে এ সংগঠন গড়ে তোলেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর থানা এলাকা থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ শুরু করা হয়।
২০০৪ সালের শেষের দিকে সংগঠনটি জেএমবির সঙ্গে একীভূত হয়। পরের বছর ১৭ অগাস্ট সারাদেশে জেএমবির বোমা হামলাতেও আল্লাহর দলের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়।
এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযনে জেএমবি দুর্বল হয়ে পড়লে মতিন মেহেদী আবার আল্লার দল নিয়ে সক্রিয় হন।
ঝিনাইদহে ১৭ অগাস্টের বোমা হামলার ঘটনায় ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেলার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল যে ২১ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাদের মধ্যে মতিন মেহেদীও একজন। তখন তিনি পলাতক থাকলেও ২০০৭ সালে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন।
মতিন মেহেদী কারাগারে যাওয়ার পর তাকেই আমির হিসেবে মেনে ভারপ্রাপ্ত আমির হন গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী ইব্রাহিম আহমেদ হিরো। গত ১৮ অগাস্ট তিন সহযোগীসহ ঢাকার হাতিরঝিলের ঝিলপাড় এলাকায় গ্রেপ্তার হন তিনি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এমরানুল হাসান পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কৌশলগত কারণ ২০১৪ সালে আল্লার দলের নাম পরিবর্তন করে ‘আল্লার সরকার’ রাখা হয়। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ কয়েকটি জেলায় সদস্য সংগ্রহ অভিযানে নেমেছিলেন তারা।
“সদস্য সংগ্রহের জন্য এই জঙ্গিরা ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করার মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত করার পরিকল্পনা করেছিল। প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে কারাবন্দি আমির মতিন মেহদীকে মুক্ত করার পরিকল্পনাও তাদের ছিল।”
হিরোসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৭ অগাস্ট রাতে দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকা থেকে আল্লার দলের আরও চার নেতাকে র্যাব গ্রেপ্তার করে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারোয়ার বিন কাশেম পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই গোষ্ঠী গণতন্ত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানে বিশ্বাসী নয়। তারা ঈদ, কোরবানি, হজে বিশ্বাস করে না। জুমার নামাজ আদায় করে না। প্রতি ওয়াক্তে মাত্র দুই রাকাত নামাজ পড়ে থাকে। কালেমার সাথে শেষ নবীর নাম যুক্ত করার ব্যাপারেও তাদের ভিন্ন মত রয়েছে। তারা তাদের নেতা মতিন মেহেদীকে আল্লাহর বিশেষ দূত বলে মনে করে।”