খাসিপুঞ্জিতে পানজুম কেটে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে মৌলভীবাজারের বড়লেখার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের ছোটলেখা চা বাগানে খাসিয়াদের আগারপুঞ্জিতে ২০০ পান গাছ কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে একই চা বাগানের নালিখাইপুঞ্জিতে তাদের জুম এবং বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সবার কাছে খাসিয়া বলে পরিচিত হলেও এই আদিবাসীরা নিজেদের খাসি বলে পরিচয় দেন। চা বাগানের জমি বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে পুঞ্জি (নির্ধারিত এলাকা) বানিয়ে পান চাষ করেন তারা। ২০১৫ বা ২০১৯ সালেই প্রথম নয়, এই চা বাগানের অন্য পুঞ্জিগুলোতেও তাদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে বারবার।
পান চাষ লাভজনক হওয়ায় সেখানকার খাসি পানচাষিদের সরিয়ে সেই চাষের জমি দখল নিতে চাচ্ছে স্থানীয় বাঙালিদের কেউ কেউ। বিভিন্ন সময় পুঞ্জিগুলোর জুম থেকে পান-সুপারি চুরি তো আছেই, কয়েক দিন পরপর ঘটছে দরিদ্র চাষিদের পানগাছ কেটে উচ্ছেদ করার খেলা। এসবের কোনো কোনোটি প্রকাশ পেলেও বেশিরভাগ থেকে যায় আড়ালে। গরিব চাষিরা নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও ভয় পান। সর্বশেষ গত শনিবার আগারপুঞ্জির হাজারের বেশি পানগাছ কেটে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। এর আগের দিন শুক্রবার বনখলাপুঞ্জির বেশ কয়েকটি পানের জুম দখল করে নেয় স্থানীয় বাঙালিরা।
রোববার খাসিরা জুমে যান না, বাড়িতেই ছুটি কাটান। এই সুযোগে গত শনিবার রাতে কে বা কারা আগারপুঞ্জির হাজারের বেশি পানগাছ কেটে ফেলেছে। রোববার বিকেলের দিকে চাষিরা বিষয়টি টের পান। তারা জানান, একটি পানগাছের চারা রোপণের তিন বছর পর থেকে এগুলো থেকে পান সংগ্রহ করা যায়। যেসব পানগাছ কেটে ফেলা হয়েছে সেগুলো থেকে প্রায় প্রতিদিন পান সংগ্রহ করা হতো। তাদের মতে, এসব পানগাছের মূল্য অন্তত আট লাখ টাকা। দরিদ্র চাষিদের কাছে এই পরিমাণ টাকাই অনেক বেশি। এ ঘটনায় গত সোমবার দুপুরে পুঞ্জির মন্ত্রী (প্রধান) সুখমন আমসে বাদী হয়ে বড়লেখা থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
সুখমন আমসে বলেন, ‘আগারপুঞ্জিতে খাসি সম্প্রদায়ের ৪৮ পরিবারের বাস। পান চাষই আমাদের একমাত্র জীবিকা। এখন পানের ভরা মৌসুম চলছে। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। কারও সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। কে বা কারা এ কাজটি করেছে, বুঝে উঠতে পারছি না।’
অন্যদিকে গত শুক্রবার সকালে তাদের কয়েকটি জুম দখল করে নেয় স্থানীয় বাঙালি বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। এ সময় তারা জুমে থাকা খাসিয়াদের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। অন্তত ১০ লাখ টাকা না হলে জুমে চাষিদের ঢুকতে দেবে না বলে জানিয়ে ঘর বানিয়ে দখল করে বসে আছে।
ওই পুঞ্জির মন্ত্রী ও বাগান কর্তৃপক্ষ দুটি আলাদা মামলা করেছে এ নিয়ে। দখলদারদের সরিয়ে নিতে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন ২৪ ঘণ্টার সময় নিয়েছিলেন। তবে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দখলদারদের সরানো যায়নি। এসব দখলদার পুঞ্জির জায়গায় টিনের বেড়া দিয়ে ঘর তুলেছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় আদিবাসীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সদস্যরা দ্রুত সেখানে অভিযান চালিয়ে জায়গাটি দখলমুক্ত করবেন বলে জানা গেছে।
গতকাল বুধবার বনাখলাপুঞ্জিতে ঢোকার পর চোখে পড়ে সুনসান নীরবতা। পুঞ্জির নারী-পুরুষ সবার চোখেমুখে উদ্বেগ আর আতঙ্ক। কেউ ঘরে, আবার কেউ বারান্দায় বসে আছেন। ভয়ের কারণে নিয়ম করে তারা জুমে কাজ করতেও যেতে পারছেন না।
বনাখলাপুঞ্জির মন্ত্রীর সহকারী বিকম আমত্রা বলেন, ‘শুক্রবার সকালে আমরা জুমে গেলে পাশের বোবারথল গ্রামের আব্দুল বাছিত, পিচ্চি আমির, লেছই মিয়ার নেতৃত্বে ৪০-৫০ সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের ভয় দেখায়। তারা আমাদের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ একর জায়গা দখল করে আছে। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ একরের তিনটি পানের জুম আছে।’
বনাখলাপুঞ্জির বাসিন্দা ও চা বাগান কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ছোটলেখা চা বাগান কর্তৃপক্ষ চা চাষের জন্য এক হাজার ৯৬৪ দশমিক ৫০ একর টিলাভূমি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়। পরে তারা ২৭২ একর জমি খাসিয়াদের কাছে উপ-ইজারা দেয়। ২০০৭ সালে খাসিয়ারা ওই জমিতে বনাখলাপুঞ্জি নামে বসতি স্থাপন করে জমিতে পান চাষ শুরু করে। পুঞ্জিতে বর্তমানে প্রায় ৩৬টি খাসিয়া পরিবারের দেড় শতাধিক সদস্য থাকে। প্রতিটি পরিবারের আলাদা পানের জুম আছে।
বনাখলাপুঞ্জির মন্ত্রী নরা ধার বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ। পান চাষ করে সংসার চালাই। তারা জুম দখল করে চাঁদা দাবি করেছে। আবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। জুম দ্রুত উদ্ধার করা না হলে আমরা খাব কী, চিন্তায় আছি।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, ‘খাসিপুঞ্জিতে হামলার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। বছরের পর বছর এটা চলছে, চালাতে দেওয়া হচ্ছে খাসিদের বিতাড়িত করার জন্য। একটি পুঞ্জির জুম দখল এবং আরেকটি পুঞ্জির হাজারখানেক পানগাছ কাটা- দুটোই পরিকল্পিত। দুর্বৃত্তরা এরকম ঘটনা ঘটিয়ে খাসিদের ভয় দেখাচ্ছে, যাতে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এটা আদিবাসীদের বিতাড়নের খেলা।’
প্রাণ-প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, ‘মৌলভীবাজার জেলার খাসিপুঞ্জির লোকজন মূলত দুটি কারণে বিপদে আছে। প্রথমটি হচ্ছে চা বাগান সম্প্রসারণ, দ্বিতীয়টি বহিরাগত বাঙালিদের পুঞ্জি দখল। চা বাগানের জায়গা তারা সম্প্রসারণের নামে অন্যদের সাব-ইজারা দেয়। ইজারা দেওয়া জায়গায় রাবার, লেবু বা আনারস বাগান ছাড়াও রিসোর্ট বানানো হচ্ছে। বহিরাগত বাঙালিরা বৈরাগী বা জোলেখাপুঞ্জির মতো বহু প্রাচীন পুঞ্জি দখল করে নিয়েছে।’
খাসিদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত এই লেখক বলেন, ‘বড়লেখায় পানজুম দখল ও পানগাছ কাটার ঘটনাটি দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রশাসনের উচিত দ্রুত চা বাগান, বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার, ভুক্তভোগী খাসি ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা তদন্ত করা। সে অনুযায়ী বিচারের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তারা যেন নিরাপদে পানজুম করতে পারেন এ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে খাসিদের ভূমি সমস্যার স্থায়ীভাবে নিরসনে সিলেট বিভাগে বিশেষ ভূমি কমিশন গঠন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
একটা চক্র দীর্ঘদিন ধরেই খাসিদের বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে ছোটলেখা চা বাগানের ব্যবস্থাপক শাকিল আহমদ বলেন, ‘তারা আমাদের বাগানের আওতাধীন থাকেন বলে পুঞ্জির পানগাছ কাটা ও জুম দখলের ঘটনায় আমরা তাদের পাশে থেকে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছি। আমাদেরও কিছু গাছ কেটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আমাদের পক্ষ থেকেও মামলা হয়েছে।’
বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বলেন, ‘অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল), সহকারী কমিশনার (ভূমি) বড়লেখাসহ আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বনাখলাপুঞ্জির খাসিয়াদের সঙ্গে কথা বলেছি। দখলদারদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে স্থানীয় চেয়ারম্যান ২৪ ঘণ্টা সময় নিলেও তাদের সরাতে পারেননি। তাই ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও বিজিবিসহ যৌথভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের উচ্ছেদ করা হবে।’ এ সময় খাসিয়াদের সর্বাত্মক আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
গতকাল বুধবার মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ডাড্লী ডেরিক প্রেন্টিস, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের মহাসচিব ফিলা পতমী, বাসদ মৌলভীবাজার জেলা শাখার সদস্য অ্যাডভোকেট এম এ হাসান বনাখলাপুঞ্জি ও আগারপুঞ্জি পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা পুঞ্জি দুটিতে ঘুরে মন্ত্রী ও স্থানীয় খাসিদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে ডাড্লী ডেরিক প্রেন্টিস বলেন, ‘আদিবাসী খাসিরা শুধু পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে না, তারা পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একেকটা গাছ তারা সন্তানের মতো বড় করেন। এরপর তারা সেই গাছে পান চাষ করে গাছ রক্ষায়, পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখেন।’