পুলিশের নির্যাতনের মুখে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে স্কুলছাত্রী জিসা মনি নিখোঁজের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত তিন আসামির স্বজনরা।
তারা বলছেন, জিসা মনি হত্যা হয়নি। কিংবা তাকে নির্যাতনও করা হয়নি। সে অন্য এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। অথচ তাকে অপহরণের দায়ে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে পুলিশি নির্যাতনের মুখে তাদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়।
২৪ আগস্ট সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ মডেল থানার সামনে জিসা মনিকে অপহরণের মামলায় গ্রেফতার যুবক আব্দুল্লাহ, তার বন্ধু রকিব ও নৌকার মাঝি খলিলের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তারা এই অভিযোগ করেন।
গত ৪ জুলাই নিখোঁজ হয় শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার পঞ্চম শ্রেণির স্কুলছাত্রী জিসা মনি (১৫)। বিভিন্ন স্থানে সন্ধানের পর ১৭ জুলাই সদর মডেল থানায় একটি জিডি করেন জিসার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। এক মাস পর ৬ আগস্ট একই থানায় তিনি অপহরণ মামলা দায়ের করেন।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বন্দর উপজেলার বুরুন্ডি খলিলনগর এলাকার আমজাদ হোসেনের ছেলে আব্দুল্লাহ (২২) ও তার বন্ধু বুরুন্ডি পশ্চিমপাড়া এলাকার সামসুদ্দিনের ছেলে রকিবকে (১৯)। ওই দিনই তাদের গ্রেফতার করা হয়। একই ঘটনায় দুই দিন পর গ্রেফতার করা হয় বন্দরের একরামপুর ইস্পাহানি এলাকার বাসিন্দা নৌকার মাঝি খলিলকে।
৯ আগস্ট পুলিশ জানায়, জিসা মনিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয় আসামিরা। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় এই ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে বলেও জানায় পুলিশ। অথচ গত রবিবার সন্ধ্যায় বন্দরের নবীগঞ্জ রেললাইন এলাকায় সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায় নিখোঁজ জিসা মনিকে। এ ঘটনায় চারদিকে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এদিকে আসামির স্বজনরা অভিযোগ করছেন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের মুখে তারা ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে। পুলিশ এই ঘটনা সাজিয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম আল মামুন আসামির স্বজনদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে কয়েক হাজার টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।
গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহার মা শিউলী আক্তার বলেন, ‘আব্দুল্লাহ ওয়ার্কশপে কাজ করতো। আমার ছেলের একটি স্টেটমেন্ট ছিলো যে, আমি ওর সঙ্গে ঘুরছি একসাথে। আর কিছু করি নাই। বিনা কারণে আমার ছেলেরে এত কিছু সহ্য করা লাগছে। যদি আমার ছেলে কিছু করতো তাহলে মেয়েটা জীবিত ফিরে আসলো কেমনে? আমি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীমকে দুই দফায় ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমে যখন ধইরা আনে তখন টর্চার যাতে না করে সেজন্য সাত হাজার টাকা দিছি। পরে আরও তিন হাজার টাকা দিছি। টাকা না দিলে তারে মাইরা ফালানোরও হুমকি দিছে। টাকা দেওয়ার পর সে (এসআই শামীম) কইছে আমার ছেলেরে মারবো না। কিন্তু তারে মাইরা মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়াইছে।’ এই বলে কাঁদতে থাকেন তিনি।
নৌকার মাঝি খলিলের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘সন্দেহ কইরা আমার স্বামীরে ধইরা আনছে। পরে পুলিশ বলছে, ওই মেয়েরে নাকি আমার স্বামী মাইরা ফেলছে। এখন তো দেখতাছি এই মাইয়া বাঁইচা আছে। আমার স্বামীরে কেন পুলিশ ফাঁসাইলো সেইটা আমি জানতে চাই।’
শারমিন আরো বলেন, ‘আমার স্বামী নির্দোষ, তারে ছাইড়া দেন। এই কথা বারবার পুলিশরে বলছি। তখন আমারে কইলো, বেশি কথা বইলো না। বেশি কথা বললে সবাইরে জেলে ঢুকাইয়া দিমু।’
একই অভিযোগ আরেক আসামি রকিবের ভাই সজিবেরও। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ওইদিন ঘাটে মেয়েরে নামাইয়া দিয়া আসছে বলে জানাইছে। এরপর কিছু জানে না। কিন্তু পুলিশ তারে মার্ডার মামলার আসামি বানাইয়া দিল। তার জেল খাটতে হইতাছে। এর বিচার আমি চাই।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত ৪ জুলাই বিকালে জিসা মনি হারিয়ে গেছে মর্মে থানায় তার বাবা একটি জিডি করেন। জিডি নং ৫৩২। জিডির প্রেক্ষিতে কল লিস্ট থেকে আব্দুল্লাহ নামে একজনের নাম জানতে পারি। পরে জিসার বাবা এ মামলা করে ৭/৩০ ধারায়। মামলা নং ৬/৮/২০২০। যেখানে আব্দুল্লাহকে প্রধান আসামি, রকিকে দুই নম্বর আসামি করা হয়। আমরা আসামিদের গ্রেফতার করি। তারা বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দি দেন যে, তারা একটি মেয়েকে নৌকাতে করে ঘুরিয়ে ধর্ষণ করে। পরে তাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।
রিমান্ডের নামে এসআই শামীমের টাকা নেওয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, এ ধরনের তথ্য যদি থাকে, এটা আমাদের নলেজে এসেছে এবং বিশেষ করে এই বিষয়েই এখানে আমাদের আসা হয়েছে। আমাদের পুলিশ সুপার বিষয়টা দেখছেন। যদি আমাদের কোন পুলিশ সদস্য এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
এদিকে এ ঘটনা তদন্তে নারায়ণগঞ্জ ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে।