মধ্যরাতে অবৈধ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে সাজা দেওয়া এবং নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে শাস্তি থেকে রেহাই দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

এর আগে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত আগষ্টে সুলতানা পারভীনের বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার “লঘুদণ্ড” প্রদান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সাড়ে তিন মাসের মাথায় তা বাতিল করে অভিযোগের দায় থেকেও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

কুড়িগ্রামে ঢাকা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় সাবেক ডিসি সুলতানাকে গত বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করে সরকার। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওএসডি হয়ে থাকা উপসচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তার শাস্তির আদেশ এসেছিল গত ১০ আগস্ট । এবার সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে গত ২৩ নভেম্বর আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সেখানে সুলতানা পারভীনের শাস্তি বাতিলের বিষয়টি জানানো হয়।

জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “যেহেতু মোছা. সুলতানা পারভীন তার উপর অরোপিত উল্লিখিত লঘুদণ্ডাদেশ মুকুফের জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে আপিল আবেদন পেশ করলে মাহামান্য রাষ্ট্রপতি সদয় হয়ে মোছা. সুলাতানা পারভীনের আপিল আবেদন বিবেচনা করে পূর্বে প্রদত্ত দুই বছরের জন্য ‘বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা’ নামীয় দণ্ডদেশ বাতিল করে তাকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। ”

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, সেহেতু মোছা. সুলতানা পারভীন, প্রাক্তন জেলা প্রশাসক, কুড়িগ্রাম, বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উপসচিব), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়- এর বিরুদ্ধে রুজুকৃত বিভাগীয় মামলায় দুই বছররের জন্য বেতন বৃদ্ধি ‘স্থাগিত রাখা’ নমনীয় লঘুদণ্ড প্রদান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ১০ আগষ্টের প্রজ্ঞাপনটি বাতিলপূর্বক তাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হল।”

এ বিষয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান বলেন, “রাষ্ট্রপতি যে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। কিন্তু আমি হতাশ। অপরাধটা আমার সঙ্গে হয়েছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আমি। দণ্ড বাতিল করার অর্থ হচ্ছে, অপরাধটা আমার সাথে হয়নি। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। তাহলে কী প্রতিকার পেলাম আমি?”

তিনি আর বলেন, “লঘু শাস্তি দেওয়ায় এমনিতেই আমি সংক্ষুব্ধ ছিলাম। সেই লঘু শাস্তিটাও যখন বাতিল হয়ে যায়, তখন আসলে আর কোনো আশার আলো দেখছি না। এটা সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি বড় হতাশার বিষয়।”

প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ঢাকা ট্রিবিউনের তৎকালীন কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে গত বছরের ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে তার নিজ বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। এরপর তাকে এনকাউন্টারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জেলা শহরের ধরলা ব্রিজের পূর্ব পাড়ে নেওয়া হয়। পরে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন ওই সময়ের আরডিসি নাজিম উদ্দীন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও মোবাইল কোর্টের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ জেলা প্রশাসনের কর্মচারিরা। পরে সাংবাদিক আরিফের কাছে আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় পরদিন ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

গত বছরের ১৫ মার্চ পরিবারের আবেদন ছাড়াই সাংবাদিক আরিফকে জামিনের ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন। কারামুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারি কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামসহ অজ্ঞাত ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফ। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ৩১ মার্চ সেই মামলা রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ।

পরে, ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ডিসি সুলতানা পারভীন, সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারসহ ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফুল।

এরপর ২৬ মার্চ সুলতানা পারভীনসহ তার কার্যালয়ের সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।

ঢাকা ট্রিবিউন

মন্তব্য করুন