টাঙ্গাইলের মধুপুরের গহীন বনে মান্দিদের (গারো) শতাব্দী প্রাচীন শ্মশানকে ঘিরে বন বিভাগের বাগান ও সীমানা প্রাচীর বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

 

৩০ মে রোববার বেলা ১১টায় টেলকী বাজার এলাকায় মধুপুরের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যনারে এই কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় আগামী সাত দিনের মধ্যে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের নামে গেস্ট হাউজ এবং সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ বন্ধ ও আলোচনায় না বসলে সড়ক অবরোধ করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

মধুপুরের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যনারে আয়োজিত কর্মসূচির সময় নির্ধারিত ছিল বেলা ১১ টায়। কিন্তু আদিবাসী গ্রামগুলো থেকে সকাল থেকেই আসতে শুরু করেন নানা বয়সী নারী, পুরুষ ও শিক্ষার্থীরা। বুকের সামনে নানা বক্তব্য লেখা ফেস্টুন নিয়ে মধুপুর-ময়মনসিংহ সড়কের টেলকীতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন তারা। সবার কণ্ঠে ছিল- এই বন যতদূর ঠিক ততদূর আমার বাড়ি, টেলকীতে আদিবাসীদের শ্মশানের উপর গেস্ট হাউজ নির্মান বন্ধ করো, বিশ্বে যখন অক্সিজেনের অভাব মধুপুরে তখন গাছ কেটে গেস্ট হাউজ নির্মাণের মহোৎসব, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন বন্ধ করো, আদিবাসীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করো, সমতল আসিবাসীদের জন্য পৃথক স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করো।

বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) এর সভাপতি জন জেত্রার সভাপতিত্বে গারো স্টুডেন্ট’স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিলের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন-বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, জিএসএফের সভাপতি প্রলয় নকরেক, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য গৌতম কর ও নারী নেত্রী লিজা নকরেক, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই ও আজিয়া’র সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মানকিন প্রমুখ।

 

সমাবেশ থেকে চার দফা দাবি উত্থাপন করেন আদিবাসীরা। দাবিগুলো হল- টেলকী গ্রামে তথাকথিত আরবোরেটামের নামে আদিবাসীদের শতাব্দী প্রাচীন শ্মশানের স্থানে প্রাচীর নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনাসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে বন্ধ করা, আদিবাসীদের স্বত্বদখলীয় কৃষি ও ফসলি জমিতে কোনো ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা, জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা বাতিল করে আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ করা এবং আদিবাসী প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা।

সমাবেশ থেকে সাত দিনের আল্টিমেটাম ঘোষণা করা হয়। এই সাত দিনের মধ্যে যদি প্রকল্পের কাজ বন্ধ করা না হয়, তবে মধুপুরের আদিবাসী ছাত্র-যুব-জনতা সড়ক অবরোধসহ আরও কঠোর কর্মসূচি হাতে নেবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।

সমাবেশ শেষে একটি মিছিল বের করতে চাইলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বাধা দেন। পরে পুলিশি বাঁধা উপেক্ষা করে একটি মিছিল টেলকী বাজার পেরিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার টেলকী বাজারে এসে শেষ হয়।

সমাবেশের শুরুতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন লিয়াং রিছিল। তিনি বলেন, ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান শাসনামল পেরিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরেও মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা ও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। উপরন্তু বিভিন্ন সরকারের সময় জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক, ইকো ট্যুরিজম, ফায়ারিং রেঞ্জ ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার নামে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের নীল নকশা করেছে। বিভিন্ন সময় সরকারের বনবিভাগ অপরিকল্পিত, পরিবেশ আগ্রাসী ও বন বিনাশী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান বলেন, প্রকল্পের নামে যদি বনবিভাগ আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ না করে তাহলে আগামী দিনে আদিবাসী ছাত্র-যুব-জনতার স্রোত সে প্রকল্প রোধ করতে বদ্ধপরিকর হবে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ বলেন, বন বিভাগ বন রক্ষার বদলে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে যে কৃত্রিম বন সৃজন করছে তা ভালো হবে না। টেলকীর প্রাচীন শ্মশানে প্রাচীর ও প্রকল্পের অন্যান্য স্থাপনা বন্ধ করারও দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামায় বলেন, পাহাড় কিংবা সমতলে সরকার উন্নয়নের নামে যে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তা আসলে আদিবাসী উচ্ছেদের জন্য। কোনো জনগোষ্ঠীকে যদি কেউ ধ্বংস করে দিতে চায়, তাহলে সেই জনগোষ্ঠীর পবিত্র স্থানে আগে হাত দেয় দুর্বৃত্তরা। তাই বনবিভাগও শ্মশানের মত পবিত্র এই স্থানের উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে।

বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংসদ (বাগাছাস) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জন জেত্রা বলেন, শ্মশান আদিবাসীদের জন্য পবিত্র স্থান। আগামী সাত দিনের মধ্যে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে সড়ক অবরোধ কর্মসূচিসহ নানা কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। প্রাণ থাকতে নিজেদের পূর্ব পুরুষদের স্মৃতিচিহ্নে মাটির কণাও বেহাত হতে দেব না ।

সমকাল

মন্তব্য করুন