আদালতে ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করায় এক গৃহবধূ ও তার পরিবারের সব সদস্যকে সমাজচ্যুত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা চরক্লার্ক ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি মসজিদে প্রবেশেও দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
প্রভাবশালীদের হুমকি-ধমকিতে ভিটেমাটি ছেড়ে দু’সন্তান নিয়ে দু’মাস ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই গৃহবধূ। অন্যদিকে গত ১০ দিন ধরে গৃহবধূর বাবা ও পরিবারের সদস্যদের এক ঘরে করে রাখা হয়েছে।
২১ মার্চ রবিবার নির্যাতনের শিকার ওই নারীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বসত ঘরের দরজা বেঁধে রাখা হয়েছে। ঘরের পাশে আবাদ করা বিভিন্ন সবজি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে গত দু’মাস ধরে এ বাড়িতে কেউ থাকেন না।
ওই নারীর বাবা (৫৫) জানান, গত বছরের ৮ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে কেফায়েত উল্যাহ (৪৫) ও বাহার উদ্দিন (৪০) মেয়ের ঘরে ঢুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। মেয়ের চিৎকার শুনে আমি এগিয়ে গেলে অভিযুক্তরা আমাকে মারধর করে। পরে মেয়ে নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে ১০ আগস্ট একটি মামলা করে।
তিনি বলেন, এরপর স্থানীয় দোকানপাটে আমাদের কাছে সদাই বিক্রিতে নিষেধ করা হয়েছে, আমাদের সন্তানদের মক্তবে, মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি জুমার নামাজ পড়তে গেলে মসজিদ কমিটির লোকজন মসজিদে আসতে নিষেধ করে দেয় আমাকে। জুমার নামাজে (১৯ মার্চ) গেলে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ লোকজন আমাকে মারধর করে গলা ধাক্কা দিয়ে মসজিদ বের করে দেয়।
গৃহবধূর বাবার অভিযোগ, কেফায়েতকে গ্রেপ্তারের পর তার পক্ষে মসজিদ কমিটির সভাপতি এমলাক সওদাগর, সেক্রেটারি সোলেমান সওদাগরসহ সমাজপতিরা গত দুই সপ্তাহ আগে বৈঠক করেন। এ সময় সমাজপতিরা আদালত থেকে মামলা তুলে নিতে বলেন। না হলে তার মেয়ে এলাকায় থাকতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত দেন।
মামলার বাদী ওই গৃহবধূ দেশ রূপান্তরকে টেলিফোনে জানান, মামলা তুলে নিলে আমাকে সমাজে গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মামলা তুলে না নেয়ায় আমি আমার দুই সন্তান নিয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছি।
গৃহবধূর করা মামলার আইনজীবী মো. সাইফ উদ্দিন কামরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, চরক্লার্ক ইউনিয়নের ওই গৃহবধূকে গেল বছরের আগস্টে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় একই গ্রামের কেফায়েত উল্যাহ (৪৫) ও বাহার উদ্দিন। এ ঘটনায় গৃহবধূ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। মামলায় বিচার বিভাগীয় দুটি তদন্তে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পায় আদালত। আদালত কেফায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
তিনি জানান, এরপর মামলায় অভিযুক্ত ১ নম্বর আসামি কেফায়েত উল্যাহকে ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে চর জব্বর থানা পুলিশ। এরপর থেকেই গৃহবধূর পরিবারের ওপর মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি ও চাপ আসতে থাকে। মামলা তুলে না নেয়ায় গৃহবধূর স্বামী ও তার ছোট ভাইকে আসামি করে মামলার ২ নম্বর আসামি বাহার উদ্দিনের স্ত্রী একই আদালতে ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ধর্ষণের মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তা খারিজ করে দেয়।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম বলেন, তাদের সব ধরনের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণে নিষেধ করা হয়েছে তবে মসজিদে আসতে নিষেধ করা হয়নি।
মসজিদ কমিটির সভাপতি এমরাত সওদাগর বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা দেওয়া হয়েছে। আমাদের এলাকায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। রাস্তার পাশে শিমের বীজ বপনকে কেন্দ্র করে ঝগড়া হয়। এই মহিলা মামলা করে এলাকাকে কলঙ্কিত করেছেন। সমাজের লোকজন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের একঘরে করা হয়েছে। আমরা সামাজিকভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছি কিন্তু তারা (ভিকটিম পরিবার) সে সিদ্ধান্ত মানেনি’।
ওই মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি সোলেমান সওদাগরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ চেষ্টার মামলা আমরা শুনিনি, আমরা শুনেছি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। সে জন্য সামাজিকভাবে একঘরে করার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি’।
এ বিষয়ে সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম ইবনুল হাসান ইভেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিষয়টি জানার পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিয়েছি। সমাজচ্যুত করাটা কোনো আইনগত প্রক্রিয়া নয়। মসজিদে যেতে দেবে না, বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে দেবে না এটা হতে পারে না। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
চরক্লার্ক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল বাশার দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমি নিজে রাতে ওই এলাকায় যাচ্ছি। ইতিমধ্যে স্থানীয় মেম্বারকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।