নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আর বেঁচে নেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুবতারা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার সৃষ্ট ‘অমলকান্তি’র মতোই যেন রোদ্দুর হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ৯৪ বছর বয়সে চিরপ্রস্থান ঘটলো এই কিংবদন্তীর। ২৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত সাড়ে বারোটায় কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রধান পরিচয় তিনি একজন কবি। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশু-সাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনীর লেখক ও সম্পাদক।

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার শৈশবের পুরোটাই কেটেছে পূর্ববঙ্গে দাদা-দাদীর কাছে। প্রাথমিক লেখাপড়া সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০ সালে কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি।

পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন নীরেন্দ্রনাথ। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। আনন্দমেলা পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তিনি। আনন্দমেলার জন্য বাংলা ভাষায় প্রথম ‘টিনটিন’ অনুবাদ করেন।

তার কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটতে শুরু করে ছেলেবেলা থেকেই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জনে’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। সেই সময় তিনি ছিলেন ৩০ বছর বয়সী টগবগে যুবক। এরপর ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সালে বিশ্ব কবিতা সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

তার লেখা ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় সমান্ততান্ত্রিক জমিদার জোতদার সমাজ ব্যবস্থাকে তীব্র কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতার শেষ লাইনে লেখা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ লাইনটি আজও মানুষের মুখেমুখে। ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ লাভ করেন।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যতে কলকাতার শিল্প-সাহিত্য সমাজের রোদ্দুর আজ বিষাদের চাদরে ঢাকা পড়েছে। তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কবি সাহিত্যিকদের অভিভাবকের মতো। তাইতো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন -অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম।

কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন -জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়। সহজ ভাষার টান টান চেতনার স্পর্ধিত সেই কবি চলে গেলেন আজ। তাঁকে আমাদের প্রণাম।

সকলের কথায় অভিভাবক হারানোর সুর, যেন চৈত্রের খরতাপে ছায়া হারানোর বেদনা। কবি সুবোধ সরকারও সেই বেদনায় কাতর। তিনি বললেন -কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চলে গেলেন। আমি জীবনে দ্বিতীয়বার পিতৃহীন হলাম।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মত মানুষেরা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সীমান্তরেখা মুছে দিতে সাহায্য করেন। তাদের সৃষ্টি ও চিন্তার আলোয় সীমান্ত রেখাগুলো ঝলসে যায়। তাইতো বাংলাদেশের মানুষও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যুতে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।  নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের মশাল বাহক। তিনি আমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন, তার দেখানো প্রতিবাদী স্পষ্ট পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাবো। শব্দের শক্তিতে চিরকাল টিকে থাকবেন প্রিয় নীরেন্দ্রনাথ।

আমাদের পাঠকের জন্য এই অসামান্য কবির রচিত তিনটি কবিতা এই সংবাদের সাথে যুক্ত করা হলো।

উলঙ্গ রাজা
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ,তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে শাবাস, শাবাস।
কারো মনে সংস্কার, কারও ভয়-
কেউ বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে
কেউ বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম,
চোখে পড়ছে না যদিও, তবুও আছে
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তি বাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নিবোর্ধ স্তাবকই ছিল না
একটি শিশুও ছিল-
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।
নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়-
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু
জমে উঠছে স্তাবক- বৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতর আজ কোথাও দেখছি না।
শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোন
পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে কোন নির্জন নদীর ধারে কিংবা
প্রান্তরের গাছের ছায়ায়

যাও, তাকে যেমন করেই হোক খুজেঁ আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে হাততালির উর্ধ্বে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করুক;
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘অমলাকান্তি’। এই কবিতাটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘অমলাকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ এই লাইনটি যেন প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে।

অমল কান্তি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অমল কান্তি আমার বন্ধু,
ইশকুলে আমরা একসাথে পড়তাম।
রোজ দেরী করে ক্লাসে আসত,
পড়া পারত না।
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক
হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকত
যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম
কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সেসব কিছুই হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!

ক্ষান্ত বর্ষণ আর কাক ডাকা বিকেলের
সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জাম্রুলের পাতায়
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন
লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ
ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায়
কাজ করে।
মাঝেমধ্যে আমার
সাথে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা ওটা গল্প করে, তারপর,
তারপর হঠাৎ করে বলে ওঠে,
“উঠি তাহলে”।
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত
এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলেও
তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলের ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।

সেই অমলকান্তি রোদ্দুরের
কথা ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

বাংলাদেশে যারা মুক্তচিন্তার সাথে জড়িত তাদের কাছে নীরেন্দ্রনাথের ‘মিলিত মৃত্যু’ কবিতাটি মুক্তচিন্তার ইশতেহারের মতো। ‘বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়’ —মুক্তচিন্তকদের মুখে-মুখে, ব্লগে-ব্লগে ফেসবুক ওয়ালে-ওয়ালে অনেকদিন ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে। এই একটি মাত্র কবিতার জন্য বাংলার মুক্তচিন্তার ইতিহাসে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নাম স্বর্নাক্ষরে চিরকাল লেখা থাকবে।

মিলিত মৃত্যু
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিস্কার করে।

প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর কথা বলা যাক।
শুভেন্দু এবং সুধা কায়মনোবাক্যে এক হতে গিয়েছিল।
তারা বেঁচে নেই।
অথবা মৃন্ময় পাকড়াশি।
মৃন্ময় এবং মায়া নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখেনি।
তারা বেঁচে নেই।
চিন্তায় একান্নবর্তী হতে গিয়ে কেউই বাঁচে না।

যে যার আপন রঙ্গে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
মিলিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
তা হলে দ্বিমত হওঁ। আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
তা হলে বিক্ষত হও তর্কের পাথরে।
তা হলে শানিত করো বুদ্ধির নখর।
প্রতিবাদ করো।

ঐ দ্যাখো কয়েকটি অতিবাদী স্থির
অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়।
পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি।
ওরা আর তাকাবে না ফিরে!
ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা
একমত হতে-হতে কুতুবের সিঁড়ি
বেয়ে উর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।

মন্তব্য করুন