সারা পৃথিবী যখন জীবনঘাতি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ও বিস্তাররোধে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, একই সাথে রোগের মতই প্রাদুর্ভাব ঘটেছে কিছু মিথ বা ভ্রান্ত ধারণার, যা এই রোগকে সঠিকভাবে প্রতিরোধের প্রক্রিয়াকে আরো বেশী জটিল এবং কঠিন করে তুলেছে। ইতিমধ্যে, পৃথিবীর ৫৫ টা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস; আক্রান্ত হয়েছে ৯৫ হাজার ৭১ জনেরও বেশী মানুষ, প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ৩২৫৩ জনের বেশী মানুষের

নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে, সাধারণ জনসাধারণকে নিয়মিতভাবে হাল নাগাত তথ্য সরবরাহ করছেন তাঁরা, করোনার মরণ কামড় থেকে সবাইকে রক্ষা করাই যার উদ্দেশ্য। 

এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত না হওয়ায় কেবল মাত্র সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া এবং হাঁচি- কাশির সময়ে মুখ ঢেকে রাখা এই ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারকে যেমন ঠেকাতে পারে- তেমনি স্যালাইন বা নাকের ড্রপ দিয়ে নাক পরিস্কার রাখা এবং রসুন খেয়ে করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার হাস্যকর চেষ্টা এই রোগের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলছে। 

এইসব বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে সঠিক তথ্য পরিবেশনের উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) একটি প্রতিবেদনে মিথগুলোকে খণ্ডন করে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে যে বারটি মিথ বহুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে সেগুলোকে খণ্ডন করে প্রকৃত অবস্থা নীচে তুলে ধরা হলোঃ 

হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে কি নতুন করোনা ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব?

না। হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে নতুন করোনা ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব নয়। করোনা ভাইরাসের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হলে হ্যান্ড ওয়াশ, হ্যান্ড রাব অথবা সাবান পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধুতে হবে, হাত পরিস্কার রাখতে হবে। হাত ধোয়ার পরে টিস্যু পেপার বা এয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে হাত শুকানো যেতে পারে।

আলট্রা – ভায়লেট ডিজইনফেকশন ল্যাম্পের সাহায্যে কি করোনা ভাইরাস মুক্ত হওয়া সম্ভব?

আলট্রা – ভায়লেট ডিজইনফেকশন ল্যাম্প দিয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। এই ল্যাম্প ব্যবহার করলে বরং ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি ব্যবহারকারীর ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। 

থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব?

থার্মাল স্ক্যানার মূলত দেহের তাপমাত্রা শনাক্ত করতে পারে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে জ্বর থাকলে সেটা থার্মাল স্ক্যানারে ধরা পড়বে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে যদি জ্বর না  থাকে, তখন স্ক্যানারের পক্ষে শনাক্ত করা সম্ভব নয় যে ঐ ব্যক্তির শরীরে করোনা ভাইরাসে বাসা বেঁধেছে কিনা। এবং জ্বর না থাকলেই এ সিদ্ধান্তে আসা যাবে না আসলেই ঐ ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন নি। কারণ, এই ভাইরাসটি রোগীর দেহে প্রবেশ করে সুপ্ত অবস্থায় ২ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে এবং এই সময়ের মধ্যেই রোগীর শরীরে জ্বর ও অন্যান্য লক্ষণ গুলো প্রকাশিত হতে থাকে। তাই, থার্মাল স্ক্যানারে জ্বর ধরা না পড়লেও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে ২ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এই সময়ের মধ্যে কোন উপসর্গ না দেখা দিলে বোঝা যাবে যে আসলেই তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন নি।

শরীরে এলকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করে কি করোনা ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব?

না। একবার যদি এই ভাইরাস দেহের মধ্যে প্রবেশ করে থাকে তবে এলকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে দিয়ে করোনা ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব নয়। বরং এগুলো স্প্রে করলে সেটা পোষাকের জন্য যেমন ক্ষতিকর, একই ভাবে চোখে বা মুখে প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এলকোহল বা ক্লোরিন কেবলমাত্র ঘরের মেঝেকে জীবাণু মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, মানুষের শরীরে নয়। নির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা মেনে এগুলো ব্যবহার করা উচিৎ, যত্রতত্র ব্যবহার কোনভাবেই করা উচিত নয়।

চীন থেকে আসা চিঠি বা পার্সেল গ্রহণে কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি রয়েছে?

চীন থেকে আসা কোন চিঠি বা পার্সেল থেকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হবার কোন সুযোগ নেই। কারণ, আগের বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে চিঠি বা পার্সেলের মত বস্তুর ওপরে করোনা ভাইরাস বেশীক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। 

পোষা প্রাণীর মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কোন সম্ভাবনা বা ঝুঁকি রয়েছে কি?

এখন পর্যন্ত পোষা প্রাণী, কুকুর- বিড়ালের মাধ্যমে এই রোগ সংক্রমণ বা বিস্তারের সত্যতা মেলে নি। তবে, পোষা প্রাণীর সংস্পর্শে আসার পর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া অবশ্যই সব সময়ের জন্যই ভালো; এতে করে পোষা প্রাণী থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হওয়া ই-কোলাই ও স্যালমোনেল্লা জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে।

নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন বা টিকা কি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে?

না। নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন বা টিকা নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসটি একেবারেই নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাস। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রতিরোধের কোন ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে একদল গবেষক নতুন করোনা ভাইরাসে টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাক্সিনই নতুন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী না হলেও অন্যান্য শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত রোগের সংক্রমণ  থেকে বাঁচতে অন্য যেকোন টিকা নিতে কোন অসুবিধা নেই। 

স্যালাইন পানি বা নাকের ড্রপ নিয়ে নিয়মিত নাক পরিষ্কার করলে কি নতুন করোনা ভাইরাসের ছোবল থেকে রক্ষা যাওয়া যাবে?

না। এখন পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে নিয়মিত স্যালাইন পানি বা নাকের ড্রপ ব্যবহার করে নাক পরিষ্কার রাখলে কোভিড-১৯-এর কবল থেকে বাঁচা যাবে। স্যালাইন পানি বা নাকের ড্রপ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে আরোগ্য লাভে কার্যকরী হলেও শ্বাসনালী সংক্রান্ত জটিল কোন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কার্যকরী নয়। 

নিয়মিত  রসুন খেয়ে কি করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব?

রসুন নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যকর খাদ্য। কিন্তু, নতুন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে রসুনের সক্ষমতার প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।

সারা শরীরে তিল তেল মেখে কি নতুন করোনা ভাইরাসের মানব শরীরে প্রবেশ পথ বন্ধ করা সম্ভব?

না। তিল তেল দিয়ে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অবশ্য, কিছু কিছু জীবাণু বিধ্বংসী কেমিক্যাল রয়েছে যা দিয়ে ঘরের ভিতরে বা মেঝের করোনা ভাইরাস নির্মুল করা সম্ভব। কিন্তু এগুলো গায়ে মেখে বা নাকে ঘষে কোনভাবেই করোনা ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে, ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে এই কেমিক্যালগুলো।

করোনাভাইরাসে কি কেবল বয়স্ক মানুষেরাই আক্রান্ত হন, অথবা কম বয়েসী মানুষেরাই কি বেশী ঝুঁকিতে?

যে কোন বয়েসের মানুষই নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে, যেসব বয়স্ক মানুষ আগে থেকেই এজমা বা ডায়েবেটিকস রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি একটু বেশী, করোনাভাইরাস সহজেই এদের কাবু করে ফেলতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব বয়সের সকল মানুষকে এই রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে হাত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং শ্বাসনালী পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে।

এন্টিবায়োটিক দিয়ে কি নতুন করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সম্ভব?

না। এন্টিবায়োটিক মূলত ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটা যেহেতু ভাইরাস জনিত রোগ, এন্টিবায়োটিক দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা একেবারেই সম্ভব নয়।

তবে যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন, তাদের করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের কোন উপসর্গ দেখা দিলে, সেক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।

নতুন করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোন ঔষধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আছে?

এখন পর্যন্ত নতুন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর জন্যে কোন নির্দিষ্ট কোন ঔষধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় নি। তবে, আক্রান্তদের রোগের লক্ষণ অনুসারে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় সেবা এবং ঔষধ নিশ্চিত করতে হবে। 

এ রোগের নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ঔষধ এখনো পরীক্ষাধীন অবস্থায় রয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবহার উপযোগীতা প্রমাণিত হলেই কেবল সেগুলো নতুন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের নিরাময়ে ব্যবহার করা শুরু হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য অভিজ্ঞ গবেষক ও পার্টনার সংস্থাগুলোর সাথে এক যোগে কাজ করে যাচ্ছে।

করোনা ভাইরাস ঠেকাতে চুমু খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে?

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, চুমুর মাধ্যমেও ছড়াতে পারে করোনা ভাইরাস। আপাতত চুমু খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে এই ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএনটি বিশেষজ্ঞ মাইকেল ওস্টারহোলম জানিয়েছেন, যখন এই ভাইরাস কোন কমিউনিটির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন চুমু খাওয়া এড়িয়ে যাওয়াই বিচক্ষণতার পরিচয়দায়ক। এই রোগকে প্রতিরোধের অল্প যে কয়টা উপায় আছে, এটা তারই অন্যতম।

তথ্য সূত্রঃ
১/ ডব্লিউ এইচ ও
২/ ইন্ডিপেন্ডেট

মন্তব্য করুন