২ মে ২০২০। কলবেলের শব্দে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘুম ভাঙে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের। দরজা খুলতেই অপরিচিত একজন জানতে চাইলেন, ‘দরজা খোলেন না কেন? আর হ্যাঁ, লুঙ্গিটা বদলে প্যান্ট পরে নেন, ভালো একটা শার্ট। যেতে হবে।’ ঠাট্টাচ্ছলে কার্টুনিস্ট কিশোর তখন জানতে চান, ‘আপনারা কারা? আমাকে কি কোনো শুটিংয়ের জন্য নেওয়া হচ্ছে?’
কাকরাইলের বাসা থেকে ওই দিন কারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা এখনো জানেন না কিশোর। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৫ মে র্যাব হেফাজতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। তিনি এখন গ্রেপ্তার। মামলার এজাহার অনুযায়ী, কাকরাইলের বাসা থেকে ৫ মে বেলা আড়াইটায় র্যাব–৩ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মাঝের ৬৯ ঘণ্টা কোথায় ছিলেন, সেটা জানেন না কিশোর। তাঁর অভিযোগ, ওই সময়ে কয়েক দফায় তাঁর ওপর চলে নির্যাতন।
৪ মার্চ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান কার্টুনিস্ট কিশোর। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে হাসপাতালে ভর্তির আগে আইনজীবীর চেম্বারে তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। গাড়ি থেকে নেমে আইনজীবীর কক্ষে ঢোকেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কেমন আছেন—জানতে চাইলে কিশোর কান দেখিয়ে বলেন, পুঁজ পড়ছে। দেখান কালশিটে পড়া দুই পা। কারাগারের ১০ মাসে সুচিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার জেল সুপার তাঁকে দেখতে এসেছিলেন, জামিনে বের হলে ভালো চিকিৎসক দেখাতে পরামর্শ দেন তিনি।
একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সম্প্রতি মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের প্রসঙ্গ তুলতেই বিমর্ষ হয়ে পড়েন কিশোর, ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।
ঠিক কী ঘটেছিল ওই দিন? কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন কিশোরকে। কিশোর প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন ১৬–১৭ জন। একজন বলেছিলেন, তাঁর নাম জসিম। অন্তত চারজনের কাছে ছোট অস্ত্র ছিল, কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল না। ঘরে ঢুকেই তল্লাশি শুরু করেন। পুরো বাসা একরকম লন্ডভন্ড করে দিয়ে কিশোরের মুঠোফোন, সিপিইউ, পোর্টেবল হার্ডডিস্কসহ যত ডিজিটাল ডিভাইস ছিল, সব নিয়ে কিশোরকে হাতকড়া পরান। তারপর নিচে নামান। বাসার সামনে তখন ৬–৭টি গাড়ি। কিশোর চেঁচামেচি শুরু করেন এ সময়। কাকরাইলে বাসার সামনে লোক জমে গেলে নাক পর্যন্ত ঢাকা বিশেষ ধরনের টুপি পরিয়ে কিশোরকে গাড়িতে তোলেন তাঁরা। উচ্চ শব্দে গান ছেড়ে দিলে কিশোরের চিৎকার মিলিয়ে যায়।
কিশোরের এই বক্তব্য মানতে রাজি নন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে যেকোনো বক্তব্য দিতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্টুনিস্ট কিশোরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। গত বছরের মে মাসে গ্রেপ্তারের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। এত পরে এমন অভিযোগ উঠলে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থাকে।
কিশোরকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের ওই দল কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, বলতে পারেননি তিনি। কক্ষটির একটা ছোটখাটো বর্ণনা দিয়েছেন কিশোর। ওখানে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটি এগজস্ট ফ্যান ছিল। ঘরটা স্যাঁতসেঁতে। মেঝে অমসৃণ। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল ভেতরে। কিশোরের ধারণা, কাছেই কোনো কক্ষে হয়তো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল কিশোর মেঝেতে শুয়ে পড়েন। অনেক রাতে তুলে তাঁকে নেওয়া হয় অন্য একটি কক্ষে। ওই ঘরেও ছিলেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের সবাই কার্টুনিস্ট কিশোরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করছিলেন। চেয়ারে বসিয়ে কেউ একজন ইংরেজিতে বলেন, পেছনে তাকালে জানে মেরে ফেলবেন। এরপর প্রজেক্টরে একটার পর একটা কার্টুন দেখিয়ে মর্মার্থ জানতে চাওয়া হয়। কিশোর একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলেন, টাকাপয়সা দিলে তিনি তাঁদের কার্টুন বোঝানোর কোর্স নিতে পারেন।
ঠিক কোন কার্টুন নিয়ে আপত্তি করেছিলেন তাঁরা—এমন প্রশ্নে কিশোর বলেন, ‘আমার সব কার্টুনই নাকি ব্যঙ্গাত্মক। ওই সময় আমি করোনা নিয়ে অনেক কার্টুন এঁকেছি। বেশ কিছু কার্টুন দেখিয়ে, এগুলো কেন আঁকা হয়েছে, কার্টুনের চরিত্রগুলো কারা, তা জানতে চায়। একপর্যায়ে প্রচণ্ড জোরে কানে থাপ্পড় দেয়। কিছুক্ষণের জন্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি, কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এরপর স্টিলের পাত বসানো লাঠি দিয়ে পায়ে পেটাতে থাকে তারা।’
আর কী জিজ্ঞাসা করেছিল অজ্ঞাতনামাদের দলটি? কিশোর বলেন, কার কার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, কেন যোগাযোগ। সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনীম খলিলের সঙ্গে তাঁর কীভাবে যোগাযোগ, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে কী করে চেনেন—এসব প্রশ্ন করেন। ব্লগারদের ওপর আবার হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কার কথা কেন আসিফ মহিউদ্দীনকে বলেছেন, জানতে চান তাঁরা। জবাবে কিশোর বলেছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল, কেউ তাঁকে অনুসরণ করে। তবে তাঁর কোনো জবাবই মনঃপূত হচ্ছিল না প্রশ্নকর্তাদের।
কিশোর বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের একটা অংশজুড়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। তিনি ওই ব্যবসায়ীকে কীভাবে চেনেন, কেন ওই ব্যক্তির কার্টুন এঁকেছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়।
কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর কিশোরকে র্যাবের কার্যালয়ে রেখে আসা হয়। ওখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় লেখক মুশতাক আহমেদের। মুশতাক আহমেদ তাঁকে বলেন, ‘মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন? আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি? বুক চিতিয়ে দাঁড়া। হাসি হাসি মুখে।’ বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল বলে মুশতাক জানিয়েছিলেন কিশোরকে। পরে ৬ মে সকালে রমনা থানায় সোপর্দ করা হয় কিশোর ও মুশতাককে। সেখানে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়ার।
নির্যাতন প্রসঙ্গে র্যাবের মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘পুলিশে হস্তান্তরের আগে যেকোনো অপরাধীকে ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। র্যাব সম্পূর্ণ বিধিবিধান মেনে আসামি হস্তান্তর করেছে। এত দিন পর কেন বলছেন? সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যেকোনো কিছুই বলতে পারেন।’
কিশোর জানান, তাঁদের প্রথমে কেরানীগঞ্জে কারাগারে রাখা হয়। পরে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর মুশতাককে হাই সিকিউরিটি ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়।
দুজনের শেষ দেখা হয় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির করার পর। জামিনটা পেলেই দুজন মিলে হিমালয়ের বেসক্যাম্পে বেড়াতে যাবেন, এমন পরিকল্পনা ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের নিয়ে বই লেখার কথা ছিল কিশোরের। মুশতাক আহমেদ–লিপা আক্তার এই নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানের মতো ছিলেন কিশোর। অথচ মুশতাকের মারা যাওয়ার খবরটাও পান ১২ ঘণ্টা পর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে খবরের কাগজ পড়ে। দুজনে একই হাতকড়ায় বাঁধা পড়েছিলেন একটা সময়, আশা ছিল একসঙ্গে মুক্ত হবেন। মুশতাক মারা গিয়ে চিরমুক্তি পেয়েছেন।
যদিও মুশতাকের এমন মুক্তি কল্পনাও করেননি কিশোর—এ কথা বলে আবার ডুকরে কেঁদে ওঠেন।