রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহার বাসায় নির্বাচনের দু’দিন আগে জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসীদের হামলা ও তার প্রাণনাশের চেষ্টায় দেশের প্রগতিশীল সমাজ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

দেশব্যাপী এইঘটনার প্রতিবাদে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দ,সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নেতৃবৃন্দ এবং ৭১’র ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির
নেতৃবৃন্দ এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই ঘটনা যেমন নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তার চেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সমাজের ওপর হুমকি হিসাবে বিবেচনায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, একের পর এক জামায়াত শিবির চক্রের হামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা আস্কারা পেয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে কোন দাবি না জানিয়ে তাঁরা দেশবাসীর কাছে এই ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।

রবিবার সভা-সমাবেশ এবং বিবৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেন। তাঁরা সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলার প্রতিকার করার জন্য রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

রবিবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাসান ইমাম, অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক আরআইএম আমিনুর রশীদ, আবদুল মান্নান চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ সামাদ. মাওলানা আবদুল আউয়াল, রামেন্দু মজুমদার, পান্না কায়সার, অহিদুজ্জামান চান, অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, হাসান আরিফ প্রমুখ।

অধ্যাপক আরআইএম আমিনুর রশীদ বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর একটার পর একটা হামলার ঘটনা ঘটছে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বিকার! একপেশে অবস্থান নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি দলের বস্প্ন বাস্তবায়নের জন্য সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন। সৈয়দ হাসান ইমাম বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতিপয় মামলা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাতে এটা সুস্পষ্ঠ করে দিয়েছে, বিশেষ দলের রাজনীতি করলে সন্ত্রাস করা জায়েজ বলে তাদের খালাস করে দিয়েছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে কোন দাবি বা আবেদন নেই। তাদের চেনা হয়ে গেছে মন্তব্য করে বলেন, বিচার চাই দেশবাসীরা কাছে। অধ্যাপিকা পান্না কায়সার প্রশ্ন করে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর একের পর এক আঘাত আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বিকার কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি বাংলাদেশকে রাজাকারের হাতে তুলে দিচ্ছে? যদি তাই হয় তাহলে জাতি তাদের ক্ষমা করবে কিনা সে কথা তারা কি ভেবে দেখেছে? অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রেরিত এক বিবৃতিতে এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশের এই সন্ধিক্ষণে দেশপ্রেমী সকল শান্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতা ও শান্তিবিরোধী এই হিংস্র চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

।বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতারা হচ্ছেন কবীর চৌধুরী, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমদ, কলিম শরাফী এএম হারুনঅর রশীদ,সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, সৈয়দ শামসুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, সেলিনা হোসেন, হায়াৎ মামুদ, মফিদুল হক প্রমুখ। বিভিন্ন পেশার বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে এই ঘটনাকে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরে পাকবাহিনীর হাতে বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় নিশ্চিত জেনে তারা ’৭১-এর মতো একই কায়দায় আক্রমণ শুরু করেছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন⎯ অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মোশারফ হোসেন, ফজলে হাসান আবেদ, রাশেদা কে চৌধুরী, খুশী কবির, শামসুল হুদা প্রমুখ। ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সভাপতি অধ্যাপক আরআইএম আমিনুর রশীদ এবং মহাসচিব ড. ইফতেখার উদ্দিন এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবির চক্র জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সারাদেশে যে হত্যা ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা তৈরি করেছে এ ঘৃণ্য ঘটনা তারই অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতিতে দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গণফোরাম, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, কমিউনিস্টকেন্দ্র, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্সপার্টি, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ পৃথক পৃথক বিবৃতিতে এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। জাতীয় সমন্বয় কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, প্রজন্ম ’৭১ এবং বাংলাদেশ সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ সমন্বয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাকে হত্যাচেষ্টার তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয়।

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, আমরা বহু পূর্বেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের হুমকিধমকি, হত্যাচেষ্টার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিল বলে আমাদের মনে হয় না। প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, আমরা মনে করি, এখনও সকল ভোটারের মতো সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও অত্যাচার বেড়েই চলেছে। তাঁরা বলেন, আমরা অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহার হামলাকারীদের চিনি। অবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এদের চিনিয়ে দিতে হবে বলে মনে করি না। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক আমিনুর রশিদ, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, মাওলানা আবদুল আউয়াল, অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, ড. মুহম্মদ সামাদ, অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান চান, প্রজন্ম ’৭১-এর হেদায়েত হোসেন প্রমুখ।

চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ ও নিন্দা চট্টগ্রাম অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও খ্যাতিমান রবীন্দ্রগবেষক সনৎ কুমার সাহার বাসভবনে সশস্ত্র হামলা ও প্রাণনাশের চেষ্টার খবরে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ গভীর উদ্বেগ, তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রবিবার এক যৌথ বিবৃতিতে ১৬ জুন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের বিশিষ্টজনের ওপর উপর্যুপরি হামলা ও হত্যা চেষ্টায় এই আশঙ্কাই জোরালো হচ্ছে যে, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পরাজিত শক্তি আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে।

বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ নারীনেত্রী উমরতুল ফজল, সাবেক উপাচার্য ড. আলমগীর শিরাজুদ্দিন, প্রবীন বিপ−বী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, ড. কামাল এ. খান, শহীদ জায়া মুশতারী শফী, অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল মনসুর, কবি আবুল মোমেন, এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত, নারীনেত্রী নুরজাহান খান, সাংবাদিক মুহাম্মদ ইদ্রিস প্রমুখ।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ অক্টোবর ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন