কোটালীপাড়ার রামশীল এখন এক স্পন্দনভূমি। আগৈলঝাড়া, গৌরনন্দী, উজিরপুর, নাজিরপুর থেকে আশ্রয় নেয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কান্নায় এই জনপদের আকাশ ভারি। নির্বাচনের আগে ও পরে অত্যাচার নিপীড়নে জর্জরিত এসব মানুষ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেই ভুলে গেছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । গৌরনদী থানার বাটাজোর ইউনিয়নের জৈশেরকাঠী গ্রামের গৃহবধূ দীপা সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য শিশুকন্যা, শ্বামীকে নিয়ে রামশীলে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শেফালী সরকারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে নির্বাচনের পরদিনই। একই থানার বাকাল ইউনিয়নের কোদালধোয়া গ্রামের করুণা রানী পাণ্ডের উপার্জনের একমাত্র ভরসা মুদি দোকানটি ভেঙ্গে চুরে খালে ফেলে দিয়ে তাকে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। করুণার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া মেয়েটি বাড়িঘর দেখছে। আগৈলঝাড়ার গৈলা ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন খানও প্রাণের ভয়ে এক কাপড়ে রামশীলে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার রামশীল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শচীন্দ্রনাথ মধু জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে ও পরে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছে এই ইউনিয়নের বিভিন্ন বাড়িতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডা. এস এ মালেকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার রামশীলে পৌঁছালে নির্যাতিত মানুষ কেঁদে কেঁদে জানিয়েছে তাদের কষ্টের কথা। এই প্রতিনিধি দলে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান, অধ্যাপক সামছুল হুদা হারুন, রাজিয়া মতিন চৌধুরী, অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ ও অধ্যাপিকা সেলিনা আখতার জাহান। রামশীল মূলত একটি বিল এলাকা। বিলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট বাড়ি। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম নৌকা। রাস্তায় আসতে হলেও নৌকার কোন বিকল্প নেই। কৃষিজীবী মানুষের অধিকাংশই গরিব। এই গরিব মানুষেরাই ত্রাতা হয়েছে নিকটবর্তী এলাকা থেকে আসা দুঃখী মানুষের। রামশীলের চারদিক ঘিরে আছে আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, কালকিনী থানা। অনতিদূরেই উজিরপুর। নির্বাচনের আগ থেকেই এসব এলাকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর চারদলীয় জোটকর্মীদের অত্যাচার নিপীড়ন কয়েকগুন বেড়ে যায়। খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, চাঁদাবাজিসহ হেন নির্যাতন নেই যা সংখ্যালঘু নারী-পুরুষের ওপর চালানো হয়নি। জীবন রক্ষায়, সম্ভ্রম বাঁচাতে অসহায় নারী-পুরুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে রামশীলে। এখানে অনেকের আত্মীয়স্বজন আছে। অনেককে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে এখানকার মানুষ। আশ্রিত মানুষের দুঃখ-কষ্টের নানা কথা দীর্ঘক্ষন ধরে শুনেছেন ডা.এসএ মালেক। তিনি এসব বিপন্ন মানুষকে সান্তনা দিয়েছেন, তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। আগৈলঝাড়া থানার রাজিহার ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের বিমল চন্দ্র মধু নির্বাচনের পর ৩/৪ দিন নৌকায় পালিয়ে এলাকায় ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, জীবন বাঁচাতে তাঁকে রামশীল ইউনিয়নের জহরের কান্দি গ্রামে এসে ভগ্নিপতির বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। বিমল জানায়, নির্বাচনের দিন রাত ১২টার পরেই তাঁর বাড়ি ও দোকানে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। তিনি নৌকায় করে পালিয়ে গিয়ে বিলে আশ্রয় নেন, কিন্তু তাঁকে না পেয়ে ছেলেমেয়েদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে চলে আসেন। রাজেশ্বর ঘরামীর বাহাদুরপুর গ্রামে চারদিক থেকে বোমাবর্ষণ করতে করতে চারদলীয় জোটের কর্মীরা হামলা চালায় নির্বাচনের ঠিক পরের দিন। সুনীল ডাক্তার, অনীল মাস্টারের ঘরে হামলা চালিয়ে টেলিভিশন, টাকা পয়সা সব নিয়ে যায়। রাজেশ্বর জানান, তাঁদের বাড়িঘরও লুটপাট করা হবে শুনে তিনি পালিয়ে এসেছেন। বাহাদুরপুর বাজারের সব দোকানে চাঁদাবাজি হয়েছে। এমনকি চাঁদার হাত থেকে পান দোকানিও রক্ষা পায়নি। এই চাঁদা নিয়ে দুর্বৃত্তরা পিকনিক করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য শেফালী সরকার বলেন, ‘নির্বাচনের রাতে স্থানীয় স্কুলে বসে আমরা টিভি দেখছিলাম। ভোর রাতে বাড়ি ফেরার সময় কাজলহাটে দুর্বৃত্তরা আমার ওপর হামলা চালায়। ২০/২৫ জনের কেউ কেউ বুকে পিস্তল ঠেকায়, কেউ কেউ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে দুর্বৃত্তরা এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তাঁরা বলে, গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের আমলে অনেক টাকা কামাই করেছিস। জীবন বাঁচাতে চাইলে চাঁদা দিতে হবে। আমি চার অক্টোবর কিছু টাকা দেয়ার অঙ্গীকার করি, কিন্তু পরদিনেই আমার বাড়িতে আবার হামলা করে। এ সময় জলের ভিতর দিয়ে সাঁতরিয়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই। শেষ পর্যন্ত গোপনে প্রাণ বাঁচাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে রামশীলে চলে আসি’। শেফালী বলেন, তাঁর গ্রামে কমপক্ষে ১০/১২টি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাণের ভয়ে মুখ ফুটে কেউ প্রকাশ করছে না। এদিকে বিপন্ন মানুষদের আশ্রয়দাতারাও এখন আর পেরে উঠছেন না। মুশুরিয়া গ্রামের অমল চন্দ্র সরকার বলেন, আগৈলঝাড়ার মাগুড়া গ্রাম থেকে আমার শালা, শালী ও বাহাদুরপুর গ্রাম থেকে পিসতুতো ভাইবোনেরা পালিয়ে এসেছে। আমার মত মানুষের পক্ষে এদের খাবারদাবারের যোগান দেয়া খুবই কষ্টকর। রামশীলের অনেক মানুষের বক্তব্যই এরকম। রামশীল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শচীন্দ্রনাথ মধু জানান, অক্টোবরের ২,৩,৪,৫,৬ তারিখ পর্যন্ত আগৈলঝাড়া, গৌরনদী উপজেলার নির্যাতিত মানুষ এখানে এসেছেন। তাঁরা মুশুরিয়া, শৈলদহ, পাথরের বাড়ি, রামশীল,খাগবাড়ি, রাজাপুর, জহরেরকান্দি কাফুলাবাড়ি, কবরবাড়ি প্রভৃতি গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যতটুকু পারি এসব অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করছি। তবে সরকার তথা প্রশাসন থেকে এখনও কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি, বরং প্রশাসনের লোকজন এখানে এসে হুমকি দিয়ে গেছে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য। বলা হয়েছে, নাহলে গ্রেফতার করা হবে। এই হুমকিতে মানুষ আরও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। বয়োবৃদ্ধ এই চেয়ারম্যান বলেন,’৪৮-এর পর থেকে এরকম নির্যাতন আর হয়নি। শুধু নৌকায় ভোট দেয়ার কারণেই এই অত্যাচার চালানো হচ্ছে। রামশীলের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন সাদুল্লাপুরের চেয়ারম্যান লালমোহন বিশ্বাস কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, আমরা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নই। আমাদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা’৭১কেও হার মানিয়েছে। তিনি বলেন,বহু নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু এরকম ভয়াবহ রূপ কোনদিন দেখিনি। আপনাদের কাছে এর প্রতিকার চাই। রামশীল ইউনিয়ন পরিষদের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ডা. এস এ মালেক বলেন, দু’জন চিহ্নিত রাজাকারকে মন্ত্রী বানানো হয়েছে। মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সরকার গঠন করেছে। তিনি বলেন,আমরা পরাজিত হইনি, আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার ৩১ বছর পর আমাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। ডা. মালেক এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
দৈনিক জনকন্ঠ, ১৮ অক্টোবর ২০০১