নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ছোঁয়া না লাগলেও আতংক ছড়িয়ে পড়েছে উজিরপুরের বিলাঞ্চলে। পাশের দুটি উপজেলার প্রায় হাজারখানেক লোক এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। খোলা হয়েছিল আশ্রয়কেন্দ্র। কিন্তু প্রশাসনের চাপে সে আশ্রয় কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ দুটি উপজেলার সংখ্যালঘুদের মতো তারাও যেন একই অবস্থার সম্মুখীন না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। জল্লা ইউপির কয়েকটি গ্রামের সংখ্যালঘুরা সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করতে গড়ে তুলেছে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তবে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এসব গ্রামের মানুষেরা একরকম বন্দী জীবন যাপন করছে। তারা গ্রাম থেকে বেরুলে নানা হুমকি ধমকির সম্মুখীন হয়। তাদের অভিযুক্ত করা হয় তারা আওয়ামী লীগের লোক। সরেজমিন এসব গ্রাম ঘুরে এ তথ ̈ মিলেছে। বিভাগীয় সদর বরিশাল থেকে উজিরপুরের জল্লা ইউনিয়ন প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। ধামুরার পর কিছুদূর পর্যন্ত পীচ ঢালা পথ। তারপর কয়েক কিলোমিটার মাটির পথ বিলের মধ্যে দিয়ে। এখানকার মানুষ অভাবী। প্রায় সারা বছর পানিতে ডুবে থাকে এখানকার বেশীরভাগ জমি। বছরে মাত্র একটি ধান হয়। আয়ের উৎসর একটি হচ্ছে বিলের জিয়ল মাছ। নৌকা ছাড়া এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে যাওয়া অসম্ভব প্রায়। মুন্সীর তালুক, কুড়ালিয়া, জুনীরপাড়, কারফাসহ এ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এক সংখ্যালঘু ইউপি সদস্যর সাথে আমাদের দেখা হয় কারফা বাজারে। নীরিহ গোবেচারা টাইপের মানুষ। এতোই শঙ্কিত যে বাজারে বসেও কথা বলতে সাহস পান না। তার ভয় পত্রিকার লোকদের সাথে কথা বললে তাকে আরো বেশি হেনস্তা করা হবে। তিনি বারবার আমাদের অনুরোধ করেছেন তার নাম না ছাপতে। তিনি আমাদের কাছে অভিযোগ করলেন, নির্বাচনের পর থেকে এখানকার সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির সন্ত্রাসীদের দাপটে বাড়ী উঠতে পারছেন না। জল্লা গ্রামের বাসিন্দা এই ইউপি সদস্যর অপরাধ নির্বাচনের দিন সংখ্যালঘুদের ভোট দিতে বাধা দেয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি এখন এলাকাছাড়া। কারফা বাজার থেকে আরো ভেতরে যতো অজপাড়া পড়ে সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আধিক্য বেশি। কারফা বাজার ও গ্রামে প্রবেশের একটি মাত্র পথ। বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাদল কৃষ্ণ বিশ্বাস আমাদের জানালেন, নির্বাচনের পর থেকে এলাকায় যেন কোন সন্ত্রাসী বাহিনী ঢুকে অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য তারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। তারা একটি কমিটি করেছেন। প্রতি রাতে ১১/১২ জনের একটি টিম সারারাত পাহারা দেয়। তাদের এ পাহারা দেয়া শুরু হয়েছে নির্বাচনের পরের দিন থেকে। কারফা বাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে জল্লার কুড়ালিয়া গ্রামে পৌছানো গেল। উজিরপুর, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া উপজেলার হাজারখানেক সংখ্যালঘু শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল কুলাউড়া ও এর আশেপাশের গ্রামে তাদের পরিচিত ও আত্মীয় পরিজনের বাড়ীতে। এখানে সম্প্রীতি নামের একটি বেসরকারি সাহায্যে সংস্থা রয়েছে। সেখানে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এদের একটি বড় অংশ আশ্রয় কেন্দ্রে খাওয়া দাওয়া করতো। এখানে আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও যুবক। এখানে এ মানুষদের খাওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শরফুদ্দিন সান্টু। এই আশ্রয়কেন্দ্রটি যোগাযোগ দুর্গমতার কারণে প্রচার মাধ্যম বা মানবাধিকার কর্মীদের নজরে আসেনি। অনেক দেরীতে এ আশ্রয়কেন্দ্রটির খবর আমাদের কাছে আসে। এ আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করতো জল্লা ইউপি সদস্য অনন্ত কুমার রায়। তিনি আমাদের জানান, প্রতিবেলায় এ আশয়কেন্দ্রে সাড়ে চারশ’ পর্যন্ত খেয়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রের নামে রটানো হয় এখানে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ রটনার সূত্র ধরে উজিরপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তা মাওলা এখানে আসেন। তিনি এখানে আশ্রয় কেন্দ্রে বক্তৃতাও করেন। বিভিন্নমুখী চাপের কারণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন আশ্রয়কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবীরা। ১৭ অক্টোবর এখানকার আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়। আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ হলেও বহু পরিবার এখানে রয়ে গেছেন। অনেকে আতংকে বিলের আরো ভেতরের দিকে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানকার সাধারণ মানুষও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাতে পাহারা দিচ্ছে। বিলাঞ্চলের গ্রামগুলো এক রকম বন্দীদশার মধ্যে রয়েছে। তারা বাইরে বেরুতে সাহস করে না। কুড়ালিয়া গ্রামের অনেকেই অভিযোগ করলেন তারা হাটে বাজারে গেলে বিভিন্নভাবে কটুক্তি করে। মারধোর করার ঘটনাও কম নয়। কয়েকদিন আগে এক মাছ ব্যবসায়ীকে বাজার থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ২২ অক্টোবর ২০০১