প্রমত্তা মেঘনার ভাঙনে পৈতৃক ঘরবাড়ি হারিয়ে ক্ষুদিরামরা তিন ভাই ভোলা জেলার দৌলতখান থেকে চরফ্যাশন এলাকায় এসে ডেরা বেঁধেছিলেন। সেটা ১৯৮৫ সালে। ভাইদের মধ্যে ছোট হলেও ক্ষুদিরামকেই পরিবারের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিলো। তিনি রিকশাভ্যান বানানো শিখে চরফ্যাশন বাজারে ছোট্ট একটা কারখানা গড়ে তোলেন। থাকতেন কাছেই প্রগতিপাড়ায়। গত ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দুদিন পর রাসেল, গিয়াস ও সুলতান নামে তিনজন আরো কিছু লোক নিয়ে এসে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করলে ভীতসন্ত্রস্ত্র ক্ষুদিরাম কয়েকদিন কারখানা বন্ধ রাখেন। বাজার কমিটির আশ্বাসে ৯ অক্টোবর কারখানা খোলেন। ওইদিনই সন্ধ্যাবেলায় তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। চরফ্যাশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ অক্টোবর তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিলো ৪৫ বছর। প্রিয়বালার ছেলে সুধীর দাসকে নির্বাচনের আগে থেকেই হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছিলো। তিনি চরফ্যাশনের দাসকান্দির পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে সে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সে সুযোগ তার হয় না। গত ৫ অক্টোবর রাতে কয়েক লুটেরা সুধীরকে খুঁজতে এসে তাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধা মা প্রিয়বালার মুখে বিছানার চাদর গুজে দিয়ে বাড়িতে লুটপাট করে। এসব লুটেরা সুধীরের স্ত্রী আলো রানীর পরনের শাড়ি পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। প্রিয়বালা সেই যে জ্ঞান হারান, আর জ্ঞান ফেরেনি তার। এ ঘটনার তিন দিন পরে তিনি মারা যান। ঘটনা দুটির প্রথমটিতে জড়িত হিসেবে রাসেল, গিয়াস ও সুলতান নামে যে তিনজনের কথা জানা গেছে তাদের প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষভাবে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। চরফ্যাশন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রুহুল কুদ্দুস বলেন, ওরা দলের সাধারণ সমর্থক মাত্র। দলের সমর্থক হলেও বিএনপি চায় তারা যে অন্যায় করেছে তার বিচার হোক। তবে বিএনপি নেতা এ কথা বললেও সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা ক্ষুদিরামের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আর প্রিয়বালার মৃত্যুতে চরফ্যাশন থানায় ‘অপরাধজনিত নরহত্যার একটি মামলা দায়ের করা হলেও এ পর্যন্ত কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা পুলিশ জানতে পারেনি। প্রিয়বালার মুখে বিছানার চাদর গুজে দেয়া হয়েছিলো⎯ এ তথ্যকে পুলিশ গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না। গত শুক্রবার ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় এ প্রতিনিধিদ্বয়ের উপস্থিতিতে চরফ্যাশন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রহমান তার কক্ষে প্রিয়বালার ছেলে সুধীরকে বারবার বলছিলেন, তিনি তদন্ত করে জেনেছেন মুখে কাপড় গুজে দেয়ার ঘটনা সত্য নয়। ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী সুধীর অবশ্য নিজের অবস্থান থেকে একটুও সরে যাননি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ঘটনার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত না থাকলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জেনেছেন তার মায়ের মুখে কাপড় ̧গুজে দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে রাখা হয়েছিলো। তবে হামলাকারীদের কাউকে তার স্ত্রী চিনতে পারেনি বলে তিনি জানান। পরদিন সকালে দাসকান্দি গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে সুধীরের স্ত্রী আলো রানী ‘প্রথম আলো’কে জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর যখন তিনি রান্নাবান্নার যোগাড় করছিলেন, তখন তিনি কয়েকজন লোকের আওয়াজ পান। তার স্বামীর সঙ্গেই কেউ না কেউ এসেছে মনে করে উঠে গিয়ে তাকিয়ে উঠানে অচেনা অনেক লোক দেখে পালানোর জন্য দৌড় দিলে কয়েকজন তার দিকে দৌড়ে আসে এবং তিনি ধরা পড়েন। আক্রমণকারীরা তাকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। তিনি তাদের শান্ত করার জন্য নিজের নাক থেকে স্বর্ণের নোলক এবং গীতার ভেতরে রাখা ৪০০ টাকা বের করে দেন। তারপরেও আক্রমণকারীরা আরো টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে জানানোর জন্য জোর করতে থাকলে তিনি পালানোর চেষ্টা করলে ওরা তার শাড়ি খুলে নেয়। এই ভয়াবহ ঘটনার পর আলো রানী যে বাড়িতে আশ্রয় নেন, সেই বাড়ির গৃহস্বামী দাসকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রহিম জানান, আলো রানী তাদের বাড়িতে এসে তার স্ত্রীকে ডাকলে তিনি দরজা খুলে বের হতে উদ্যত হন। এ সময় আলো রানী তাকে বের হতে নিষেধ করে তার স্ত্রীর কাছে একটা শাড়ি চান। পরে তারা আলো রানীর বাড়িতে গিয়ে প্রিবালাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পান। প্রিয়বালার মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে⎯ এ সম্পর্কে চরফ্যাশন উপজেলা হাসপাতালের কর্মকর্তা ডা. আবদুর রশীদের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলার উপায় নেই। যেহেতু ঘটনার পরপরই তার মৃত্যু হয়নি তাই শ্বাস বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন, এমন বলা যাবে না। তবে এ ঘটনায় ভীতসন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ার কারণেই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করা না হলেও ডা. রশীদ প্রিয়বালাকে দেখতে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডা. রশীদ প্রতিদিনই ক্ষুদিরামকে দেখেছেন। তিনি জানান, ক্ষুদিরাম সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই আঘাতের সঙ্গে তার মৃত্যুকে যুক্ত করে ভাবা ঠিক হবে না। তিনি অবশ্য ক্ষুদিরামের হৃদরোগও ছিল না বলে জানান। লোকমুখে হাসপাতালে ক্ষুদিরামকে বারবার হুমকি দেয়ার কথা জানা গেলেও ডা. রশীদ এবং হাসপাতালের অন্য ডাক্তার ও নার্সরা এ ঘটনা তদের জানা নেই বলে জানান। ক্ষুদিরামের স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যারাও বলেন, এমন অভিযোগ সম্পর্কে তারা অবগত নন। এসব কথা বলার সময় তাদের খুব ভীতসন্ত্রস্ত্র দেখাচ্ছিলো। ক্ষুদিরাম এবং প্রিয়বালার মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক, পুলিশ হামলা, লুট ও অত্যাচারের ঘটনায় অপরাধীদের কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। ক্ষুদিরামের দুই ছেলেমেয়ের বড় নবম শ্রেণীর ছাত্রী পলি রায় বলে, বাবাকে কারা মারছে আমরা দেখি নাই। তবে হাটের হাজার হাজার লোক দেখেছে। তাদের বিচার হবে কিনা, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। আমাদের ভাবনা কেমন করে বেঁচে থাকবো। চরফ্যাশন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রিয়বালার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং ক্ষুদিরামের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছি। ক্ষুদিরামের কারখানাটি যেন দ্রুত খুলে দেয়া যায় সে চেষ্টা আমরা করবো এবং প্রশাসনের বাইরে থেকেও এ কাজটি আমরা করতে পারবো। চরফ্যাশন থানার ওসি বজলুর রহমান জানান, পুলিশ অভিযুক্তদের চিহ্নিতকরণ ও গ্রেপ্তারের জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো, ২৩ অক্টোবর ২০০১