গোপালগঞ্জ জেলার পুরোটাই যেন একটা আশ্রয়কেন্দ্র। এ জেলার পার্শ্ববর্তী ৫ জেলার ১১টি উপজেলার কমপক্ষে ১৫ হাজার সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ নিজ বাড়িঘর ত্যাগ করে গোপালগঞ্জ জেলাকে অধিকতর নিরাপদ মনে করে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মারধর, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চাঁদা দাবি, জীবননাশের ভয়ভীতিসহ নানা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে এসব লোক নিজ বাড়িঘর ত্যাগ করে গোপালগঞ্জে চলে আসেন। ফেলে আসেন নিজ সহায়সম্পত্তিবরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, উজিরপুর, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার ১০/১৫টি গ্রামের হাজার হাজার সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ, কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল, শুয়াগ্রাম, বান্ধাবাড়ি, সাদুল্লাপুর, ফলাবাড়ি প্রভৃতি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে, বাগেরহাট উপজেলার মোল্লারহাট, চিতলমারি, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ ও বাগেরহাট সদরের নির্যাতিত লোকজন, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া, গোপালপুর, পাটগাতি, বর্ণি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বোড়াশী, গোবরা, রঘুনাথপুর, বৌলতলি, সাহাপুর, সাতপাড় উরফি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া নড়াইল জেলা থেকে নির্যাতিত নারী-পুরুষ কাশীয়ানি উপজেলার পিংগলিয়া ও পোনাগ্রামসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামে এবং ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার নির্যাতিত নারী পুরুষ মুকসুদপুর উপজেলার ভটিকামারি, বাহারা, গোলাবাড়ীয়া, বনগ্রাম, নৈহাটা, মহারাজপুর, কৃষ্ণদিয়া, পসারগাতি প্রভৃতি গ্রামে হাজার হাজার লোক আত্বীয়স্বজনের বাড়িতে বর্তমানে আশ্রিত রয়েছেন। বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টায় গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ববৃন্দ এসব তথ্য প্রদান করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন, ৪-দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের প্রাক্কালে সংখ্যালঘুদের ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি প্রদান ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ কর্মীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয় এবং এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নীলনক্সার মাধ্যমে চারদলীয় জোটকে বিজয়ী করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের শেষ পর্বে পুর্বনির্ধারিত ফলাফল ঘোষনা করতে থাকলে চারদলীয় জোটের বিজয় হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সারা দেশে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে। শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক, ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্য সব তৎপরতা। তাদের ব্যাপক সন্ত্রাসী তৎপরতার মধ্যে টিকতে না পেরে সংখ্যালঘুরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। নেতৃত্ববৃন্দ অভিযোগ করেন, এখনও প্রতিদিন এসব নির্যাতিত নারী পুরুষ আশ্রয় নিতে এ জেলায় আসছেন। এদিকে সংখ্যালঘুরা দীর্ঘদিন আত্মিয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নিজেরাও হাঁপিয়ে উঠেছেন। বাড়িঘর ছেড়ে গবাদিপশু ও অন্য মালামাল ফেলে আসায় সারাক্ষণ এসব লোকজন রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। কখনও এলাকায় ফিরে যেতে পারলেও ফেলে আসা ঘরবাড়ি, মালামাল ফিরে পাবেন কিনা তা নিয়ে নতুন সংশয় দেখা দিয়েছে। বাড়িতে ফিরে যেতে পারলেও ফিরে গিয়ে তাদের এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। এতোদিনের গোছানো ঘরবাড়ি আবার নতুন করে সাজাতে হবে। যদিও এখনও তাদের মন থেকে ভয়ভীতি কাটেনি। অন্যদিকে জেলা তথ্য অফিসার এস এম মনছুর আহম্মেদ জানান, রামশীলে আশ্রয়গ্রহণকারীদের অভয় দিয়ে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাঁদের আজ শুক্রবার সকাল ১০ টায় নিরাপদে পয়সারহাট পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে বরিশালের জেলা প্রশাসক তাদের নিরাপদে যাঁর যাঁর বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এ সময় উভয় জেলার উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে। কিন্তুু আগৈলঝাড়ার বসুণ্ডা গ্রামের সুশান্ত হালদার (৩০), কোদালধোয়া গ্রামের যোসেফ হালদার (২২), গৌরনদীর ধড়িয়াল গ্রামের তপন ঢালি (৩৫), জয়শীলকাঠী গ্রামের নগেন মজুমদার (৩৫) জানান, তাঁরা পুলিশের সাথে বাড়ি ফিরে যাবে না। কেননা বাড়ি ফিরে যাবার পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয়নি। তাঁরা এ মুহূর্তে দেশ ত্যাগের চিন্তাভাবনা করছেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১২ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন