‘আমাদের মন্দিরে আগুন দিয়েছে, প্রতিমা ভেঙেছে, হুমকি আসছে নানা ধরণের, মন্দির হয়তো আবার মেরামত করবো, প্রতিমাও আবার বানাতে পারবো, কিন্তু আমাদের মনের যে মন্দির ভেঙেছে তা কি কখনো নতুন করে বানিয়ে দিতে পারবে কেউ?’ এরকম করুণ-খেদোক্তি ঝরে পড়লো চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার নাহেরপুর গ্রামের মিলন চন্দ্র ভৌমিকের মুখে। একই এলাকার মহেন্দ্র দফাদার জানান, সার্বজনীন কালীবাড়ির কালীমূর্তি ভাঙ্গার কারণে এই কার্তিক মাসে যে কালী পূজা হওয়ার কথা তা আর করবে না কেউ। সবার একই কথা⎯ বার বার আমাদের ওপর হামলা করা হবে, মারধর করা হবে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে, মন্দির ভাঙা হবে, আবার আড়ম্বর করে পূজা করতে বলা হবে, তা হতে পারে না। আর কতোদিন নির্যাতিত হব আমরা? নির্যাতনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার প্রসঙ্গে এলাকার লোকজন বলেন, ‘ওরা তো সবই জানে, দেখেও গেছে আ ̧ন লাগার পর। তারা নিজেরা মামলা করতে পারে না, আমরা কেন মামলা করে আবার নতুন করে হামলার শিকার হবো?’ সংখ্যালঘুরা অভিমানভরা কন্ঠে বলেন, হয় সরকার তাদের পূর্ণনিরাপত্তা দিক, না হলে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিক। গত শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সীতাকুণ্ড থানা এলাকার বিভিন্ন নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনসাধারণের সাথে কথা বলে শুধু দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে। তবে সীতাকুণ্ডের চেয়ে মীরসরাইয়ের পরিস্থিতি বেশী খারাপ। নির্বাচনের আগে থেকেই শুরু হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নানাভাবে, নির্যাতন, হুমকি, অত্যাচার, চাঁদাবাজি। নির্বাচনের পর তা আরো কয়েকগুন বেড়ে গেছে। কিন্তু কেউ মামলা তো দুরের কথা থানা-পুলিশ এমনকি সাংবাদিকসহ অন্য কাউকে জানাতে সাহস পাচ্ছে না । মীরসরাই থানা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ধুম ইউনিয়নের নাহেরপুর গ্রাম। এখানে কৃষ্ণ ভূঁইয়ার বাড়িতেই রয়েছে দীনদয়াল আশ্রম ও মন্দির। অন্যবারের মতো এবারো যথারীতি দুর্গাপূজার জন্য এই মন্দিরে প্রতিমা বানানো হচ্ছিল। সবার মনে আশা ছিল দুর্গাপূজা করবেন নিজেদের ও দেশ জাতির মঙ্গলের জন্য । কিন্তু নির্বাচনের মাত্র পাঁচদিনের মাথায় গত ৫ অক্টোবর রাতে আনুমানিক রাত ১টার দিকে কাঠ ও টিনের নির্মিত এই মন্দিরে দুর্বৃত্তরা কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় ও নির্মাণাধীন প্রতিমা ভাংচুর করে পালিয়ে যায়। ধুমঘাট এলাকার বিসিক শিল্পনগরীতে কাজ করেন এবং এই বাড়ির বাসিন্দা মিলন চন্দ্র ভৌমিক বলেন, রাতে হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে দেখি আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে অন ̈দেরকে চিৎকার করে ডাক দেই আগুন নেভানোর জন্য । যখন দেখলাম মন্দির আর বাঁচানো যাবে না তখন তাড়াতড়ি প্রতিমা কোনভাবে বের করে আনি। পরে প্রতিমা বের করে দেখি বেশ কিছু প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর দিন থানার ওসি, টিএনও ও স্থানীয় বিএনপি নেতা মতিন চৌধুরী এসেছিলেন। তারা সান্তনা দিয়ে গেছেন শুধু। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি মতিন চৌধুরী পূজা করতে বলেছেন ধুমধাম করে। যে কোন মূল্যে যাতে পূজা হয়, সেজন্য চাপ দিচ্ছে বিএনপি ও প্রশাসন। তবে পূজার্থীরা জানালেন, এবার দুর্গাপূজা করার কোন মন-মানসিকতা নেই তাদের। তারপরও হয়তো করার চেষ্টা করবেন তারা বিভিন্ন কারণে। এই আশ্রম থেকে মাত্র ৫০০গজ দুরেই নাহেরপুর মহেন্দ্র দফাদারের সার্বজনীন কালী বাড়ি। প্রায় ৭০ বছরের বেশী পুরানো এই কালী মন্দির। প্রতি বছর কার্তিক মাসে এখানকার হিন্দু সম্প্রদায় ধুমধাম করে কালীপূজা করেন। এই পাড়ায় প্রায় ১৫০টি হিন্দু পরিবারের বাস। নির্বাচনের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে কে বা কারা মন্দিরের বেড়া ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে কালীমূর্তি ও শিবের মূর্তি ভেঙে ফেলেছে। কালী ও মহাদেবের হাত-পা এখন মন্দিরের ভেতর গড়াগড়ি খাচ্ছে। শুক্রবার বিকালে এই কালীমন্দিরের সামনে কথা হয় ̄স্থানীয় কয়েকজন অধিবাসীর সঙ্গে কিন্তু সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। কে বা কারা মূর্তি ভাঙতে পারে তা তারা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারলেও মুখে কুলুপ এটে আছেন প্রাণভয়ে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা থানার পুলিশ কেউ আসেনি বলে জানা গেলো। এদিকে গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে মীরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের রমণীমোহন মালাকারের ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, ঘরের চারদিকে কেরোসিন দিয়েই আগুন দেওয়া হয়েছে যাতে ঘর থেকে কেউ বের হতে বা আগুন নেভাতে না পারে। এ সময় বাড়ীতে শুধু মহিলা আর শিশুরা ছিল। পুরুষ লোকজন না থাকায় আগুন নেভাতেও তেমন কেউ সাহায্য করতে পারেনি। মীরসরাইয়ের হিঙ্গুলি ইউনিয়নের আজমনগর গ্রামের বণিকপাড়ায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলেকে (পলাশ বণিক) বিএনপি নামধারী সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। তারা দুই লাখ টাকা চাঁদাও দাবি করে তাদের কাছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে পলাশ বণিক প্রায় ১৫ দিন ধরে নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিল। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে হিঙ্গুলি ইউনিয়ন কার্যলয়ের বিপরীতে বেশ কয়েকটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। রয়েছে সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মাধ্যম সোনাপাহাড় এলাকাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই। এখানে শ্যামল চন্দ্র দাশের বাড়ি। তাকে নির্বাচনের দিন রাতেই হুমকি দিয়েছে বিএনপির সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে গিয়ে। তার বড় ভাই ও বৌদির কাছে সন্ত্রাসীরা এই বলে হুমকি দিয়েছে যে, শ্যামলের হাত-পা কেটে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া হবে। তার অপরাধ সে নৌকার সমর্থক ও কর্মী ছিল। সেই থেকে অদ্যাবধি পলাতক রয়েছে শ্যামল। পশ্চিম হিঙ্গুলি গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতেও নির্বাচনের পর ভাংচুর ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বারতাকিয়া বাজারের উত্তম বণিকের কাছে সন্ত্রাসীরা ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে হুমকি দিয়েছে যে, না দিলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। একই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের চৌধুরীরহাট বাজার সংলগ্ন নির্মল সিংহের ঘরে লুটপাট করেছে সন্ত্রাসীরা। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১৫০ গজ দুরে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের বিষয়টি জানালেও তারা তাতে কোন কর্ণপাত করেনি বলে অভিযোগ করেছেন মীরসরাই উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সভাপতি ও স্কুল শিক্ষক অরুণ পাল। সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়নের বাঁকখালী জেলেপাড়ায় প্রায় ১২৫টি হিন্দু পরিবারের বাস। গত ৬ অক্টোবর রাতে বীরেন্দ্র জলদাস, হরিধন জলদাস, কালিচরণ জলদাস, চাতকী জলদাস ও অরণ্য জলদাসের বাড়িতে ২০/২৫ জনের ডাকাতদল নির্যাতন চালিয়েছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। প্রায় ১০ লাখ টাকার মাল লুট করে নিয়ে গেছে তারা। এমনকি এসব ঘর থেকে বিছানা, কম্বল পর্যন্ত নিয়ে গেছে লুটেরার দল। স্থানীয় থানা পুলিশ ও ইউএনও গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। একই এলাকার ষাটোর্ধ্ব ননী গোপাল চক্রবর্তী আজীবন ধুতি পরে কাটিয়েছেন। কিন্তু এখন এই হুমকির কারণে তিনি ধুতি না পরে প্যাঁন্ট পরতে বাধ্য হচ্ছেন। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি এ প্রতিবেদককে অশ্রুসজল চোখে জানালেন ‘৯০ এবং ‘৯২ সালেও এ ধরনের হামলার শিকার হইনি। কিন্তু এবার আর নিরাপদ নই আমরা। এই এলাকার কোন বাড়িতেই গত ১৫ দিন ধরে তরুণী ও মহিলারা নেই। অন্য এলাকায় পালিয়ে গেছেন তারা মানসম্মান ও জীবন রক্ষার্থে। পুরুষ যারা আছেন তারা এখন প্রতি রাতেই পাহারা দিচ্ছেন এলাকা। মীরসরাই ও সীতাকুণ্ডের প্রতিটি হিন্দু এলাকাতে এখন আতঙ্ক আর শঙ্কা। আবার বুঝি হামলা হয়। সবার চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক, বিষন্নতা আর দোদুল্যমানতা। বলেছেন যে হামলা হচ্ছে কিন্তু মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ। মীরসরাইয়ের চৈতন্যহাটের সুললিত বিশ্বাসের ( স্কুল শিক্ষক) কাছে ‘তালেবান বাহিনী’ নামে ২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তুমি ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়েছো, এখন আমাদের বাহিনী গড়ার জন্য ২লাখ টাকা দিবে। না হলে তোমার জীবন শেষ হবে।’
ভোরের কাগজ, ২২ অক্টোবর ২০০১