বাতাসে দেবী দুর্গার আগমনী সুর। মহালয়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। পূজা শুরু হবে ২২ অক্টোবর থেকে, কিন্তু পূজাকে ঘিরে অন্যান্য বছরের মতো উৎসাহ উদ্দীপনা চোখে পড়ছেনা। ফি বছর এ সময় শহর-গঞ্জের বাজারে উপচে পড়া ভিড় থাকে। বিশেষ করে তৈরি পোষাক, শাড়ি কাপড়, প্রসাধন সামগ্রী, আর দর্জির দোকানে এ সময় বাড়তি খরিদ্দারের চাপ সামাল দিতে অতিরিক্ত কর্মচারী-সেলসম্যান নিয়োগ করতে হয়। দর্জির দোকান গুলো পূজারবেশ আগে থেকেই অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দেয়; কিন্তু এ বছর তেমন কেনাকাটার ভিড় দেখা যাচ্ছে না। অথচ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী এ জেলার অধিকাংশ হিন্দু পরিবারের ছেলেমেয়ে, গৃহবধূরা প্রতিবছর পূজার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। এ সময় প্রায় প্রতিটি পরিবারই সামর্থ অনুযায়ী সকলের জন্য নতুন কাপড় কেনে। শহরের কোন কোন মুসলিম পরিবারের শিশুর বায়না মেটাতে বাবা-মাকে কিনতে হয় নতুন পোষাক। কারণ ওই শিশুর হিন্দু বন্ধুরা পূজায় নতুন কাপড় পরবে, তাই তারাও নতুন পোষাক পরেই বন্ধুদের সাথে পূজা দেখবে। দোকানিরা পূজা উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ আইটেম আমদানি করে বসে আছেন খরিদ্দারের আশায়; কিন্তু খরিদ্দারের দেখা নেই। ‘বস টেইলার্স’-এর মালিক আমিরুল ইসলাম জানালেন, অন্যান্য বছর তারা অন্তত পূজার এক সপ্তাহ আগেই অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দেন; কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত তাদের অর্ডার মিলেছে সামান্যই। একটি অভিজাত বস্ত্র বিপণির সেলসম্যান অলোক রায় ‘সংবাদ’কে বলেন, অন্যান্য বছর এ সময় রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে; কিন্তু এখন খরিদ্দারের অভাবে রাত ৯টার মধ্যে দোকান বন্ধ হয়ে যায় । সারাদিনের বিকিকিনির পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের মতো। বিভিন্ন গঞ্জের হাটের কাপড় বিক্রেতা বিধান সাহা জানালেন, নির্বাচনী ডামাডোলে গত কয়েক সপ্তাহ ব্যবসা একদম মন্দা গেছে। আশা করেছিলেন পূজার বাজারে ব্যবসা করে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন; কিন্তু গঞ্জের হাটেও পূজার বেচাকেনা লাগেনি। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সারাদেশের অবস্থা যাই হোক মাগুরার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কখনো বিনষ্ট হয়নি। ইতোপূর্বে দেশে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হলেও তার বিষবাষ্প মাগুরার বাতাসকে কখনো কলুষিত করেনি। সম্প্রতি এ জেলায় নির্বাচনোত্তর সহিংসতার কিছু ঘটনা ঘটলেও একটি ব্যতিক্রমি ঘটনা ছাড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর গণনির্যাতন, প্রতিমা ভাঙচুর বা মন্দিরে হামলার মতো কোন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি। তারপরও হিন্দুদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে ঘিরে কোন উচ্ছ্বাস নেই কেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে? এ প্রসঙ্গে কলেজ শিক্ষক শংকর বিশ্বাস ‘সংবাদ’কে বলেন, মাগুরায় সাম্পদায়িক সম্প্রীতি সবসময় ভাল। মাগুরায় নির্বাচনোত্তর সহিংসতার কিছু ঘটনা ঘটলেও তা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর নয় । সে অর্থে মাগুরার হিন্দুরা ভাল আছে; কিন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে হিন্দুদের ওপর যে অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে তার একটি অশুভ প্রভাব দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মাগুরার হিন্দুদের ওপরও পড়েছে। শহরের জামরুলতলা পূজা কমিটির কর্মকর্তা গণেশ শিকদার বলেন, হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা হলেও মাগুরার ক্ষেত্রে প্রতিবছরই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এ জেলার কাত্যায়নী পূজা হিন্দুদের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ থেকেও মানুষ আসে মাগুরায় কাত্যায়নী পূজা ও একমাস ব্যাপী মেলায় অংশ নেয়ার জন্য। তবে দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ হিন্দুদের মনে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। নতুন বাজার এলাকার ব্যবসায়ী বাবলু সাহা ‘সংবাদ’কে বললেন, আমরা ভালো আছি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা আমাদের আত্মীয়স্বজনরা ভালো নেই। পূজার ওপর এর একটি প্রভাব তো পড়তেই পারে। গত বছর জেলায় সার্বজনীন ও পারিবারিক মিলিয়ে মোট ৩শ’ ৪৪টি মণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সকল মণ্ডপে এবারও পূজার প্রস্তুতি চলছে। কাজেই এ বছর মাগুরায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে অন্যান্য বছরের মতো, তবে উৎসব হবে না। উৎসবের জন্য প্রয়োজন মানুষের স্বতঃস্ফুর্ততা, যা অন্তত এই মুহূর্তে এ দেশের হিন্দুদের মাঝে নেই⎯এ মন্তব্য পর্যবেক্ষক মহলের।

সংবাদ, ২২ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন