১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভোলার মানুষ ছিল নিশ্চিত। তাদের সাধারণভাবে ধারণা ছিল কোথাও কোন রকম সহিংস ঘটনা ঘটবে না। কারণ বিএনপি জিতে গেছে। বিএনপির কর্মী ও সমর্থকদের দ্বারা কেবল ঐসব ব্যক্তিরই লাঞ্ছিত হবার সম্ভাবনা, যারা নির্বাচনের আগে ক্ষমতার জোরে এলাকায় অন্যায়-অবিচার ও জোর-জুলুম করেছেন। সাধারণত হাঙ্গামা ও সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে যুক্ত হয় পরাজিত দলের লোকজন। পরাজয়জনিত হতাশা থেকেই তারা এমন করে থাকে; কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, নির্বাচনে জেতার পরও বিএনপির অনেক নেতা ও কর্মী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে তাদের হাতে এই অঞ্চলের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতিত হতে শুরু করেন অকল্পনীয়ভাবে। এখনো সেই দৈহিক অত্যাচার-নিপীড়ন অব্যাহত। ভোলার অনেক জায়গায় তারা পৈশাচিক মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। মালামাল লুটপাটের পাশাপাশি তারা হিন্দু মহিলাদের সম্ভ্রমও লুটে নেয় গণহারে। সম্ভ্রম লুটের ব্যাপক ঘটনা ঘটে লালমোহন থানার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে। গণধর্ষণের শিকার হয় এ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের শিশু, কিশোরী, যুবতী, এমন কি বৃদ্ধাসহ সর্বস্তরের শত শত নারী। দশ বছরের শিশু থেকে ৫০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হয়েছে নরপশুদের হাতে। এমনকি পঙ্গু শেফালিও রক্ষা পায়নি তাদের হাত থেকে। নরপশুদের মায়ের বয়সী বিষ্ণুপ্রিয়া, সরুবালা, মাধুরী ও শংকরীর মত ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলারাও নরপশু লম্পটদের লালসার শিকার হয়েছেন। এমনকি ধর্ষণের শিকার হয়েছে দশ বছরের শিশু রীতা রানী। ধর্ষিতাদের অনেকেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে একাধিকবার। এতদিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেবল রীতা রানীর ধর্ষণের কথাই স্বীকার করা হয়েছে এবং ধর্ষণের সাথে জড়িত সেলিমকে (পিতা ইয়াসিন মাষ্টার) তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাদবাকি সব ধর্ষণের কাহিনীই পুলিশ বা প্রশাসন না জানার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ করেও কোন ফল পায়নি। গত ১৮ নবেম্বর মহিলা পরিষদ ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কয়েকজন লর্ড হার্ডিঞ্জে এসে এই অভিযোগ পান। এ অভিযোগ পেয়েছেন সাংবাদিকরাও। কিন্তু পুলিশ বলছে ধর্ষিতা বা লাঞ্ছিতারা লোক লজ্জার ভয়ে সব গোপন করে যাচ্ছে। গত ১৮ নবেম্বর বিকেলে সামাজিক আন্দোলন, মহিলা পরিষদ নেতৃত্ববৃন্দ ও কতিপয় সাংবাদিক লালমোহন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ গত ২০ নবেম্বর লর্ডহার্ডিঞ্জ থেকে ধর্ষিতা শেফালিকে উদ্ধার করে এনে পুনরায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন এবং ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ভোলা সদর হাসপাতালে পাঠান। হাসাপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ করুণা কান্তি দে বলেন, দেড় মাস পর কোন বিবাহিত মহিলা যে দাম্পত্য জীবন চালিয়ে আসছে, তার কাছে ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যাবে না, যদি মারাত্মক কোন ইনজুরি না থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে লালমোহন থানার পুলিশ লর্র্ড হার্ডিঞ্জ থেকে উদ্ধার করেন ধর্ষণের শিকার বিষ্ণুপ্রিয়া (৪০) ও তারই পুত্রবধূ সুজাতা (২০) কে। তাদেরও জবানবন্দী নেয়া হয়েছে বলে লালমোহন থানা পুলিশ জানায়। পুলিশ আরো জানায়, লর্ড হার্ডিঞ্জে লুটপাট ও ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত এমন ৭ জনকে পুলিশ ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে। তারা হচ্ছে রিয়াজ উদ্দিন ভুট্টো, মোঃ আলী বাবুল, আবু মিয়া, মোঃ হারুন, সেলিম মাতাব্বর, মোঃ মোস্তফা ও এখলাস উদ্দিন জাহাঙ্গীর। তবে এলাকার লোকদের বক্তব্য, ধৃত জাহাঙ্গীর নির্দোষ। তার দু’লম্পট সহোদর ভুট্টো ও বাবুলকে গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশ জাহাঙ্গীরকেও গ্রেফতার করে। এদের সবাই এখন কারাগারে। লর্ড হার্ডিঞ্জে লম্পট ও সন্ত্রাসীদের তালিকা খুব দীর্ঘ নয়। সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হতে পারে। তবে এরা সংঘবদ্ধ এবং অস্ত্রধারী ও বোমাবাজ। ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর ২ অক্টোবর রাতে এরা লর্ড হার্ডিঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট ও ধর্ষণের মহোৎসব করে। কোন কোন বাড়িতে ৪/৫ বারও আক্রমণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভেণ্ডারবাড়ি উল্লেখযোগ্য। এ বাড়িতে আশেপাশের দরিদ্র হিন্দু পরিবারের শতাধিক মহিলা আশ্রয় নিয়েছিল। সন্ত্রাসী ও লম্পটরা টের পেয়ে ২ অক্টোবর রাত ৯ টায় প্রথমেই এ বাড়িতে আক্রমণ চালায়। সন্ত্রাসীদের ভয়ে অনেক মহিলা বাড়ি সংলগ্ন ধানক্ষেত ও পুকুরে নেমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু লম্পটরা তাদেরকে সেখান থেকে ধরে এনে তাদের লালসা চরিতার্থ করে। ঐ সময় এদের ভয়ে মহিলাদের আর্তচিৎকার বহুদূর থেকে শোনা গেছে বলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে। অস্ত্রধারী এই সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। রাতের মধ্যে ৪/৫ বার আক্রমণ হয়েছে এ বাড়িতে। একই মহিলা একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হন। দেড় মাস পরেও ঐ কালো রাতের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা এখনো হাউমাউ করে কাঁদেন। গত ১৮ নবেম্বর মহিলা পরিষদ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ববৃন্দের সাথে ঐ এলাকায় গিয়ে অনেক করুন কাহিনী শোনা গেছে। মায়ারানী (২০) নামের এক গৃহবধূ মহিলা পরিষদ নেতৃত্ববৃন্দের কাছে তার দুঃখের কাহিনী বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, লম্পটরা ২য় বারের মত ৩ অক্টোবর সকালে যখন তার বাড়িতে আসে, তখন তিনি আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে বাড়ির পুকুরে ঝাঁপ দেন। কিন্তু তখন লম্পটরা ঘর থেকে তার কোলের শিশুটিকে এনে পানিতে নিক্ষেপ করার ভয় দেখালে তিনি কোলের শিশুর জীবন রক্ষায় পুকুর থেকে উঠে আসতে বাধ্য হন। এসব লম্পট এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলাকার হিন্দু পরিবারগুলো এখনো নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না। আবারও আক্রমণ হয় কিনা এ ভয়ে অধিকাংশ পরিবারের বয়স্কা মেয়েদের তারা শহর এলাকায় আত্মীয়স্বজনদের কাছে অথবা বাসাভাড়া করে সরিয়ে রেখেছেন। এলাকার ললিত মোহন দাস জানান, তার মেয়ে ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী। সামনে তার পরীক্ষা। তারপরও নিরাপত্তার জন্য তাকে সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। পঙ্গু শেফালি রানী (৩৫) জানায়, তিনি (শেফালী) ভেবেছিলেন লম্পটরা তাকে পঙ্গু হিসাবে ক্ষমা করবে। কিন্তু তারা তাকেও ক্ষমা করেনি। শেফালী বলেন, আমিও তাদের ক্ষমা করবো না। লম্পটদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে এক সময় শেফালী রাখী দাস পুরকায়কে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা চিৎকার করে ওঠেন। পুরো পরিবেশ তখন ভারি হয়ে ওঠে। সকলের চোখ দিয়েই তখন পানি ঝরতে দেখা যায়। লর্ড হার্ডিঞ্জের অন্নদা প্রসাদ গ্রামের ১০৮ বছরের বৃদ্ধ রাজকুমার দাশ বলেন, বৃটিশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কোন আমলেই এই এলাকায় এত পাশবিক ঘটনা ঘটেনি। ’৯২ সালে বাবরী মসজিদ ভাঙার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ এলাকায় হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানো হলেও এমন লুটপাটের ঘটনা তখনও ঘটেনি। রাজকুমার দাশ বলেন, সন্ত্রাসীরা এবার তাকে বেদম মারধর করেছে। তার পিঠের উপর নির্যাতনের চিহ্ন তিনি দেখালেন সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ববৃন্দকে। রাজকুমার দাস পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, আপনারা মাঝেমধ্যে আমাদের খোঁজ-খবর নেবেন। আপনারা আসলে আমরা সাহস পাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু ব্যক্তি অভিযোগ করেন, সন্ত্রাসীরা এখনও হিন্দু পরিবার ̧লোকে জীবননাশের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করছে। তারা বলেন, সন্ত্রাসীরা চাচ্ছে হিন্দুরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাক। তখন তারা (সন্ত্রাসীরা) হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করে নেবে। তারা বলেন, লর্ড হার্ডিঞ্জে সন্ত্রাসের নেতৃত্ব দিচ্ছে সাহাবুদ্দিন, ইয়াসিন মাস্টার, আঃ কাশেম, ফরিদ উদ্দিন ও ফয়েজউল্লাহ। এদের ও এদের সহযোগিদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করা না হলে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। এরা গ্রেফতার না হলে এ এলাকার হিন্দুদের দেশ ছাড়তে হবে। তবে সম্প্রতি কিছু সন্ত্রাসী ধরা পড়ায় তারা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। লুটপাট বন্ধ হলেও সন্ত্রাসীরা চাচ্ছে হিন্দুরা বাড়িঘর বিক্রি করে এলাকা ছাড়ুক। কোন কোন হিন্দু পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তারা আর বাংলাদেশে থাকবেন না। সামাজিক আন্দোলনের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্র্য, খোরশেদ আলম, মহিলা পরিষদ নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়, ডাঃ মালেকা বেগম ও ডাঃ ফরিদা বেগম নির্যাতিতদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে তাদের যাওয়া চলবে না। নিজস্ব বসতভিটাতে থাকতে পারার মধ্যে গৌরব রয়েছে। তারা বলেন, সন্ত্রাসীরা সংখ্যায় বেশি নয়। হিন্দু-মুসলমান মিলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সন্ত্রাসীদের সাথে আপস নয়। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে। এক সময় সন্ত্রাসীরা অবশ্যই পরাস্ত হবে।

সংবাদ, ২৯ নবেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন