আজ ১১ ফেব্রুয়ারি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পূর্ণ হলো। ২০১২ সালের এই দিনে ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় নিজ বাসায় তারা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। বেঁচে যায় তাদের চার বছরের ছোট্ট শিশু মেঘ। মেঘের বয়স এখন ১১, অভিশপ্ত সেই রাতের কিছু কি মনে আছে তার? হয়তো সবকিছুই মনে আছে, হয়তো মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়, হয়তো…

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের পর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। আর ২৩ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি পরিহাসের সুরে জানান, “সরকারের পক্ষে মানুষের বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়।”

এতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের পরও সবাই বিচারের আশায় থেকেছে। সময় গড়িয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদল হয়েছে। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এসেই সাগর-রুনি হত্যার রহস্য উদঘাটনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেন। তিনি বলেছিলেন ২০১২ সালের ১০ অক্টোবরের মধ্যে রহস্যের উন্মোচন হবে। এরপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেওয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরেও মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। তারপর ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পরপর দুবার নতুন সরকার নির্বাচিত হয়। প্রতিবারই নতুন প্রতিমন্ত্রী পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সবাই শুধু আশার কথা শুনিয়ে যান।

এ তো গেলো দেশের ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের তাচ্ছিল্যের উপাখ্যান। এই উপাখ্যান আরো দীর্ঘ, আরো ক্লান্তিকর। একদল কিছুদিন তদন্ত করে ব্যর্থতা স্বীকার করে, তারপর নতুন তদন্তদল আসে। তারা ব্যর্থ হয়, চলে যায়। এই আসা যাওয়ার মাঝে তদন্ত কিন্তু ঠিকই চলছে, এখনো। আরো কতোদিন ধরে চলবে, বলা মুশকিল।

সাগর রুনি খুন হবার পর, রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এর ৪ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২ মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। তারা ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে হাইকোর্টে গিয়ে তদন্ত থেকে অব্যাহতি চায়।

এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ১৮ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দায়িত্ব নিয়েই সাগর ও রুনির মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে পুনরায় ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা পরীক্ষা করে র‌্যাব। ভিসেরা পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের মৃত্যুর আগে কোনো প্রকার বিষাক্ত বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করানো হয়নি। আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ ও আঘাতের কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যেই র‌্যাব বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার থাকা ৫ আসামি মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুণ, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়। এ ছাড়া ওই মামলায় বিভিন্ন সময়ে রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল এবং দারোয়ান এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে তানভীর এবং পলাশ জামিনে মুক্ত আছেন।

বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার দেশে সাত বছরে ৬৩ বার সময় নিয়েও আদালতে কোন প্রকার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি র‍্যাব। আদালত সূত্রে জানা যায়, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলায় মোট ১৪৬ টি শুনানি হয়েছে ঢাকা মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। গত চার বছরে আদালত ৩৯ টি তারিখ ধার্য করেছিলো প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনও তারিখেই তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিতে পারেনি।

সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি চার্জশিট দাখিলের দিন ধার্য থাকলেও তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে র‌্যাব। তাই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এমএম ইউনুস খানের আদালত আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে দিন ধার্য করেন। (সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন)

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) এএসপি সহিদার রহমান রোববার বলেন, ‘আমি গত বছরের ১১ নভেম্বর মামলার তদন্তভার পেয়েছি। এ মামলা যাঁরা আগে তদন্ত করেছেন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মামলার বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, সাগরের মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমাদের কাজ এগোচ্ছে।’

সহিদার রহমান আরও বলেন, ‘আমরা তথ্যের ভিত্তিতে এগোচ্ছি। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছি না। চেষ্টা করলে সবকিছু সম্ভব। হত্যার মোটিভের ব্যাপারে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়।’ (সূত্রঃ প্রথম আলো)

তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড় ও সাগরের হাত-পা বাঁধা কাপড় জব্দ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। হত্যায় সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তির ডিএনএ নমুনাও বিদেশি ল্যাবে পাঠানো হয়। এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন তদন্ত সংস্থার হাতে এসেছে। তবে তা দিয়ে আসামি শনাক্তের জন্য আপাতত তেমন কোনো কার্যকর ক্লু মেলেনি।

সাংবাদিক দম্পতি খুন হওয়ার পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিচার চেয়ে আন্দোলনে নামে সাংবাদিক সংগঠনগুলো। হত্যারহস্য উদ্ঘাটন, খুনি ধরা থেকে বিচার-বিভিন্ন সময়ে আশার বাণী শুনলেও দীর্ঘ সময়ে শুধু তদন্ত সংস্থা আর তদন্ত কর্মকর্তাই বদল হয়েছে। রহস্য আর উদ্ঘাটন হচ্ছে না।

নিহত সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা খানম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি না চায় তাহলে তো কারও বের করার ক্ষমতা নেই। সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলে আর কী। কত বড় বড় ঘটনা বের হয়ে গেল। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আসামিদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আর সাগর-রুনির খুনের রহস্য বের হবে না?’

সালেহা খানমকে কে বলে দিবে এই সহজ প্রশ্নটিই বাংলাদেশের সবচে কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। আর, জবাব থাকলেইবা কী! ‘ক্ষমতাসীনরা চাইলে রহস্য বের হবে, নইলে হবে না।’ এই কথাটি বলার মত সাহসও বাংলাদেশে অবশিষ্ট নেই।

মন্তব্য করুন