বিনা নোটিশে, কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার শিলছড়ি গ্রামে একটি মারমা পরিবারের জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করছে উপজেলা প্রশাসন। অর্ধশতাধিক মারমা পরিবারের এই গ্রামে গড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে একাধিক বাঙালি পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে প্রশাসন।

 

কাপ্তাই উপজেলার ওয়াজ্ঞা ইউনিয়নে শিলছড়ি পাড়াটির অবস্থান। এখানে পাহাড়িদের ৪০ থেকে ৫০ পরিবারের বসবাস রয়েছে। এই পাড়ার বাসিন্দা উলামং মারমার ভোগদখলীয় ২০ শতক জায়গাতে আশ্রয়ন প্রকল্পের তিনটি ঘর বানানোর কাজ শুরু করা হয়েছে।

উলামং জানান, তিনি গত ১৯ জানুয়ারি এ নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছেন। তার আইনজীবী আদনান রফিকের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক, রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। এই সব কিছু তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসন ঘর নির্মাণের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বংশ পরম্পরায় ভোগ দখলে পাওয়া এই জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প না করার দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী মানববন্ধনও করেছেন।

কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারের খাসজমিতে ভূমিহীন এবং গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের অংশ হিসেবে ওখানে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। ওই জমিটি সরকারের খাস জায়গা। জমিটি এখনো কারো নামে বন্দোবস্তি দেওয়া হয়নি, একটা খাস জমির জন্য যে কেউ আবেদন করতে পারেন, যদি সরকার বন্দোবস্তি না দেয় তাহলে সেটা কারো নামে হতে পারে না।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদও অভিন্ন বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, দুটি পরিবারের জন্য মাত্র দুই শতক করে চার শতক জমি নেওয়া হয়েছে। পুরো জমিটাই খাস জমি। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, পার্বত্য এলাকায় কাউকে খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সুযোগ নেই।

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, সমতলে খাস জমি বলতে যা বোঝায়, পাহাড়ে তা একই অর্থে ব্যবহৃত হবে না। পার্বত্য প্রথাগত ভূমি আইন অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভূমিই তাহলে তথাকথিত খাস জমি। প্রকৃতপক্ষে কাপ্তাইয়ের শিলছড়ি গ্রামে যার ভোগদখলীয় জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হচ্ছে, তার অসম্মতিতে, তাকে কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এটা করা উচিত হবে না।

উল্লেখ্য, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০০১ সালের ২০ জুন সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। তবে এই কমিশন আইনের কিছু ধারা সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেই সব সংশোধন করে ২০১৬ সালে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ সংসদে পাস হয়। কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ভূমি বিরোধ রয়েছে তার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কাজ করবে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ, ১৯৫৮ মোতাবেক কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে অধিগ্রহণ আইনত অবৈধ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ হয়নি বলে জনগণের সব জমিই খাস হিসেবে বিবেচিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বন্দোবস্তি বন্ধ রয়েছে। কাজেই কোনো প্রকল্পের নামে কাউকে ব্যক্তিগত বন্দোবস্ত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কেবল স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন ২০১৬ সালে গঠিত হলেও বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিনা নোটিশে এবং বিনা ক্ষতিপূরণে জমি দখল করার প্রতিবাদে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শিলছড়ি বনফুল মহিলা ক্লাব চত্বরে মানববন্ধন করেন গ্রামের শতাধিক মারমা নারী।

সমকাল

মন্তব্য করুন