উত্তরের সীমান্তবর্তী বিভাগীয় জেলা শহর রাজশাহীর সর্বত্রই আওযামী লীগ নেতা-কর্মী, সমর্থক, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে নির্মম নির্যাতন। দিন দিন এই নির্মমতা বেড়েই চলেছে। অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার লোকজন পুলিশ কিংবা জেলা ও উপঝেলা প্রশাসনের সহায়তা চেয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে গোটা জেলা জুড়ে চরম আতংক ও ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন⎯ পরবর্তী সময়ে অব্যাহত হামলার কারণে হাজার হাজার মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে আওয়ামী কর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। দাবি করা চাঁদা পরিশোধ করলে হামলা-নির্যাতন বন্ধ করে দেয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া অনেককে জোরজবরদস্তি করে বিএনপিতে যোগদানেও বাধ্য করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে থানা পুলিশ করারও সাহস পাচ্ছে না কেউ। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে বলেছে, বিএনপি ও জামাত-শিবিরের সমর্থকরা এসব হামলা-নির্যাতন ও চাঁদাবজি করছে। নির্বাচন-পরবর্তী অত্যাচার-নির্যাতন ’৭১-এর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে বলে আওয়ামী লীগ দাবি করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার দুর্গাপুর, পুঠিয়া, তানোর, গোদাগাড়ি, বাগমারা উপজেলায় এই নিষ্ঠুরতা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হচ্ছে অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেন কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তাদের রহস্যজনক নীরবতায় পরিস্থিতি দিন দিন মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৫ই অক্টোবর পুঠিয়ার নন্দনপুর, তেলিপাড়া ও চক দৌলতপুরে বিএনপি সমর্থকরা হামলা চালিয়ে ১৯টি দোকান, ৩টি বাড়ি ভাঙচুর ও একটি অফিস পুড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের পরদিন রাতে গোদাগাড়ি উপঝেলার আদিবাসী গ্রাম গোপালপুরে হামলা চালানো হয়। একইদিন থেকে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হামলা-নির্যাতন চলতে থাকে আওমী কর্মী-সমর্থকদের ওপর। দুর্গাপুরের ঝালুকা গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়িতে গিয়ে হুমকিদান ও গরু লুট করা হয়। সুখানদি, হরিরামপুর, আনোলিয়া, ব্রাহ্মপুর গ্রামে হামলা চলছে। অনেকের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। কারো কারো পুকুরের মাছ করা হচ্ছে লুট। কোন কোন এলাকায় পান বরজ ধ্বংস করারও খবর পাওয়া গেছে। সূত্র মতে, গত ১২ই অক্টোবর পুঠিয়া উপজেলার সাতবাড়িয়া বৈষ্ণবপাড়ার কালিমন্দিরটি ভেঙে ফেলে সন্ত্রাসীরা। ওই গ্রামের সংখ্যালঘু আওয়ামী লীগ কর্মিরা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ৯৮ সালের মুক্তিযোদ্ধা তাছের হত্যা মামলার সাক্ষী ও বাদির ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নওপাড়াতে ভোটের পরদিন থেকে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিড়ালদহে মারধর করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানকারও আওয়ামী কর্মী-সমর্থকরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গত ১২ই অক্টোবর পুঠিয়ার ঝলমলিয়াতে আওয়ামী লীগ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-৪ আসনে পরাজিত প্রার্থী তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুকের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। আওয়ামী লীগ নেতা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও গাড়িটি ভেঙে চুরমার ও চালক দুলালকে মারধর করা হয়। গাড়ি থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র লুট করে সন্ত্রাসীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তানোর উপজেলার রাতুল গ্রামে গত ১২ই অক্টোবর হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ কর্মী নরেশ চন্দ্র দাসকে (৪৫) একই দিনে গোদাগড়িতে পোড়ানো হয় আওয়ামী লীগ অফিস। ১৩ই অক্টোবর বাগমারা উপজেলার বুজরুককোলা হিন্দুপাড়ায় অন্তত ৭টি বাড়িতে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়েজউদ্দিন কবিরাজের বাড়িতে হামলা করা হয়। বাঘা উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ছাত্র নেতা লায়েবউদ্দিন লাভলুর বাসার টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। গত ১১ই অক্টোবর রাতে নগরীর মতিহার থানার সামনে ২৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য আবদুস সত্তারকে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে আঘাত করা হলে তিনি গুরুতর আহত হন। গোদাগাড়ি উপজেলার মোহনপুর বাংধারা গ্রামের ১৯টি আদিবাসী পরিবারকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের জন্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। গত ৭ই অক্টোবর তানোরের হরিদেবপুরে একটি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। রাজশাহী বিআইটি, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা চলছেই। জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত শত্রুরতার কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্ত বলেও প্রশাসন দাবি করেছে; কিন্তু জেলা ও মহানগর এবং বিভিন্ন উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রশাসনের বক্তব্যকে হাস্যকর উলেখ করে বলা হয়েছে, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বিএনপি ও জামাতের “সন্ত্রাসীরা” সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও আওয়ামী লীগ নেতা-সমর্থকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা এসব নির্যাতন বন্ধের জন্য সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানান। অবশ্য বিএনপি ও জামাতের পক্ষ থেকেও হামলা-হুমকিদান ও নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করা হয়েছে।

সংবাদ, ২১ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন