অল্পের জন্য খুন হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন খিজির হায়াত খান। তিনি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। কিছুদিন আগে খিজির হায়াত অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার অভিনীত ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ সিনেমাটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে। তিনি এই সিনেমাকে জঙ্গিবাদ বিরোধী সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
আসলেই তাই। সিনেমার গল্প একটি জঙ্গি দলের বিরুদ্ধে একজন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংগ্রাম নিয়ে। খিজির হায়াত খান সেই সংগ্রামী মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এই সিনেমার টীজার এবং ট্রেলারে কোরআনের আয়াত ও হাদীস ব্যবহার করে দর্শকের উদ্দেশ্যে আগাম বার্তা দেয়া হয়েছিলো। বার্তাটি ছিলো এমন যে, ধর্ম কখনো সহিংসতার পক্ষে নয়, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কিছু ব্যক্তি বা গ্রুপ মানুষ হত্যার মতো কাজ করে থাকে।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে খিজির হায়াত খানরা চেয়েছিলেন ধর্মের মান রক্ষা করতে। চেয়েছেন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সহিংসতা বিমুখ করতে। কিন্তু ধর্ম আসলে একটি বড় মাছের বিশাল পেট, যে পেটের ভেতর আরো অনেক ছোট ছোট ধর্ম আছে। বড় পেটের মান রক্ষা করার চেষ্টা করে পেটের ভেতর থাকা অনেক ছোট ছোট মাছের স্বার্থে আঘাত করেছেন খিজির হায়াত খান ও তার সঙ্গীরা।
স্বার্থে আঘাত মেনে নেয়নি সেরকমই একটি মাছ। মাছের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টীম। খুব ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন। যাদের হাতে ইতিমধ্যে ব্লগারসহ বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের খুনের নিশানায় আছেন আরো কয়েক ডজন মানুষ। খিজির হায়াত খান ছিলেন নিশানার নতুন সংযোজন। যদিও তিনি নাস্তিক নন, বরং নিজেকে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ হিসেবেই পরিচয় দেন।
খিজির হায়াত খান বেঁচে গেলেন। তাকে হত্যা করার আগেই পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট এমদাদ ওরফে সবুজ ওরফে আবু সালমান ওরফে হুজাইফা এবং আবু বক্কর ওরফে ফাহিম ওরফে আব্দুল্লাহ ফাহিম নামে আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে।
১০ ডিসেম্বর সোমবার রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা দুজনই নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার সদস্য।
টিটিসি সূত্র জানায়, জঙ্গিদের যোগাযোগ চ্যানেল টেলিগ্রাম অ্যাপসে ‘এসো কাফেলাবদ্ধ হই’ নামে একটি গ্রুপে খিজির হায়াতকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়। আবু বক্করের ওপর দায়িত্ব ছিল খিজির হায়াতকে অনুসরণ করে তার চলাফেরা এবং ঠিকানা সংগ্রহ করা। এজন্য আবু বক্কর কুমিল্লায় খিজির হায়াতের গ্রামের বাড়ি রেকি করে আসে। জোবায়ের নামে এক সহযোগীসহ বক্কর খিজির হায়াতের কুমিল্লার কাপ্তানবাজারের বাড়িতে গিয়ে মিথ্যা পরিচয়ে তার বাবার সঙ্গে কথা বলে। এছাড়া, ঢাকায় তার বাসা এবং অফিস সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করেছিল তারা। বক্কর এসব তথ্য গত আগস্টে সৌদি আরবে অবস্থানকারী এমদাদকে জানায়। হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে এমদাদ সৌদি থেকে দেশে আসে।
সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের শীর্ষ নেতা মাওলানা ওসমান গণির নির্দেশে তারা খিজির হায়াতকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। নরসিংদীর বাসিন্দা মাওলানা ওসমান গণি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক থেকে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি এমদাদ কেরানীগঞ্জে মুফতি ইজাহার পরিচালিত মারকাহুদা আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে। ২০১৬ সালে সে কাতার হয়ে সৌদি আরবে যায়। মাদ্রাসায় পড়া অবস্থায়ই সে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার হওয়া আবু বক্করও যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। তাদের দুজনের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে।
প্রাণের ঝুঁকির মুখে থেকেও খিজির হায়াত খান পিছু হটছেন না। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সংকল্পবদ্ধ। সংগ্রামের যে রূপরেখা সিনেমায় নায়ক হিসেবে দেখিয়েছেন, পর্দার বাইরেও তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার লক্ষ্যে অবিচল।
মাস দুয়েক আগে সিটিটিসি’র পক্ষ থেকে জঙ্গিরা হামলা করতে পারে বলে আমাকে সাবধানে থাকতে বলা হয়। আমি জঙ্গিবাদবিরোধী কাজ করি। আমার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘মি. বাংলাদেশ’-এর উপজীব্য বিষয় ছিল ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ ও নিরীহ তরুণদের যে জঙ্গিবাদে জড়ানো হয় তা নিয়ে। এ কারণে আমাকে ফেসবুকেও থ্রেট দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গিরা যতই থ্রেট দিক না কেন, আমি আমার কাজ করে যাবো। এই দেশ জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হতে দেবো না।
– খিজির হায়াত খান
সিটিটিসি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দুই জঙ্গিকে মঙ্গলবার আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য উদ্ধার করা যাবে।
তথ্যসূত্র – বাংলা ট্রিবিউন