এক লাখ সংখ্যালঘু ভোটার গত ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোলার চারটি আসনে ভোট দিতে পারেনি। ভোটের আগের কয়েকদিনে এবং ভোটের দিন সকালে সংখ্যালঘুদের ওপর অমানসিক নির্যাতন, হুমকি, বাড়ি-ঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের কারণে ভীত শঙ্কিত হয়ে তারা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রেই যায়নি। এ সুযোগে বিএনপি ও নাজিউর রহমানের সন্ত্রাসীরা ভোট কেন্দ্র দখল করে সংখ্যালঘুদের ভোট চার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। অল্প সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোটার ভোট কেন্দ্রে গেলেও তারা আতঙ্কের মধ্যে ভোট দিয়েছে। আর এই কারণে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ভোলা-১,২ও ৩ আসনের প্রার্থী সাবেক শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তিন আসনেই ব্যাপক ভোটের ব্যাবধানে পরাজিত হয়েছেন। এদিকে নিরাপত্তাহীনতায় সংখ্যালঘুরা আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ভোটের দিন ভোলার চারটি আসনের বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে,কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারদের উপস্থিতি নেই বললে চলে। দু-একজনকে দেখা গেলেও তাদের চোখে মুখে ছিল ভয়ের ছাপ। খুবই অসহায় দেখাচ্ছিল তাদের। ভোটের দিন সকাল ৮টায় ভোলা-২ আসনের টঞ্জী ইউনিয়নের রায় মোহন ডাক্তারের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ২৪টি ঘর ভাংচুর ও লুটপাট করে সংখ্যালঘু ভোটারদের এলাকা থেকে বের করে দেয়। সংখ্যালঘুরা ভোটাররা আতঙ্কিত হয়ে পাশের একটি মুসলিম বাড়িতে আশ্রয় নিলে সেখানেও তারা আক্রমন চালায়। সন্ত্রাসীরা দুটি মন্দিরও ভাংচুর করে। সন্ত্রাসীদের হামলায় ছয়জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। যে মুসলিম বাড়িতে সংখ্যালঘুরা আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়ির মালিক কাঞ্চন মাতব্বরও (৪৮) মারাত্মক আহত হন। আহত অন ̈রা হলেন, মনির, যাদব দাশ, গৌরাঙ্গ ঝালাইকার, দক্ষিন মৃধা ও মাধব। স্থানীয় বিএনপি নেতার অধীনে সন্ত্রাসীরা এ হামলা চালায় বলে জানায়। হামলার শিকার হয়ে ২৪টি পরিবারের সংখ্যালঘু সদস্যরা এখন আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান করছে। ভোট শেষ হলেও তারা এলাকায় ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। ভোটের দুদিন আগে ভোলা-৩ আসনের লালমোহনে বিএনপির সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছয়টি গরু নিয়ে গিয়ে জবাই করে খেয়েছে। এ দুটি এলাকায় পরিদর্শনে গেলে একাধিক সংখ্যালঘু এ অভিযোগ করেন। কিন্তু নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। ভোটের কয়েকদিন আগে থেকেই অধ্যুষিত এলাকায় সন্ত্রাসীরা এ ধরনের হামলা, ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি, কেন্দ্রে গেলেই জবাই করা হবে বলে ধারাবাহিক ভাবে নির্যাতন করে আসছিল। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন ব্যাবস্থাই নেয়নি। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার চারটি আসনে মোট ভোটার ৮ লাখ ১ হাজার ২৮৭ জন। এর মধ্যে ভোলা-১ আসনের ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৩ জন ভোটারের মধ্যে ৮ থেকে ৯ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু । ভোলা-২ আসনে ১ লাখ ১১ হাজার ৮২৪ জন ভোটারের মধ্যে ২০ থেকে ২২ শতাংশ, ভোলা-৩ আসনে ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৪৩ জন ভোটারের মধ্যে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ এবং ভোলা-৪ আসনের ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৬৭ জন ভোটারের মধ্যে ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোটার। ভোলা জেলা প্রশাসক কবির মোঃ আশরাফ আলম সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ভোট গ্রহণ শেষে ঐ দিন বিকেলে তিনি তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বহু লোক ভোট দিতে যেতে পারেনি সন্ত্রাসীদের হামলার ভয়ে। ভোটের পরদিন সকালে নিজ বাসভবনে ভোলা-১,২ও ৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ভোরের কাগজের এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় প্রশাসন, সেনা বাহিনী, বিএনপি ও নাজিউর রহমানের সন্ত্রাসীরা একজোট হয়ে তাকে পরাজিত করেছে। তিনি বলেন, নৌকার ভোটারদের এবং সংখ্যালঘু
৫০সম্প্রদায়কে ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে থেকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, এবারের নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাঙ্খার রায়কে বানচাল করা হয়েছে। তিনটি আসনের অনেক ভোটকেন্দ্র সন্ত্রাসীরা দখল করে ইচ্ছে মত ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। তিনি বলেন, সেনা বাহিনীর সদস ̈রা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। বরং চারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছে। তোফায়েল আহমেদ এবারে্র নির্বাচনকে স্থানীয় প্রশাসন ও সেনা বাহিনীর সদস ̈দের সাজানো নাটক হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, যে কেন্দ্র ̧লো বিএনপির সন্ত্রাসীরা দখল করে ছিল, সেখানে সেনা বাহিনী যায়নি অথচ যেখানে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহন চলছিল সেখানে গিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
ভোরের কাগজ, ৪ অক্টোবর ২০০১
কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন