জাগো বাঙ্গালী জাগো! মানবতার বিরুদ্ধে এই হামলার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াও। নিজের বিবেককে জাগ্রত কর। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার প্রতিহত কর। দুর্বলের বিরুদ্ধে তথাকথিত সবলের হামলার প্রতিবাদে এগিয়ে আসুন। একের পর এক হামলা, অত্যাচার, অগ্নিসংযোগের কারনে সংখ্যালঘুদের অনেকেই তটস্থ। বেশ কয়েকজন প্রান হারিয়েছেন। আহতের সংখ্যা অসংখ্য কয়েকটি মন্দির ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে। অত্যাচারের সীমা এই পর্যন্ত গেছে যে বৃদ্ধ বাবার সামনে তার দুই কন্যার শালীনতাহানি করা হয়েছে। ঘটনার সাক্ষী যাতে না থাকে সে জন্য নিরীহ বাবাকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। নির্বাচনের আগে থেকে গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে কয়েক শ’। হামলার ভয়ে অনেকে পৈত্রিক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। কেউ কেউ দেশান্তরিত হয়েছেন। রাজধানীর হাজারীবাগসহ কয়েকটি এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু পরিবার গৃহহীন হয়েছে। তাঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে তাঁদের ওপর হামলার করুণ কাহিনী বর্ণনা করেন। সংখ্যালঘুদের উপর এই হামলা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনাকেও স্মরণ করে দেয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এঁদের অনেকেই অংশ নিয়েছিলেন। মায়ের পরের স্থান প্রিয় মাতৃভুমিকে রক্ষার জন্য সকলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র্র্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে কেউ কল্পনা করেনি। ভোট যে কোন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এই দায়িত্ব পালনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ভুল বোঝাবুঝি থেকেই এই ঘটনার উদ্ভব। অথচ সংখ্যালঘু হলেই যে একটি বিশেষ দলকে ভোট দেবেন এর কোন মানে নেই। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হামলায় দেশের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল গভীর ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে। সবাই প্রায় এক বাক্যে হামলাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া অত্যান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, সংখ্যালঘু হিসাবে আমরা কাউকে মনে করি না। কেননা আমরা সবাই বাংলাদেশী। এদের কারো ওপর কোন হামলা হলে সে যেই হোক না কেন তাকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একই দাবি জানান হয়েছিল। দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের হামলাকে অমানবিক বলে অভিহিত করে অবিলম্বে এ ধরনের ঘটনার যাতে উদ্ভব না হয় এবং একই সঙ্গে হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জানান। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতা জি.এম কাদের সংখ্যালঘুদের প্রতি হামলার তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। জনাব কাদের জনকণ্ঠকে জানান, সংখ্যালঘুরা আমাদের ভাই। তাদের ওপর হামলা বর্বরতার শামিল। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গতরাতে জনকন্ঠকে জানান, আইন যে হাতে তুলে নেবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হোক। প্রত্যেক দোষীর শাস্তির দাবিতে জামায়াতে ইসলামী আপোসহীন। তিনি দাবি করেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মতো জঘন্য ঘটনার সঙ্গে তার দল জড়িত হতে পারে না। বরং যারা হামলার শিকার হয়েছে তাদের কাউকে কাউকে জামায়াত শেল্টার দিয়েছে, রক্ষা করেছে। এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানায়। বারাবার অবস্থা হচ্ছে এই যে, অনাকাঙ্খিত এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। আর তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সারা দেশে নির্বাচনপরবর্তী হামলার অসংখ্য অমানবিক বিবরণ তুলে ধরে অবিলম্বে এ ধরনের হামলা বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দেশের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। শুক্রবার পরিষদের নেতৃত্ববৃন্দ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই দাবি জানান। সাংবাদিক সম্মেলনে মেজর জেনারেল(অবঃ) চিত্তরঞ্জন দত্ত বীরউত্তম, ড্যানিয়েল কোরাইয়া, ডক্টর ললিত মোহন নাথ, অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক, এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অনিল নাথ, সাবিত্রী ভট্টাচার্য, কাজল দেব নাথ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করে বলা হয় যে, তত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছে। পরবর্তীকালের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রচারণা এবং ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা রাজনীতিতে ব্যবহারের ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি আরো মদদ পায়। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন নিপীড়ন ও হামলা ভয়াবহ পরিণতিতে রূপ নিয়েছে। তাঁরা সবকটি রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, তা না হলে এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি গোটা জাতিকে বিপর্যস্ত করে গণতান্ত্রিক ধারাকে রুদ্ধ করে তুলবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদের সভাপতি বিচারপতি কেএম সোবহান ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী এক বিবৃতিতে নির্বাচনোত্তর দেশব্যাপি ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর হামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ হিন্দু লীগ, শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পৃথক পৃথক বিবৃতিতে প্রায় একই ধরনের দাবি জানায়। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এমএ রশীদ এক বিবৃতিতে সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ জনগনের ওপর বর্বরোচিত হামলার তীব্র প্রতিবাদ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬ অক্টোবর ২০০১