নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলার উত্তর ধানডোবা, বাগিশেরপাড়, ইল্লা, খাঞ্জারপুর, বিল্বগ্রাম ও জঙ্গলপট্টিতে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। এই ৬টি গ্রাম সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে ত্রাস ও আতঙ্কে পরিবারের বয়োবৃদ্ধ ছাড়া অন্য সবাইকে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, চাঁদাবাজি,বোমা ও ধারালো অস্ত্রের আঘাত এবং শালীনতাহানী, নারী নির্যাতনের ঘটনা সেখানে পরিণত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়। গত শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ঐ সব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দুই শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরবাড়িতে কোন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী এক কথায় উঠতি বয়সের কোন নারী-পুরুষকে প্রকাশ্যে এমনকি ঘরের আড়ালে আবডালেও দেখা যায়নি। যেসব বয়োবৃদ্ধ বদ্ধঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারাও বদ্ধদ্বারে কারো করাঘাত অথবা আঙিনায় কোনো অচেনা আগন্তুকের আগমনে কেঁপে ওঠেন অজানা আতঙ্কে। এসব অঞ্চলে কমপক্ষে ১৭টি সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজন ঘরদুয়ারে তালা মেরে চলে গেছে এলাকা ছেড়ে। আশ্রয় নিয়েছে ভিন্ন গাঁয়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে। নির্বাচনের পরেরদিন ১ অক্টোবর দুপুরে ৪ দলীয় জোটের বিজয় নিশ্চিত হতে না হতেই উত্তর ধানডোবায় প্রকাশ্যে মহড়া দিয়ে ঢুকে পড়ে বিএনপির সমর্থনে সশস্ত্র ক্যাডাররা। নিতাই, নিখিল, জীবন তালুকদার, রাখাল কর্মকার, যুধিষ্ঠির, হরিপদ, জয়ধর, বিশ্বনাথ, নগেন হালদারের বাড়ি আক্রান্ত হয় দিনদুপুরেই। চলে ব্যাপক ভাঙচুর। একই দিন সন্ধ্যায় সন্ত্রাসীরা নিতাই,নিখিল ও জীবন তালুকদার এবং রাখাল কর্মকারের ঘরবাড়ি লুট করে। ২ অক্টোবরেই ইল্লা গ্রামে হামলা চালায় শতাধিক বিএনপি ক্যাডার। যুবলীগ নেতা বাবু দত্তের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট হয়। বাবু দত্তের পিতা পরেশ দত্তের ওষুধপথ্য নিয়ে যায় হামলাকারীরা। এ পরিবার এলাকায় কাপালী সম্প্রদায়ভুক্তদের মালামাল গচ্ছিত রাখত। সন্ত্রাসীরা মণকে মণ ওজনের পিতল-কাঁসার হাঁড়ি-পাতিল-ডেকচি-কড়াই, থালা-গামলা-সহ ৪ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় হিংস্র উল্লাসে। তাদের বাড়িঘরের ঠাকুরের পূজার আসন থেকে বৈদ্যুতিক ও ক্রোকারিজ মালামাল পর্যন্ত সবকিছু লুটপাট, ভাঙচুর হয়। স্বচক্ষে না দেখলে এ তাণ্ডবের ভয়াবহতা বর্ণনায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। একই দিনে বাগিশেরপাড় গ্রামে ভাঙচুর লুটপাট হয় সুরেন তপাদার এবং এডভোকেট নিত্যানন্দ তপাদারের ঘরবাড়ি। ৩ অক্টোবরে খাঞ্জারপুর গ্রামের নন্দলাল দত্ত, অখিল দাস, মনোতোষ ও বিভুতিরঞ্জনের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট হয়। ৪ অক্টোবরে বাগিশেরপাড় গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি আবারো আক্রান্ত হয়। এবার ক্যাডাররা নৌকাযোগে এসে সুনিল তপাদার, নারায়ণ দাস, সত্য মাষ্টার, চিত্ত মজুমদার প্রমুখের ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে লুট করে নিয়ে যায় বছরের খোরাকি ও বীজ তৈরির ধান, ৮ মণ পাট, টেলিভিশন,জামা-কাপড় এমনকি শাড়ি-ব্লাউজ-সায়া লুঙ্গি-গামছা পর্যন্ত। ৫ অক্টোবর ধানডোবা গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে নিরঞ্জন বাড়ৈ ও বলরাম তালুকদারের ঘরবাড়ির রেডিও-টিভি, টাকা পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, কাপড়চোপড়, এমনকি ধান-পাট-টর্চ লাইট পর্যন্ত লুটে নিয়ে নৌকা ভর্তি করে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। তালুকদার বাড়ির এক গৃহবধূকে জোর করে ঘরের বাইরে তুলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে ফেলে রেখে যায়। হামলার সময় গ্রামটি ছিল সংখ্যালঘু পুরুষশূন্য। এ গ্রামের জীবন তালুকদার, নিখিল, কৃষ্ণ বাহার, জয়হরি, নিরঞ্জন বৈদ্য, রাখাল, যুধিষ্টির, পরিতোষ তালুকদার, জয়ধরের মতো লোককে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ত্রাস ও আতঙ্কে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। শিখা তালুকদার ও সীমা (স্নাতক), উন্নতি (উচ্চ মাধ্যমিক), সুমতি, জয়ন্তি ও কোকা (মাধ্যমিক), অঞ্জনা ও হাসি হালদারের (৮ম শ্রেণী) মতো স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরী-তরুণী, রুপা ও মায়ার মতো তরুণীরা এই এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে আরেক গ্রামে। ৬ অক্টোবর ধানডোবার হিন্দু সম্প্রদায়ই নয় হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের ওপর হামলা চলে। এলাকার খ্রিস্টান যাজক বাংলাদেশ চার্চের তত্ত্বাবধায়ক জয়ন্ত মণ্ডলের কোয়ার্টারে হামলা চালিয়ে দিনে দুপুরে লুটপাট করে নিয়ে যায় নগদ টাকা পয়সা, স্বর্ণালঙ্কারসহ অন্য মালামাল। ১০ অক্টোবর গভীর রাতে খাঞ্জারপুরের এক ঘরে ঢুকে ৪ সন্তানের জননীকে ধর্ষণ করে দুই পাষণ্ড। স্বামীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এই পাশবিক নির্যাতন চালানোর সময় অজ্ঞান ও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে গৃহবধুটি। সকালে পাড়া প্রতিবেশীরা ঘটনাটি জানতে পেরে কেউ তামাশা, কেউ সহানুভূতির ছলে ভিড় জমায় ঐ বাড়িতে। থানায় গিয়ে ধর্ষিতা অভিযোগ করা সত্ত্বেও ধর্ষকদের কেনো চিনতে পারলোনা এই অজুহাতে ধর্ষণ মামলা না নিয়ে মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াই শুধু জিডি এন্ট্রি করে পুলিশ বাড়ি পাঠিয়ে দেয় ধর্ষিতাকে। খাঞ্জারপুর গ্রামের পুরোহিত ঠাকুর কালু চক্রবর্তী, সুধীর মালো, মদন চক্রবর্তী, গোবিন্দ মালোর মতো সংখ্যালঘুরা ঘরবাড়ি ছেড়ে সন্ত্রাসীদের ভয়ে সপরিবারে চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। বিলগ্রামের সূর্য কাপাসীর ঘর ও নাগের বাড়ির কোন ঘরেও বয়োবৃদ্ধ ছাড়া কোন উঠতি বয়সের নারী-পুরুষও নেই। গত ৫ অক্টোবর ঐ গ্রামে পরিমল নাগের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা করে গভীর রাতে। এখানেও ধর্ষিত হয় একজন। একই দিনে স্থানীয় স্কুলের পাশে কেশব রায় (৮০), মধূসুদন (৩২), কিরণ দাস (৬২) সহ কয়েকজন সংখ্যালঘুকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য বেদম মারপিট করে ক্যাডাররা। সন্ধ্যায় হামলা চালায় অজয় কুমার গোস্বামীর বাড়িতে। ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট ছাড়াও অজয়ের মিস্ত্রী সাজুকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। এর পর পরিবারের লোকজনসহ অন্য সংখ্যালঘুরাও এলাকা ছেড়ে চলে যায়। গত ৪ অক্টোবর মঙ্গলপট্টি গ্রামে দুলাল সোম, কৃষ্ণ মিস্ত্রী, গোবিন্দ দে, বিমল নন্দী, প্রিয়লাল নন্দী, জয়দেব পাল, হরিদেব, প্রমুখের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে বিএনপি ক্যাডাররা। বিল্ব গ্রামের দুলাল দে, অজয় চক্রবর্তী, মঙ্গলপট্টি গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু পরিবার ত্রাসে এলাকা ছেড়েছে। সরজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার দর্শনা, শশিকর, নবগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে গৌরনদীর সংখ্যালঘু পরিবারের নারী-শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে গেছে কোটালীপাড়ার নাইয়াকান্দি, পীড়েরবাড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে। এসব এলাকায় প্রায় প্রতি ঘরেই গৌরনদীর সংখ্যালঘু পরিবারের কোনো না কোনো শরণার্থী রয়েছে। বিশেষ করে গৌরনদীর বাফাই, বিশ্বগ্রাম, চাঁদনী, ইল্লা, পতিহারের লোকজন বেশি আশ্রয় নিয়েছে। দর্শনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশেপাশের বাড়িতেও ২ শতাধিক সর্বস্বান্ত মানুষ রয়েছে। নাইয়াবাড়ি এলাকায় দেখা হয়েছে গৌরনদীর বাকাই এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য সুধীর বাবুর সঙ্গে। পীরের বাড়িতে গৌরনদীর বাকাই গ্রামের প্রভাতী মহিলা সমিতির কর্মী গীতা ও শিখা তালুকদার, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল বাজারে গৌরনদীর বিল্ব গ্রামের মিথুন কর, রাজিহারের ইউপি সদস্য শেফালীর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে আমাদের। রামশীলে গৌরনদীর বিভিন্ন এলাকার ৫০/৬০ ঘর লোক রয়েছে আত্মগোপন করে। আবারো সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় প্রশাসন জোর করে ফেরত পাঠাতে পারে এই ভয়ে গৌরনদীর শত শত সংখ্যালঘু পরিবার এসব এলাকায় আশ্রয় গ্রহণের পর আবারো সরে গেছে অজ্ঞাত স্থানে, আরো নিরাপত্তার সন্ধানে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে ‘খুঁজেও’ তাদের দেখা পাননি। প্রশাসন বা বিএনপি সমর্থক সংখ্যালঘুদের বক্তব্য যে বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল মন্ত্রীর। স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে জনসভায় ভাষণ আর ঢাকা ফিরে এসে প্রেস ব্রিফিং করে দায়িত্ব শেষ করায় এলাকায় কাঙ্খিত নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তোলা যায়নি মোটেই।
ভোরের কাগজ, ২০ অক্টোবর ২০০১