৭ আগস্ট শুক্রবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারকে বিদেশে নির্বাসিত ব্লগার আসাদ নূর ও অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীদের দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও মানবাধিকার রক্ষার কাজটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলােতে, অনেক ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মীকে বাংলাদেশে নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছে, যারা বর্তমানে প্রবাসে থেকে তাদের কার্যক্রম চালাতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এখন নির্বাসিত মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠরােধে দেশে থাকা তাদে পরিবারবর্গকেও হয়রানি শুরু করছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া। বলেন, “প্রবাসে নির্বাসিত মানবাধিকার কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করা অত্যন্ত গর্হিত, নিন্দনীয় একটি কাজ। সরকার-কর্তৃক মানবাধিকার কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানাের এ অপকৌশল অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।”
“এর বদলে সরকারের উচিত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলাে খতিয়ে দেখা, এবং এ জাতীয় ঘটনা রােধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরকারকে মানবাধিকার কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং মানবাধিকার লংঘনকারিদের বিরুদ্ধে দ্রুত, স্বাধীন তদন্ত । পরিচালনা করে অপরাধীদের বিচারের মুখােমুখি করতে হবে,” সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন।
উল্লেখ্য, গত জুলাই মাসে ব্লগার আসাদ নূর চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরকে নিপীড়নের প্রতিবাদে একাধিক ভিডিও ব্লগ প্রকাশ করেন। গত ১৪ জুলাই তারিখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতা “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা” ও “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী কার্যক্রম পরিচালনা করার অভিযােগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আসাদের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে যে, ১৪ জুলাই মধ্যরাতে আমতলী থানা পুলিশ আসাদের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী গ্রামে আসাদের খোঁজে হানা দেয় এবং আসাদকে না পেয়ে (আসাদ প্রবাসে থাকায়) তার বাবা-মাকে হয়রানি করে গত ১৬ জুলাই।
পুলিশ আবারাে আসাদের বরগুনার বাড়িতে হানা দেয়। গত ১৮ জুলাই সকালে পুলিশ পুনরায় আসাদের বাড়ি গিয়ে তার বৃদ্ধ বাবা তােফাজ্জল হােসেন, মা রাবেয়া বেগম, দুই বােন (এক বােন। অপ্রাপ্তবয়স্ক), এবং অন্য দুই আত্মীয়কে কোন আনুষ্ঠানিক অভিযােগ বা সমন ছাড়াই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ৪০ ঘণ্টা থানায় আটকে রাখে এবং পরদিন ১৯ তারিখ রাতে ছেড়ে দেয়।
থানায় আটক হওয়া পরিবারের সদস্যদের একজন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানান যে, পুলিশ তাদের কাছে আসাদ নূরের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়েছে এবং তার বাবা-মাকে সতর্ক করে দিয়েছে যে আসাদ যাতে সরকার বিরােধী কিংবা সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ হয়ে । কিছু না লিখে। এছাড়া আসাদ যাতে তার সকল ব্লগ পােস্ট মুছে দেয় সে বিষয়েও তার বাবা-মাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানতে পারে যে, এর পরবর্তীতে পুলিশ আরাে অন্তত দুই বার আসাদের পরিবারকে হয়রানি করে। সর্বশেষ ৪ আগস্ট তারিখে আমতলী থানা পুলিশ আসাদের বাবা তােফাজ্জল হােসেনকে পরদিন ৫ আগস্ট বিকেল ৪টায় থানায় যেতে বলে। কথামতাে তােফাজ্জল হােসেন থানায় গেলে তাকে জোরপূর্বক রাত ১১টা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়, যেখানে আসাদ যাতে সরকার বিরােধী কথাবার্তা কিংবা সংখ্যালঘু বৌদ্ধ । ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ নিয়ে কিছু না লিখে সে বিষয়ে পুনরায় নিশ্চয়তা নেওয়া হয় এবং কথা না শুনলে জেলে পুরার হুমকি প্রদান করা হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “আসাদ নুর-এর পরিবারকে হয়রানি কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রবাসে নির্বাসিত মানবাধিকার কর্মীদেরকে বিভিন্ন উপায়ে ভয়ভীতি দেখানাের যেসব উদ্বেগজনক ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে আসছে, এটি তারই ধারাবাহিকতা মাত্র।”
উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল ২০২০ তারিখে, সামরিক গােয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর লােকজন। সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল-এর সিলেটের বাসায় গিয়ে তার বৃদ্ধ মা-কে হয়রানি করে এবং সতর্ক করে দেয় যে তাঁর ছেলের কর্মকাণ্ড দেশের সুনাম ক্ষুন্ন করছে”। গত ২২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে নােয়াখালীর দাগনভূঞা থানার পুলিশ জনৈক প্রবাসীর (নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ করা হয়নি) ফেসবুকে লেখালেখির কারণে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার মা-কে হেনস্তা করে ও মায়ের ফোন থেকে তার সাথে কথা বলে তাকে তার ফেইসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিতে বলে, এবং যাওয়ার সময় পুলিশ তার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন সনদের মূল কপি নিয়ে যায়। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ১৩ মে ২০২০ তারিখে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন যে, বিদেশে বসে সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে” যারা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে তাদের পাসপাের্ট বাতিল করা হতে পারে।
সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু বিতর্কিত ধারার। অপব্যবহার করে সরকার কয়েক বছর ধরে অনলাইনে অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে। করােনাভাইরাস মহামারীর সময় এই নিপীড়নের মাত্রা উল্লেখযােগ্যভাবে বেড়ে গেলেও, প্রবাসে নির্বাসিত মানবাধিকার কর্মীদের দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখানাে ও হয়রানি করা একটি নজিরবিহীন, জঘন্য দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে হবে, এবং মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠরােধের প্রচেষ্টা হিসেবে কোনােভাবেই তাদের পরিবারকে হয়রানি করা যাবে না। এছাড়া সরকারকে অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করার মূল অস্ত্র হয়ে উঠা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলাে আন্তর্জাতিক মানবাধিকা আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংশােধন করতে হবে।”