যৌন নিপীড়ন টাইমলাইন | অবিশ্বাস
আয়েশা মনির উপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের মূল আসামী নাহিদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য গেন্ডারিয়া থানার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান।
 
বরাবর,
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, গেন্ডারিয়া থানা
ডিএমপি, ঢাকা।
 
শুভ বিকেল, যদিও শুভ বলার মতো পরিস্থিতি আমাদের নেই। কারণ আজ এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি যেখানে সর্বত্র ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন এবং হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। অনেকক্ষেত্রে অপরাধীরা সাজা পেলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই অপরাধীরা পাড় পেয়ে যাচ্ছে। এখানে বিচারবিভাগ এবং ভিক্টিমের মাঝে সংশ্লিষ্ট থানার একটা ভূমিকা থাকে। যেসব ক্ষেত্রে থানার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় সেখানেই ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্থ হয়। এবার আসবো একটু বিস্তারিত ঘটনায়।যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট এর পক্ষ থেকেআমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে আজ আপনাদের থানাতে এসেছি আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে। এই পর্যবেক্ষণ দুই বছরের শিশু আয়েশা মনির উপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের উপর।
 
ঘটনাটি ৫ জানুয়ারির, রাজধানীর গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন এলাকায় দুই বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। শিশু আয়েশা, দীননাথ সেন রোডের ৮২/সি/১ নম্বর বাসায় টিনশেড বস্তিতে মা-বাবা ও তিন বোনের সঙ্গে থাকতো। প্রতিদিন সকালে আয়েশার মা-বাবা কাজে যেতেন। এ সময় গেন্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ের সামনের গলিতে খেলে বেড়াত শিশুটি। অন্য দিনের মতো জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেখেলতে বের হয় আয়েশা।প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সন্ধ্যার দিকে টিনশেড বস্তির পাশের ৫৩/১/ছ বাসার চারতলা বাড়ি থেকেআসামী নাহিদ এই বাচ্চাটিকে তিনতলা থেকে ফেলা দিয়ে হত্যা করেছে।আয়েশার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। এলাকাবাসী দ্রুত আয়েশাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। কর্তব্যরত ডাক্তার আয়েশাকে মৃত ঘোষণা করে, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্তের পর রবিবার জুরাইন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।ঘটনার পর পরই এলাকাবাসী এর প্রতিবাদে থানা ঘেরাও করেন।এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে আসামী নাহিদকে গ্রেফতার করতে গেলে পালানোর চেষ্টা করে আহত হয় এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ৭ জানুয়ারি শিশুর বাবা ইদ্রিস আলী বাদী হয়ে গেন্ডারিয়া থানায় একটি মামলা করেন। গেন্ডারিয়া থানা মামলা নং ০৪ তারিখ ০৭/০১/১৯ ইং ধারা ৩০২/৩৪ পেনাল কোডে রজু হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, মামলার চার্জশিট এখনো দেয়া হয়নি।
 
আমরা নাহিদের ব্যাপারে যতোটুকু খোঁজ নিয়েছি তা এখানে উল্লেখ করছি। নাহিদ পুরান ঢাকার ইসলামপুরে ব্যবসা করত। তবে বর্তমানে সে ব্যবসা করেনা। দীননাথ সেন রোডে নিজের ভাইয়ের কিনে দেয়া ফ্ল্যাটে থাকে সে। নাহিদ উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে আবার বিয়ে করে।দ্বিতীয় স্ত্রী নাহিদের সংসার ছেড়ে চলে গেছে।আমরা গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জেনেছি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদ ওই শিশুকে ধর্ষণের উদ্দেশে অপহরণ এবং পরে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছে। প্রথমে সে কৌশলে পুলিশের কাছে ওই ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা এড়িয়ে যায়। তবে তার বাড়ি থেকে ওই শিশুর প্যান্ট এবং পুতুল উদ্ধার করার পর সে সব স্বীকার করে নিয়ে ঘটনার বিবরণ দেয়। আয়েশাকে খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় নাহিদ। ভয়াবহ নির্যাতনের পর সন্ধ্যার দিকে ফ্ল্যাটের খোলা বারান্দা থেকে আয়েশাকে নিচে ফেলে দেয় নাহিদ। এক্ষেত্রে নাহিদের মেয়ের জবানবন্দিতেও এই হত্যার বিষয়টি ফুটে উঠেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম তা নিশ্চিত করেছে। নাহিদের মেয়েকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসে আরো ঘটনা। আদালতেও সে সাক্ষী হিসেবে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয়। ঘটনার সময় নাহিদের মেয়ে বাড়িতেই ছিল। কান্নার শব্দ শুনে সে বাবার ঘরে ঢুকে একটি বাচ্চা শিশুকে তার বাবার কোলে বসানো দেখতে পায়, বাচ্চাটা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য তখন কাঁদছিল। ওই ঘটনা দেখে মেয়ে সেখান থেকে চলে আসে। এরপর আর ছোট্ট আয়েশাকে দেখেনি নাহিদের মেয়ে। এদিকে গত ৯ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী জোনের ডিসি ফরিদ আহমেদ ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, “বাচ্চাটির কান্নাকাটি শুনে নাহিদ বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে। কয়েক মিনিট পরে সে তাকে তিন তলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।”এদিকে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুব আলম বলেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। প্রাথমিকভাবে আয়েশার শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। ধর্ষণ হয়েছে কিনা- তা ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যাবে। কিন্তু শিশু আয়েশাকে গোসল করানোর সময় তার যৌনাঙ্গে স্পষ্টত ক্ষত ছিলো যা প্রমাণ করে শিশু আয়েশাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
 
যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট এর পক্ষ থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে কিছু তথ্য যা আমরা শেয়ার করছি এবং এর বিরুদ্ধে আপনাদের সহযোগিতামূলক অবস্থান আশা করছি। যেহেতু আসামী পক্ষ আর্থিকভাবে অনেক শক্তিশালী তাই আমরা গেন্ডারিয়া থানা বরাবর আমাদের এই দাবীসমূহ উপস্থাপন করছি যেনো বিচার ভিন্নখাতে প্রবাহিত না হয়। কারণ আমরা সবাই জানি, বিচারবিভাগ এবং ভিক্টিমের মাঝে সংশ্লিষ্ট থানার চার্জশিটের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দাবীসমূহ নিম্নরুপঃ
 
১।হত্যাকান্ডের পরপরই আসামী নাহিদকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্থ’ হিসেবে প্রমাণের এক অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে যা সর্বোচ্চ সাজার ক্ষেত্রে চরম বাধা। আদালতের আদেশ বা মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়া একজন ধর্ষণ ও খুনের মামলার আসামীকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্থ’ বলা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাই চার্জশিটের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা এ ব্যাপারে যেনো সজাগ দৃষ্টি রাখেন
 
২। হত্যাকান্ড ঘটার সময় ‘আই উইটনেস’ যারা ছিলেন তাদের জবানবন্দি নেয়া এবং তাদের নিরাপত্তার দিকটি খেয়াল রাখা। আমরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি তিন তলা থেকে আয়েশা মনিকে ফেলে দেবার সময় অন্য ভবন থেকে দেখা ‘আই উইটনেস’ হিসেবে যে পরিবারটি ছিলো তারা এখন সেখানে নেই। এতে আসামীদের কোন প্রভাব আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। যে শিশুরা এই ঘটনাটি দেখেছিল ‘আই উইটনেস’ হিসেবে তাদের সাক্ষ্য এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা রাখছি তা চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
 
৩। মামলার আলামত হিসেবে ‘ক্রাইম স্পট’ বা ‘সিন’ নষ্টের জন্য বেশ কিছু কাজ আসামী পক্ষ থেকে করা হচ্ছে সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
৪। পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া ভিক্টিমের অধিকার। বিভিন্ন অজুহাতে এই রিপোর্ট ভিক্টিমের পরিবারের হাতে দেয়া হচ্ছে না যা অত্যন্ত অমানবিক এবং প্রশ্নবিদ্ধ। তাই দ্রুততার সাথে জটিলতা সৃষ্টি না করে পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট ভিক্টিমের পরিবারের হাতে হস্তান্তর করা হোক।
 
৫। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশিট প্রদান করা হোক।
 
আমরা আশা রাখছি, আমাদের দাবীসমূহের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দিয়ে খুব শীঘ্রই এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে আয়েশার পরিবারকে ন্যায়বিচার প্রদানে সহায়তা করবেন। নির্যাতিত মানুষের জয় হবেই- জয় বাংলা।
 
আহবায়ক,
যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট – Students Community against Rape and Sexual Violence (SCaRSV)

মন্তব্য করুন