সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সংবিধানের অস্তিত্ব নিয়ে ঘোরতর সংশয় প্রকাশ করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও আতঙ্ক প্রকাশ করে দেশের বিবেকবান মানুষদের দ্রুত তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এ অভিমত প্রকাশ করেন। গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। স্বভাবগত কারণে অধ্যাপক চৌধুরী এক পর্যায়ে সভা ত্যাগ করলে বিচারপতি কে এম সোবহান সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক খান সারোয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন, অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, সন্তোষ গুপ্ত, সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, অজয় রায়, অধ্যাপক মীর মোবাশ্বের আলী, অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, সালমা হক, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপিকা জেরিনা রহমান খান, এরোমা দত্ত, শাহীন রেজা নূর প্রমুখ। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে এবং বিশেষ করে এর পরে এমন সব কাণ্ড হচ্ছে যাতে সভ্য মানুষের কাছে জাতি হিসেবে আমাদের মুখ দেখানোর জো থাকছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বিষয়টিই সবচেয়ে আতঙ্কের। তিনি বলেন, এখনকার অবস্থায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়েই তারা শঙ্কিত। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে এসে ধর্মান্ধতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলে তা মেনে নেওয়া হবে না। অধ্যাপক চৌধুরী আজ গঠন হতে যাওয়া বিএনপি সরকারকে কঠোর হাতে দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করার আহ্বান জানান। অধ্যাপক খান সারোয়ার মুরশিদ বলেন, সংবিধান যেন বদলে না যায়, তার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণাটি নিজ থেকেই নিজেকে দুর্বল করে ফেলেছে। অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর বলেন, যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়েছে সেখানেই বর্তমান সংকটের উৎস। তিনি এ ধারণার সরকারকে অদ্ভুত বলে অভিহিত করে বলেন, এতে তিন মাসের জন্য প্রেসিডেন্টকে দায়বদ্ধতার বাইরে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সংবিধান পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। সংবিধান পরিবর্তনের একমাত্র অধিকার জনগণের। অধ্যাপিকা পান্না কায়সার বলেন, সংবিধানকে পাকিস্তানি কায়দায় পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র চলছে। শাহরিয়ার কবিরের পেশ করা ধারণাপত্রে বলা হয় ১ অক্টোবরের নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে। সিভিল সমাজ শ্বাভাবিক কারণেই এর ফলাফল মেনে নিতে পারেনি। এতে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনার নীল নকশা অনুযায়ী প্রশাসনকে ঢেলে সাজায়। এ নীল নকশা বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনও সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এতে আরো বলা হয়, দেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কয়েকটি কেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো পর্যবেক্ষক না যাওয়ায় তাদের পক্ষে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। শহর এলাকার ভোট দেখেই তারা নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে সার্টিফিকেট দেন। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন রক্ষার জন্য এর পক্ষের শক্তিকে সর্বশক্তি সংহত করে বৃহত্তর আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রগতি নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা যেসব করণীয় সম্পর্কে একমত হন তার মধ্যে রয়েছে : ১৯৭২-এর সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাসের কুর্কীতির ডকুমেন্টেশন ও বই আকারে প্রকাশ করা, সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসের দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ ও প্রকাশ, সংগৃহীত তথ্যাদির ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা, সন্ত্রাসের বিষয়াদি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ, আন্তর্জাতিক মহলে সন্ত্রাসের স্বরূপ তুলে ধরতে ইংরেজি পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ, আইন সহায়তার ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের প্রভৃতি।
প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর ২০০১