বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের বাসিন্দা বাদল মিয়া (৫৭)। কৃষিকাজ করেই পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলেন তিনি। ৫৭ বছর বয়সে জীবনে কখনও তিনি রাজধানী শহর ঢাকায় যাননি। কিন্তু, সেই ঢাকারই এক শিশুকে ধর্ষণের মামলায় শিশু আদালতের ওয়ারেন্টের কারণে তাকে গ্রেফতার করে বরগুনা থানা পুলিশ। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে ওয়ারেন্টের বলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই ওয়ারেন্টটাই ছিল ভুয়া। কোনোরকম যাচাই বাছাই ছাড়াই ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ফলে ৩৫ দিন কারাবাস করতে হয়েছে বাদল মিয়াকে।
মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে বরগুনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাদল মিয়া। এসময় তার ছেলে, স্বজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী উপস্থিত ছিলেন।
বাদল মিয়ার অভিযোগ, স্থানীয় দালাল সাইফুল এবং ইলিয়াস ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসিয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রথম আমাকে পুলিশ যেদিন গ্রেফতার করে তারপর ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনে আমাকে সাইফুলদের বাড়িতে ৪ দিন আটকিয়ে রাখে। আমার মনে হয় আমার ক্ষতি করার জন্য পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে সাইফুল ও ইলিয়াস এই ভুয়া ওয়ারেন্ট বানিয়ে আমাকে আটক করায়। আমি জীবনে কখনও ঢাকা যাইনি অথচ সেই ঢাকারই একটি শিশু ধর্ষণ মামলায় আমাকে ৩৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে। যারা আমার সাথে প্রতারণা করে আমাকে জেল খাটিয়েছে আমি সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সেই সঙ্গে সরকারের কাছে দাবি জানাই, যাতে আর কোনও নিরাপরাধী এভাবে ভুয়া ওয়ারেন্টে জেল না খাটে। সেই জন্য পুলিশ প্রশাসনকে আরও তৎপর হয়ে ওয়ারেন্টটির সত্যতা নিশ্চিত করে তবেই কাজ করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর বরগুনার সদর থানা পুলিশের এএসআই সাইফুল ইসলাম ঢাকার শিশু আদালতের ৯(১) ধারায় দায়ের করা শিশু ধর্ষণ মামলায় একটি ওয়ারেন্টের বলে বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করেন। থানায় স্থানীয় পুলিশের সোর্স ইলিয়াস ও সাইফুলের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে নেয় বাদলের স্বজনরা। এর অল্প কিছুদিন পর ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পুনরায় একই মামলার ওয়ারেন্টে বরগুনার সদর থানার আরেক এএসআই নাইমুর আবারও গ্রেফতার করেন বাদল মিয়াকে। এ পর্যায়ে কোনও মীমাংসা না হলে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠায় পুলিশ। এরপর বাদল মিয়ার ছেলে বাবাকে মুক্ত করার জন্য ঢাকা গিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন ঢাকা জজ কোর্টে শিশু আদালত বলতে কোনও আদালত নেই। সেখানে নয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে যেগুলো শিশু আদালত হিসেবে কাজ করে। এর কোনও আদালতেই বাদল মিয়ার বিরুদ্ধে যে ওয়ারেন্টের কাগজ দেখানো হয়েছে সেই মামলার উল্লেখ নেই। ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু আদালতে তন্ন তন্ করে খুঁজেও মামলাটির কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে বরগুনার সিনিয়ার জুডিশিয়াল আদালতের বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে আদালতের বিচারক বিষয়টি আমলে নিয়ে বাদল মিয়াকে মুক্তি দেন।
মামলার ওয়ারেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওয়ারেন্টে মামলা নম্বর হিসেবে লেখা হয়েছে জি.আর ৪২৫/১৭ ও শিশু-৮৯০/১৮ এছাড়াও অপরাধ হিসেবে লেখা হয়েছে শুধু ৯(১) ধারা। পাশাপাশি মামলা নম্বরে ২০১৭ সাল উল্লেখ থাকলেও বিচারকের স্বাক্ষরের স্থলে তারিখ দেওয়া হয়েছে ০৪/০৪/১৪। মামলা ২০১৭ সালের হলেও ওয়ারেন্টে ২০১৪ সালের বিচারকের স্বাক্ষর বিশ্বাসযোগ্য নয়। এছাড়াও ওয়ারেন্টে আদালতের সিল থাকার কথা থাকলেও এই ওয়ারেন্টে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিল রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দাখিলকৃত ওয়ারেন্টটি ভুয়া বলে ধারণা করা হয়।
ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মনোয়ার হোসেন জুয়েল বলেন, ওয়ারেন্টে যে মামলার নম্বর উল্লেখ রয়েছে আমরা সেই নম্বর অনুযায়ী ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু আদালতে তল্লাশি চালিয়ে দেখেছি এরকম কোনও মামলার অস্তিত্ব এখানে নেই। মামলায় যে বিচারকের স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে সেই স্বাক্ষরটিও জাল। এতে প্রতীয়মান হয় যে ওয়ারেন্টটি সম্পূর্ণ ভুয়া।
এ বিষয়ে প্রথম গ্রেফতার করা এএসআই সাইফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও পুলিশের সোর্স সাইফুল ও ইলিয়াসের মোবাইল ফোনে কল করে তাদের পাওয়া যায়নি।
তবে একটি ভুয়া ওয়ারেন্টে দ্বিতীয়বার একই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেও অনুশোচনা নেই বরগুনা থানায় কর্মরত এএসআই নাঈমুর রহমানের। তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তার থানার ওসিও।
নাঈমুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে বাদল মিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা বরগুনা থানায় এসেছে। তখন আমি পিরোজপুরে কর্মরত ছিলাম। আমি বরগুনা থানায় যোগদান করেছি গত বছরের ৬ নভেম্বর। সে হিসেবে আমি যোগদান করার ২ বছর আগেই বরগুনা থানায় বাদল মিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা আসে। তাই আদালতের আদেশ অনুযায়ী বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করে আমি আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করি।
তিনি আরও বলেন, বাদল মিয়া নিভৃত গ্রামের একজন মানুষ। তিনি বা তার পরিবারের কারও সঙ্গেই আমার কোনোরকম পরিচয় কিংবা যোগাযোগ ছিল না। শুধু গ্রেফতারের জন্যই তাকে আমি খুঁজেছি। এখানে আমার কোনও দোষ নেই। তিনি শুধু শুধুই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন।
আর বরগুনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে, এম, তারিকুল ইসলাম বলেন, অন্যসব গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির মতোই বাদল মিয়াকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এখানে পুলিশের কোনও দোষ নেই। কেননা সব ক্ষেত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না পুলিশের পক্ষে।
তিনি আরও বলেন, যে বা যারা পুলিশের সঙ্গে প্রতারণা করে একজন নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করেছেন, তাদের খুঁজে বের করতে ইতোমধ্যে আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। শিগগির তাদের আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হবো।
ওয়ারেন্ট পেয়েই প্রথমবার এএসআই সাইফুল ইসলাম বাদল মিয়াকে ধরে এনে টাকা নিয়ে থানা থেকে কীভাবে ছেড়ে দিলো সে প্রশ্নের জবাবও দেননি ওসি।