বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবিরের আটকাদেশের মেয়াদ সরকার আরও ৯০ দিন বৃদ্ধি করেছে। এদিকে আদালতে তাঁর জামিনের আবেদন তৃতীয়বারের মতো নাকচ হয়। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মেরাজ হোসেনের আদালতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের জামিনের আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে শাহরিয়ার কবিরের পক্ষে বিশিষ্ট আইনজীবী সাহারা খাতুন, বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, সাবেক পিপি কামরুল ইসলাম, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি মিজানুর রহমান মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক মোমতাজউদ্দিন মেহেদী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আব্দুল মান্নান, অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম, সুধীর কুমার হাজরাসহ প্রায় শতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। অপরপক্ষে জামিনের বিরোধিতা করেন পিপি আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান, অতিরিক্ত পিপি খোরশেদ আলম ও কোর্ট ইন্সপেক্টর আলফা জামান নকীব। উভয়পক্ষই প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী শুনানিতে অংশ নেয়। বেলা ১টায় কড়া পুলিশ পাহারায় হাতকড়া পরা অবস্থায় আদালতে আসামীদের কাঠগড়ায় শাহরিয়ার কবিরকে হাজির করা হয়। আদালতে উপস্থিত শাহরিয়ার কবিরের স্ত্রী ফাতেমা কবির, পুত্র অপর্ণ কবির, কন্যা অর্পিতা কবির, ভাই কালান্দিয়ার কবিরসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে শাহরিয়ার কবিরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। এই সময় শাহরিয়ার কবির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, অনেক দাগী খুনী, চোর, ডাকাতের পরিবারের সদস্যরা কারাগারে এসে দেখা-সাক্ষাত করছে। অথচ প্রায় এক মাস গত হলো আমার পরিবারের কোন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাত করতে দেয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ও অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুমকে সাক্ষাত করতে দেয়া হয়নি। শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, কারাগার থেকে খুনী, চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীর সঙ্গে একই প্রিজন ভ্যানে করে তাকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার পুত্র-কন্যা এই অবস্থা দেখে অবাক ও আশ্চর্য হয়ে বলে, এ দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে কি লাভ হলো! এর বিনিময়ে এই পুরস্কার! তখন আমি তাদের কোন উত্তর দিতে পারিনি। এ কথা বলে শাহরিয়ার কবির আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠেন- এটা নির্মম নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার। জামিনের শুনানিকালে আদালতে আইনজীবীরা বলেন, শাহরিয়ার কবিরকে আটক করার সময় কিছু আলামত পুলিশ জব্দ করে। তার মধ্যে ভিডিও ক্যাসেট, সিডি ইতোমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এগুলোতে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কোন আলামত না থাকায় সরকারের ইচ্ছামতো এগুলোর পরিবর্তন করা হয়। শাহরিয়ার কবির ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে তাঁর দেশপ্রেমই প্রকাশ পেয়েছে। শাহরিয়ার কবির মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজে লিপ্ত হওয়া মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। শাহরিয়ার কবির গত ৩০ বছর এ দেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তিনি ৭০টি গ্রন্থের রচয়িতা। তার মধ্যে ৩০টি বই রয়েছে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য “বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা” দক্ষিণ এশিয়ার মৌলবাদ ও বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবুর রহমান। আইনজীবীরা বলেন, বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকার বর্তমানে ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী নিজামী ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। এই ঘৃণা প্রকাশ করে তাঁদেরকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি প্রদান ঘোষণা করেন। বর্তমানে তাঁরা সরকারের অংশীদার হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে হয়রানি করছেন। আইনজীবীরা আরও বলেন, ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর চারদলীয় জোটের সমর্থকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের শারীরিক-পাশবিক নির্যাতন, মালামাল লুটপাট ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে-তা দিবালোকের মতো সত্য। তার প্রমাণ হিসাবে আইনজীবী উল্লেখ করেন সাম্প্রদায়িক নির্যাতন অত্যাচার বন্ধের জন্য দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে। হাইকোর্ট সরকারকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়। অপরদিকে সরকার সংখ্যালঘু অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে এই ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করেছে। আদালতে আরও জানানো হয়, শাহরিয়ার কবির এক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। উন্নততর চিকিৎসার জন্য যে কোন শর্তে তাঁর জামিনের জন্য আদালতে আবেদন জানানো হয়। এই আবেদনের বিরোধিতা করে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়, শাহরিয়ার কবির গত ৬ নবেম্বর কলকাতায় থেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় অঞ্চল সফর করেন। তিনি তথাকথিত বাংলাদেশ উদ্বাস্ত কল্যাণ পরিষদের নাম করে বাংলাদেশী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কথিত নির্যাতনের বিষয়ে প্ররোচিত করেন। গত ৮ নবেম্বর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে শাহরিয়ার কবির বলেছেন যে, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের চরমপন্থীরা সংখ্যালঘু হিন্দুদের চরম নির্যাতন করছে। তিনি এ বিষয়ে সংগৃহীত তথ্যাদি শ্বেতপত্রের আকারে প্রকাশ করবেন। শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক এমন কিছু জনসাধারণকে প্রভাবিত করে তাদের সমাবেশে সীমারেখা মানছি না, মানব না ইত্যাদি শ্লোগান দ্বারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব বা বিলোপে সমর্থন করেন। তাঁর কৃতকর্মে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের তথা রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতা সৃষ্টি করার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি এ মুহূর্তে জামিনে মুক্তি পেলে মামলার তদন্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বলে সরকারী কৌঁসুলিগণ শাহরিয়ার কবিরের জামিনের আবেদন নাকচ করার জন্য আবেদন জানান। আদালত উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশ দেয়। শাহরিয়ার কবির আদালতে জানান, গত বুধবার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক পত্রে তাঁকে জানানো হয় যে, তাঁর আটকাদেশের মেয়াদ আরও ৯০ দিনের জন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ ডিসেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন