নাশকতার টার্গেট নিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করছে জঙ্গিরা। পাশাপাশি জামায়াতের একটি চক্রও বিভিন্ন উৎস থেকে ভারি অস্ত্র সংগ্রহের মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। রিপোর্ট দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার।

৮ জুলাই ২০১৯-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় পুলিশ সম্প্রতি একে-২২ রাইফেলসহ দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। আটককৃত জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটন করে।

পুলিশের ভাষ্যমতে, নাশকতার উদ্দেশ্যে জামায়াত-শিবিরের একটি গ্রুপ চট্টগ্রাম রুট ব্যবহার করে অন্য দেশ থেকে একে-২২ রাইফেল তিনটি দেশে আনে।

গোয়েন্দাদের অভিযানে তিনটি অস্ত্রের মধ্যে একটি উদ্ধার হয়েছে। এই অস্ত্র কেনাবেচা এবং হাতবদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছয়জনই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় একে-২২ মডেলের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা ইউনিট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গি ও সরকারবিরোধী চক্র চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম রুট ব্যবহার করে ভারি অস্ত্র আনছে। তারা যশোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়েও অস্ত্র ও বিস্ফোরক আনছে। গত কয়েক বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একে-২২ ও এমকে-১১ মডেলের মতো শক্তিশালী শতাধিক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি অস্ত্র ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছে। তাদের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে অস্ত্র যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে। একাধিক সংস্থা সরকারকে বিষয়টি অবহিত করেছে। গোয়েন্দারা বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অবৈধ এই কারবারে জড়িয়ে পড়ারও তথ্য পেয়েছেন।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট বলছে, শুধু একে-২২ রাইফেলই নয়, চলতি বছর পুলিশের জঙ্গি দমন ইউনিট রাজধানীতে পরিচালিত দুটি অভিযানে ৭৫টি ডেটোনেটর উদ্ধার করে। ডেটোনেটর গ্রেনেড তৈরির প্রধান উপকরণ।

একটি ডেটোনেটর দিয়ে একটি শক্তিশালী গ্রেনেড তৈরি করা সম্ভব। সীমান্তের ওপার থেকে আসা এসব ডেটোনেটর দিয়ে প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা শক্তিশালী গ্রেনেড তৈরি করে। গুলশানের হলি আর্টিজান হামলায় দেশে তৈরি গ্রেনেড ব্যবহার করেছিল।

সিটিটিসি’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নাশকতার উদ্দেশ্যে জামায়াত-শিবিরের একটি চক্র চট্টগ্রাম রুটকে ব্যবহার করে দেশে তিনটি একে-২২ মডেলের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসে। এর মধ্যে ৩০ জুন রাজধানীর স্বামীবাগে অভিযান চালিয়ে একটি একে-২২ রাইফেল এবং ৩০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। অস্ত্র হাতবদলের সময় কামাল হোসেন ও সাইদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে রুবেল নামে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে দুইজন জানিয়েছে, তারা একটি গ্রুপের কাছে অস্ত্রটি পৌঁছে দিতে এসেছিল। এই অস্ত্রের মালিক বাবুল উদ্দিন ও সাদেক আহম্মেদ। তাদের কাছ থেকে অস্ত্রটি কিনতে এসেছিলেন কাজী গোলাম কিবরিয়া ও মো. হাসিব। বাবুল উদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগরের জামায়াত নেতা। তার বাড়ি চট্টগ্রামের ডবলমুরিংয়ে। সাদেক যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি চট্টগ্রামের চকবাজারের বাসিন্দা। হাসিবের বাড়ি কুমিল্লায়। হাসিব চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী। কাজী গোলাম কিবরিয়া কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং স্থানীয় জামায়াত নেতা। তিনি হাসিবের বন্ধু।

গ্রেফতার হওয়া দু’জন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূলত নাশকতকার উদ্দেশ্যে অস্ত্রগুলো আনা হয়েছে। তবে অস্ত্রের উৎস এবং গন্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গ্রেফতার হওয়া দু’জন অস্ত্রের বাহক। তারা অস্ত্রটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। দুই থেকে তিন হাতবদল হয়ে অস্ত্রটি তাদের কাছে আসে। এর গন্তব্য ছিল ঢাকার আশপাশের কোনো একটি জেলায়। অস্ত্র চালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে, তারা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নাশকতার উদ্দেশ্যে হয়তো এই অস্ত্রটি আনা হয়েছে। গ্রেফতার দু’জন অস্ত্রের বাহক হওয়ায় এর উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে চট্টগ্রামের রুট ব্যবহার করে এই চক্রটি এ ধরনের আরও অস্ত্র নিয়ে এসেছে।

দায়িত্বশীল একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় একে-২২ ব্যবহার করা হয়েছিল। হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। এই অস্ত্র ভারতের মুঙ্গের শহরে তৈরি হয়েছিল।

ওই হামলার এক মাস আগে ঢাকার বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুটি একে-২২ রাইফেলসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, এ ধরনের আরও ৭-৮টি ভারি অস্ত্র হাতবদল হয়। সেই অস্ত্র গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার সময় ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া নারায়ণগঞ্জে একটি আস্তানায় অভিযানকালে নব্য জেএমবির প্রধান তামিম আহম্মেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার পর সেখান থেকেও একটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ২০১৬ সালের শুরুতে চট্টগ্রামে শহীদ হামজা ব্রিগেডের জঙ্গিদের কাছ থেকেও একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের শেষের দিকে জেএমবির জঙ্গিদের কাছ থেকে এমকে-১১ রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, দেশে আসা স্বয়ংক্রিয় ভারি অস্ত্রগুলো রূপান্তর করা। ভারতের বিহারের মুঙ্গের শহর এবং পাকিস্তানের পেশোয়ারের আদামখেলে অত্যাধুনিক মডেলের অস্ত্রগুলো রূপান্তর করা হয়। একের পর এক হাতবদল হয়ে এসব অস্ত্র ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে দেশে আসে।

যশোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে জঙ্গিরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক আনছে। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে একে-২২ মডেলের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও উদ্ধার করা হয়েছে।

সর্বশেষ ৩০ জুন রাজধানীর স্বামীবাগ থেকে একে-২২ রাইফেলসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ১৬ এপ্রিল রাজধানীর গাবতলী থেকে ২৫টি ডেটোনেটরসহ নব্য জেএমবির দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যান্টনমেন্টের একটি বাসা তল্লাশি করে অর্ধশত ডেটোনেটর, ম্যাগাজিনসহ ২টি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিনসহ দুটি শর্টগান উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক ইমরানুল হাসান বলেন, যারা অবৈধভাবে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দেশে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তাদের বিষয়ে র‌্যাব সতর্ক। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এখনও র‌্যাবের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। চট্টগ্রামসহ র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়নে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

যুগান্তর

মন্তব্য করুন