মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের ৮টি সংখখ্যালঘু পরিবার গত ১০দিন যাবত একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। হামলা, ভাঙচুর করার পর উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করে পুলিশী নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে আসায় বাড়িগুলোর মেয়েরা রান্না ঘরে চুলোয় আগুন জ্বালানো প্রায় ভুলেই গেছে। শনিবার মাদারীপুরের একদল সাংবাদিক সরেজমিন তদন্ত ও ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান করে জানতে পারেন, উপেন মণ্ডল, রাজেন্দ্র মণ্ডল, শ্রীমতি হালদার ও পণ্ডিত হালদার গং প্রায় এক শ’ বছর পূর্বে থেকে বাজিতপুর ইউনিয়নের নয়াকান্দি মৌজার ১৫৯ নং খতিয়ানে নং দাগের ১ একর সাড়ে ৫৪ শতাংশ জমি ভোগদখল করে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। কালচক্রে উপেন মণ্ডল গংয়ের দলিলের শরিকানা মালিকদের সম্পত্তি ভিপি হয়ে গেলে তারা লিজের মাধ্যমে বন্দোবস্ত নিয়ে আগের মতোই বসবাস করতে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে ভূমি অফিসের এক শ্রেণী অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে এলাকার ত্রাস এলেম বয়াতী ও তার শ্বশুর (সাবেক ইউপি সদস্য) প্রভাবশালী তৈয়ব আলীর নামে সাড়ে ৫৪ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। অর্পিত সম্পত্তির লিজ গ্রহণ করেই জামাই শ্বশুর ও তাদের লোকজন ৮টি সংখ্যালঘু পরিবারকে উৎখাতের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের লিপ্ত হয়। সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের উপর একের পর এক হামলা ও মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও তাদের বিরুদ্ধে রাজৈর থানায় প্রায় ৭/৮টি জিডি করেছে। এছাড়া উপেন মণ্ডল গংয়ের পুকুরের মাছ জোর করে নেয়া ও পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধনসহ নানাবিধ অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। গত ১২ ও ১৯ জুন এলেম বয়াতী তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সংখ্যালঘুদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মহিলা ও যুবতীদের চুলের মুঠি ধরে এনে মারধর করে। গর্ভবতী মহিলারাও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মহিলাদের হাতের শাঁখা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। আহতদের চিকিৎসার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি সন্ত্রাসী চক্র। ১৯ জুনের সন্ত্রাসী হামলায় সুভাষী বাড়ৈ (৩৫), ললিতা বাড়ৈ (১৮), অমিতা বাড়ৈ (১৫) বিচ্ছাদি বৈরাগী (১৮), বাসুদেব বৈরাগী (২০), বেলোকা বৈরাগী (২৫) ও লক্ষ্মী মণ্ডল (৩২) আহত হয়। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল ঘটনাটি মীমাংসা করে দেয়ার নাম করে সংখালঘুদের নির ̄— রাখে। এলেম বয়াতী কর্তৃক সন্ত্রাসী হামলার পর উল্টো হয়রানি করার জন্য সংখ্যালঘু পরিবারের ১০ জনকে আসামী করে এলেম বয়াতী মাদারীপুর প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ঘটনার পরদিন ২০ জুন একটি মামলা দায়ের করে। সংখ্যালঘুদের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর আবার তাদেরই বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় এলাকার জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। জামাই-শ্বশুর লোকজন নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগের হুমকি দিয়ে আসছে। এক সপ্তাহের মধ্যে দেশ ত্যাগ না করলে সবাইকে কচুকাটা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে। এতে এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ঐ সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেই মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়। মামলা ও হামলার ভয়ে এ চক্রের কাছে কেউ ঘেঁষতে পারছে না বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্পিত সম্পত্তির ডিসিআর কাটা বন্ধ থাকলেও বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি লিজের নামে ̄স্থায়ী বসবাসকারী সংখ্যালঘুদেরকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে জামাই শ্বশুর ও তাদের লোকজন। উক্ত ৮টি পরিবারের ৩৭ সদস্য ১৯ জুনের সন্ত্রাসী হামলার পর প্রায় অবরুদ্ধ রয়েছে নিজ বাড়িতে। ৮টি পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ উপেন মণ্ডল (৭০) কান্না জড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের জানান, আমরা এখন ঘর থেকে বের হতে পারছি না। ক্ষেতে কাজ করতে যেতে ভয় পাই। গত দশ দিন যাবত ৮টি পরিবার প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছি। সন্ত্রাসীরা হামলার দিন আমার ও বীরেন মণ্ডলের ঘর ভাংচুর করেছে। হরিশোনার গর্ভবতী স্ত্রী বেলা রানীকে সন্ত্রাসীরা মারপিট করেছে। গৃহবধূ সুভাষী ও লক্ষ্মী রানীর শাঁখা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। গৌরাঙ্গ বাড়ৈর এক বিবাহযোগ্য কন্যার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। বলতে পারেন আমরা এখন কোথায় যাবো? খালেদা জিয়াকে বলুন আমাদের বিদায় করে দিক, আমরা আর পারছি না। দিনে একবেলা রান্না হচ্ছে জানালেন গৃহবধূ সুভাষী, লক্ষ্মীরানী বেলারানী ও সেনেকো মণ্ডল। তারা আরও জানালেন তারা রাতে ঘর থেকে বের হতে সাহস পান না। এই ৮টি সংখ্যালঘু পরিবারের একমাত্র মুসলমান প্রতিবেশী আনোয়ার (৩০) জানান, তিনি এদের পক্ষে কথা বলায় এলেম বয়াতী ও তাদের লোকজনের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। এদিকে এলেম বয়াতী ও তার শ্বশুর তৈয়ব আলী সাংবাদিকদের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঐ সংখ্যালঘু ৮টি পরিবার উল্টো তাকে ও তার শ্বশুরকে হুমকি দিচ্ছে বরং তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই আদালতের আশ্রয় নিয়েছি।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩০ জুন ২০০২

মন্তব্য করুন