জেলার দু’টি সংসদীয় আসন খুলনা-১ (দাকোপ ও বটিয়াঘাটা) এবং খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া ও ফুলতলা)-এ ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়া হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ভোট যোগাড়ের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে ভোট ভাগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভোট চাইতে গিয়ে সম্প্রদায়গত পরিচয়কে মুখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। উভয় আসনে চারদলীয় জোট মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এলাকাবাসীর। এ দুটি সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। এখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা হচ্ছেন খুলনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের পঞ্চানন বিশ্বাস, ১১ দলের সিপিবি নেতা অচিন্ত্য বিশ্বাস এবং চারদলীয় জোটের বিএনপি নেতা আমীর এজাজ খান। খুলনা-৫ আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নারায়ণ চন্দ্র এবং চারদলীয় জোটের জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ার। এই দুটো আসনেই প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু। আবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও একই গোষ্ঠীভুক্ত। এ কারণে বিরোধীরা তীব্রভাবে এই বিষয়টি উসকে দিচ্ছে।

সাধারণ ভোটারদের অভিযোগ, খুলনা-১ আসনে চারদলীয় জোট প্রার্থী গণসংযোগ, ছোট ছোট সভা, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা প্রভৃতিতে বলছেন যে, এই আসন থেকে মুসলিম প্রার্থী শেখ হারুন অতীতে জিতেছে। এবারেও অন্যতম প্রধান দুই প্রার্থী সংখ্যালঘু। ফলে তাঁদের ভোট না দিয়ে মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জেতানো উচিত। ঠিক একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে সংলগ্ন ডুমুরিয়া-ফুলতলা আসনটিতে। এখানকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ বনাম চারদলীয় জোট তথা জামাত প্রার্থী। জোটের পক্ষ থেকে ধর্মীয় পরিচয়ে ভোটার সংখ্যা উল্লেখ করে ভোট প্রার্থনা করা হচ্ছে। এই কাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার উগ্র জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ক্যাসেট বাজিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে।

নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন বক্তব্য বলা আচরণবিধির লঙ্ঘন হলেও কোন প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে কোন অভিযোগ করা হয়নি। সাধারণ মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন। তাঁরা ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। একটি আতঙ্কজনক আবহ তৈরি হয়েছে। বৃদ্ধ মফিজ উদ্দিনের মতে, ‘কি যে হবে কতি পারতিছি না; তবে হিন্দু-মোছলমান নিয়ে টানাটানির পরিণাম মোটেই ভালো না।’

এদিকে খুলনা-৪ নির্বাচনী এলাকার রূপসা ও তেরখাদা উপজেলার সংখ্যালঘু ভোটাররা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পছন্দের লোককে ভোট দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা পরিশোধ না করে কেউ পার পাচ্ছে না। ভোট গ্রহণের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতন ও হয়রানির মাত্রা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এলাকা জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভৈরব, রূপসা, আঠারোবাঁকী, আত্রাই প্রভৃতি নদী দিয়ে ঘেরা রূপসা, তেরখাদা এবং দিঘলিয়া উপজেলা নিয়ে খুলনা-৪ নির্বাচনী এলাকা গঠিত। অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ এ অঞ্চলের প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটারই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এই আসনে ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৩৪ হাজার। ফলে জয়-পরাজয়ে সংখ্যালঘু ভোটাররা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে কারণে তারা হামলা-নির্যাতন-চাঁদাবাজির সহজ শিকারে পরিণত হয়। উপরন্তু ‘৯১ ও ’৯৬র নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা জয়লাভ করেন। জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ সুজা ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়েছেন, এবারকার নির্বাচনেও তাঁর জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এ কারণে নৌকার ভোট ব্যাংক বলে পরিচিত সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী সুজার মতে, ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে না আসতে পারে সেজন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এলাকাবাসীরা অভিযোগ করেছেন, রূপসা উপজেলার চন্দনশ্রী, ভবানীপুর, শ্রীরামপুর, দেবীপুর, তিলক, নেহালপুর, আন্দাবাদ পালপাড়া, তেরখাদার আজগড়া প্রভৃতি এলাকায় সংখ্যালঘুরা হয়রানির শিকার হচ্ছে।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০ সেপ্টেম্বর ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন