নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তীকালে সন্ত্রাসীদের হামলা সহ্য করতে না পেরে এবং হামলা ও ধর্ষণের শিকার না হওয়ার জন্য বরিশাল জেলার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার উপদ্রুত হাজার হাজার মানুষ কেবল গোপালগঞ্জের রামশীলই নয়, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার অন্যান্য স্থানেও আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। আর তারা আশ্রয় নিচ্ছে আত্মীয়তার সূত্র ধরে বিভিন্ন বাড়িতে। আশ্রিতদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্রীসহ বিবাহিত-অবিবাহিত কিশোরী ও যুবতী। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দর্শনা গ্রামের ‘দে’ উপাধিভুক্ত এক ভদ্রলোকের বাড়িতে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার পতিহার, বাকাই, ইল্লা, খাঞ্জারপুরসহ অন্যান্য গ্রামের ৪০/৫০ জন আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই স্কুল, কলেজের ছাত্রী। বাড়ির গৃহকর্তার কাছে ধান আছে কিন্তু বৃষ্টির জন্য ধান সেদ্ধ করা বা শুকানো যাচ্ছে না। তাই দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। সবাইকে একবেলা আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে। গোপালগঞ্জের পীরের বাড়ি এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে ৬০/৭০ টি পরিবারের প্রায় ৩শ লোক আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন যুবতী রয়েছে। এ আশ্রিতরা অধিকাংশই ২ অক্টোবর রাত থেকে শুরু করে এক কাপড়ে ভূত-ভবিষৎ চিন্তা না করেই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে শুধুমাত্র নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। গোপালগঞ্জের নয়াবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে ৬০/৭০ ব্যক্তি। এখানে আশ্রয় নিয়েছে বাকাই, খাঞ্জাপুরের অধিবাসীরা। বিএনপি সন্ত্রাসীরা কয়েকদিন আগে খাঞ্জাপুরের বাবুদত্তের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার বৃদ্ধ পিতা ও গ্রাম্য ডাক্তার পরেশ দত্তকে নির্দয়ভাবে মারধর করে। তার পরেও পরেশ দত্ত নিজের পৈতৃক বাড়ি আঁকড়ে ছিলেন; কিন্তু সন্ত্রাসীরা তার দুই পুত্রকে হস্তান্তর অন্যথায় টাকা দাবি করে সাদা স্ট্যাম্পে জোর করে সই নেয়ার চেষ্টা করে। সন্ত্রাসীদের চাপ সহ্য করতে না পেরে পরেশ দত্ত গত ১৪ অক্টোবর গোপালগঞ্জের নয়াবাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। গোপালগঞ্জের পীরেরবাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল ব্রাক্ষণ পরিবারের এক ধর্ষিত যুবতী। এলাকার লোকজন এ খবর জানতে পেরে ঔৎসুক্য নিয়ে সেখানে যাতায়াত শুরু করলে মেয়েটিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সাতঘর জলিরপাড় এলাকায়। আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রসাদ কর্মকার বিএনপির সন্ত্রাসীদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আশ্রয় নিয়েছিলেন শশিঘরে; কিন্তুু সেখানে গিয়েও বিএনপি সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয়ায় তিনি ভারতে চলে গেছেন বলে এলাকাবাসীরা জানিয়েছে। প্রশিকা ও ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুপারভাইজার পরেশ জানান, বাকাই গ্রামের প্রশিকার ২টি, ব্র্যাকের ১টি, মাগুরা গ্রামে প্রশিকা ও ব্র্যাকের ১টি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচনের ২/৩ দিন আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। এসব বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষয়িত্রী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে এসব শিক্ষয়িত্রী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বেসরকারি সাহায্য সংস্থা পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টার নারী কর্মীরা আশ্রয় নিয়েছে পীরেরবাড়ি এলাকায়। জোৎস্না নামে একটি মেয়ে তার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে অন্যত্র; কিন্তু আশ্রয় দাতা খাবার দিতে না পারায় এরা এখন আশ্রয় নিয়েছে বৌদির পিত্রালয়ে। সরকারি প্রচারযন্ত্রে সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার বক্তব্য শুনে এসব আশ্রয় গ্রহণকারীদের মন্তব্য ওনারা এসে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন প্রকৃত অবস্থা কি?’ আশ্রিতরা তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য পুলিশ ও হামলার শুরুতে উপস্থিত থাকা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয় ভূমিকার অভিযোগ করেন। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনী নিজেদের কৃতিত্ব দেখানোর জন্য বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে তার ইউনিয়নে উপ-নির্বাচনের পূর্বে বা পরে কোন ঘটনা ঘটেনি লিখে দেবার জন্য। স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউপি চেয়ারম্যান হরিবর বিশ্বাসকে এ ধরনের সনদ লিখে দেবার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

সংবাদ, ১৯ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন