নির্বাচনের পর জেলার বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণীর বিএনপি সমর্থক সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত জেলার উর্ধ্বতন প্রশাসন সর্বদলীয় মতবিনিময় সভা করিতে বাধ্য হইয়াছে। কিন্তু যেদিন এ সভা করিয়া আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও কর্মপন্থা নেওয়া হয়, সেদিনই অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর রাতেই নলছিটি উপজেলার হয়বতপুর গ্রামে নাগেরবাড়ির মনসা মন্দিরটি ভাঙ্গিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলা হইয়াছে। এই বাড়ির গৃহকর্তা শংকর কুমার নাথ ঢাকায় চাকুরী করেন। বাড়ীতে থাকেন তাহার বৃদ্ধা মা ও এক বোন। প্রহরী সাফেজ উদ্দিন, তাহার স্ত্রী ও নাতি মামুনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ঘরে আটকাইয়া রাখিয়া এই আক্রোশ চালানো হয়। কয়েকদিন আগে একই উপজেলার সিদ্ধকাঠি গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ঠাকুরবাড়ীতে একদল সন্ত্রাসী দরজা ভাঙ্গিয়া ভিতরে প্রবেশ করে। তাহার ঘরের আসবাবপত্র ও যাবতীয় মালামাল এমনকি দরজা-জানালা ভাঙ্গিয়া নিয়া যায়। বাড়ীর শিশু ও মহিলাদেরও প্রহার করা হয়। স্থানীয় ইউপি সদস্য গৌরাঙ্গ চক্রবর্তীর এই পরিবারটি এখন বলিতে গেলে একেবারে নিঃস্ব। কাঁঠালিয়া উপজেলার ছায়াআনি গ্রামে দুর্গাপূজা উপলক্ষে নির্মিত দুর্গা প্রতিমা ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছে। অপর একদল সন্ত্রাসী রাজাপুর উপজেলার ফুলহার গ্রামের বৃদ্ধ রাখাল দেউড়ির (৭৫) বাড়ীতে ঢুকিয়া গৃহকর্তা, তাহার পুত্রবধূ কাননবালা (৩৫) ও নাতনি কাকলীকে (১৫) পিটাইয়া আহত করে। দুর্বৃত্তরা পরিবারের লোকজনের শুধু পরিধেয় কাপড় বাদে অন্যান্য কাপড়-চোপড়, চাউল, ডাল ও আসবাবপত্র লুন্ঠন করিয়া নিয়া যায়। যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা গৃহকর্তাকে ৭ দিনের মধ্যে এক লক্ষ টাকা যোগাড় করিয়া রাখিতে বলে। অন্যথায় তাহার পুত্র কৃষ্ণকান্ত দেউড়িকে খুন করা হইবে বলিয়া হুমকি দেয়। রাজাপুর উপজেলা কমপ্লেক্সের এক সংখ্যালঘু কর্মকর্তাকে বিএনপি সমর্থকরা মারধর করিয়া এক লক্ষ টাকা চাঁদা দাবী করিয়াছে। সাত হাজার টাকা আদায় করিয়া তাহাকে রাজাপুর ত্যাগ করার হুমকি দেওয়া হয়। উপজেলার পিংরি ও বামনখান গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্যাডারদের হামলার মুখে পালাইয়া বেড়ায়। পিংরি গ্রামের নিতাই দাসকে বেদম প্রহার করিয়া আহত করা হয়। পাশের বাড়ীর সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর নিকট মোটা অংকের চাঁদা দাবি করিয়া হুমকি দেওয়া হয় যে, চাঁদা না দিলে ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া দিয়া মারিয়া ফেলা হইবে। এখানকার তিনটি পরিবার (জগদীশ পাল, সুভাষপাল ও স্বপন দাস) পালাইয়া গিয়া ঝালকাঠি শহরে আত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হইয়াছে। নলছিটি উপজেলার সাংবাদিকরাও হামলা ও হুমকির শিকার হইতেছে। সাংবাদিক ভোলানাথ দাসকে হুমকি দেওয়া হইয়াছে। পৌর এলাকার শীতলপাড়ায় ছাত্রলীগ কর্মী শেখর বসুর বাসায় কতিপয় বিএনপি কর্মী পুলিশের পরিচয় দিয়া প্রবেশ করে । শেখরকে বাসায় না পাইলেও সেখান থেকে তাহারা সোনার অলঙ্কারাদি নিয়া যায়। ঝালকাঠি শহরে ডাক্তারপট্টি এলাকায় হোমিও ফার্মেসীর মালিক পরিতোষকে বিএনপি কর্মীরা মারধর করিয়া দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। এদিকে এই দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মী শহরের সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের ভয়-ভীতি দেখাইয়া মোটা অংকের চাঁদা দাবী ও আদায়ের চেষ্টা করে বলিয়া অভিযোগ পাওয়া যায়। ইহাছাড়া রাজাপুরের পিংরি ও বামনখান, কাঁঠালিয়ার আওড়াবুনিয়া সদর উপজেলার গঙ্গারামচন্দ্রপুর এবং নলছিটির সুবিদপুর, মোল্লাহাট ও নাচনমহল ইউনিয়নের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘরে হামলাসহ মেয়েদের শালীনতাহানির ভয়ে পরিবারের কিশোরী-তরুণীদের রাতে ভিন্ন ভিন্ন গৃহে সরাইয়া রাখা হয় বলিয়া খবর পাওয়া যায়। কোন কোন পরিবারের মেয়েদের ঝালকাঠি শহরের আত্মীয়দের বাসায়ও রাখা হইতেছে। বরগুনায় আশ্রয়ের আশায় বরগুনা (দক্ষিণ) সংবাদদাতা জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা বরগুনা সদরের বিভিন্ন এলাকায় তাহাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন ছুটিয়া আসিতেছে। নির্বাচনের পর হইতে তাহাদের নিজ নিজ এলাকায় অব্যাহত হামলা অথবা সম্ভাব্য হামলার ভয়ে ভীত হইয়া আসিতেছে। বরগুনা শহর ও সদর উপজেলার খাজুরতলা, গৌরিচন্না, বদরখালী, কুমড়াখালী গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার একাধিক আশ্রিতদের সহিত কথা বলিয়া এই তথ্য জানা গিয়াছে। ইহারা বরিশাল, ঝালকাঠি, গৌরনদী,পিরোজপুর বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা হইতে আসিতেছে বলিয়া জানা গিয়াছে। নাজিরপুরের গ্রামে মন্দির দোকান ভাঙচুর পিরোজপুর অফিস জানায়, নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গার চরবানিয়ারী গ্রামে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালাইয়া তিনটি মন্দির ও চারটি দোকান ভাংচুর করে। গতকাল রবিবার এই হামলায় রবিদাসী নামে এক মহিলাসহ চারজন আহত হয়। আহত মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে।

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন