বিগত কিছুদিন ধরে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার সাংবাদিক, শহীদ সন্তান প্রবীর সিকদারের ফরিদপুরের বাসিন্দা ভাই, বোন, শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়-স্বজনদের উপর উপর্যুপরি হামলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী। প্রবীর সিকদারের সাথে কথা বলে ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তিনি  বলেন, বুধবার, ১৫ মে, ২০১৯, সকালে ফরিদপুর শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডে “সারদা ভবন” এর চারতলায় বসবাসকারী আমার ভগ্নিপতি সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক তপন দেবনাথের বাড়ীতে জোরপূর্বক একদল সন্ত্রাসী প্রবেশ করে। ঘরে তখন আমার বোন দীপ্তি সিকদার (৫০) এবং তাদের অটিস্টিক পুত্র দীপ্ত দেবনাথ (১৮) ছিল। সন্ত্রাসীদল অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দেয় এবং তপনের ঘরে সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিয়ে আসা তালা লাগিয়ে দেয়।

প্রবীর বলেন, এরপর তাদের রিক্সা করে সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে ছেড়ে দিয়ে বলে ‘ফরিদপুর নিয়ে প্রবীর সিকদারকে লেখালেখি বন্ধ করতে বল, নইলে তোদের কারো ফরিদপুরে থাকার দরকার নেই’।  এ পর্যায়ে তপন দেবনাথকে বাধ্য করা হয় স্ত্রী পুত্রসহ ঢাকার বাসে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে।

সাংবাদিক প্রবীর সিকদার বলেন, এই ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার শ্বশুর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ সাহার ছেলে বন্ধু সাহার ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর গ্রামের বাজারে অবস্থিত দোকানে হানা দেয় আরেকদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী। দোকানে বন্ধু সাহাকে না পেয়ে আমার শ্যালিকার ছেলে তাপস সাহাকে তুলে নিয়ে বন্ধু সাহার বাড়ীতে যায়। যাবার আগে তারা বন্ধুর সাহার এবং তার বড় দুই ভাই গৌড় সাহা এবং বলাই সাহার দোকান বন্ধ করে দেয় এবং শাসিয়ে যায় যেন দোকান না খোলা হয়।

বন্ধু সাহার জন্যে তার বাড়ীতে সন্ত্রাসীরা ২/৩ ঘন্টা অপেক্ষার পর বন্ধু সাহাকে না পেয়ে তার স্ত্রী ডলি সাহা (৩৭), ছেলে রিতম সাহা (৯) এবং ভাগ্নে তাপস সাহাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। মাইক্রোবাসে তাদের নিয়ে সরাসরি বাস ষ্ট্যান্ডে গিয়ে জোর করে ঢাকাগামী গোল্ডেন লাইন পরিবহণে তুলে দেয়। কিছুক্ষণ আগে বন্ধু সাহার স্ত্রী, পুত্র এবং ভাগ্নে ঢাকা এসে পৌঁছেছে বলে জানান প্রবীর।

বন্ধু সাহার বাড়ী থেকে তার স্ত্রী, পুত্র ও ভাগ্নেকে তুলে নেবার সময় সন্ত্রাসীরা প্রবীর সিকদারের শাশুড়ী অঞ্জলি সাহা (৭৫)কে বলে, ‘তোর জামাই প্রবীররে বলিস ফরিদপুর নিয়ে লেখালেখি বন্ধ করতে, নইলে তোদের কারো ফরিদপুরে থাকা হবে না’। সন্ত্রাসীরা শাসিয়ে আরও বলে, “না হইলে আর খারাপ পরিণতি হবে তোদের সবার” বলে জানান প্রবীর।

ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সাথে সাথে আমি ডিসি উম্মে সালমা তানজিয়া, এসপি মো. জাকির হোসেন খানকে ফোন দিলে ডিসি ফোন ধরেননি তবে এসপি ফোনে কথা বললেও অনুরোধ সত্বেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অবশ্য পরে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম নাসিমকে জানালে তিনি ফোর্স পাঠান।‘

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম নাসিম  বলেন, ‘মৌখিক অভিযোগ পেয়ে আমি পুলিশ সদস্যদের ঐ দুটি ঘটনাস্থলে পাঠাই। কিন্তু কোন দুষ্কৃতকারীকে সেখানে পাওয়া যায়নি। কি ঘটেছিল সেখানে তাও স্থানীয় পর্যায়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।‘ এ ব্যাপারে আক্রান্ত পরিবারকে থানায় লিখিত অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেন বলে জানান ওসি নাসিম।

মামলা বা জিডি করার প্রসঙ্গে প্রবীর সিকদার অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ফরিদপুরে খুনের উদ্দশ্যে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল, আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট বদিউজ্জামান বাবুল ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অলক সেনকে, সেই সব নৃশংস ঘটনার বিচার-শাস্তি দূরে থাকুক, কোনও তদন্ত কি হয়েছে? তাহলে আমি কার কাছে কিসের তদন্ত আর বিচার চাইবো?’

উল্লেখ্য, ক’দিন আগে, ৮ মে রাত পৌনে ১০টায় সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের কানাইপুর সিকদারপাড়া গ্রামে সিকদার বাড়ীতে বসবাসকারী প্রবীর সিকদারের ছোট ভাই সুবীর সিকদার (৫৩) এর বাসায় হামলা চালায় একদল হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র সন্ত্রাসী এবং হুমকি ধামকি ও ভাঙচুর করে।

ঐদিন প্রতি বছরের মত কানাইপুর গ্রামের শহীদ পরিবারগুলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কানাইপুর গণহত্যা দিবস পালন করে থাকে। সে অনুষ্ঠানে প্রতি বছরের মত এবারও প্রবীর সিকদার পরিবারসহ উপস্থিত থাকেন তবে এবারে ঘটনার সময় প্রবীর সিকদার ছাড়া তার স্ত্রী-পুত্রসহ ভাইবোনেরা উপস্থিত ছিলেন।

শহীদ পরিবারের সন্তান সাংবাদিক প্রবীর শিকদার বলেন, ‘কানাইপুর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে যাওয়া হয়নি। কানাইপুর গেলে আমি ভাই সুবীরের বাড়িতেই থাকি। আমি কানাইপুর এসেছি এ খবরের ভিত্তিতে আমাকে টার্গেট করেই এ হামলা চালানো হয়েছে। কারণ, আমি যে ঘরে থাকি দোতলার সেই ঘরের জানালার কাচ ভাঙচুর করা হয়েছে। ফরিদপুরের বিভিন্ন অনিয়ম-অসংগতি-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে একটি মহল আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে।‘

১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা কানাইপুরে ২৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে প্রবীর সিকদারের বাবা, কাকা এবং দাদুসহ সিকদারবাড়ির ১০ জন রয়েছেন।

প্রবীর সিকদার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘উত্তরাধিকার একাত্তর নিউজ’, বাংলা দৈনিক দৈনিক বাংলা একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা উত্তরাধিকার ’৭১–এর সম্পাদনা করেন। তিনি ঢাকায় থাকেন। ফরিদপুরে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার সময় ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল ‘সেই রাজাকার’ সিরিজে প্রতিবেদন লেখার কারণে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন প্রবীর সিকদার। তাঁর ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে বাদ দিতে হয় এবং তার একটি হাত সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়।

বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন